Advertisement
E-Paper

সংযত রাশিয়ায় মাতোয়ারা ভারত

আধুনিক রাশিয়া তৈরির পরে যাঁদের গৌরবগাথা দেখে চমকে গিয়েছে ফুটবল-বিশ্ব। লেভ ইয়াশিনের পরে গোলকিপার হিসাবে সেরাদের তালিকায় যাঁর নাম উঠে গিয়েছে রবিবার রাতে, সেই ইগর আকিনফেভের একটা ছবিও চোখে পড়েনি কোথাও!

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৮ ০৫:০৯
বিশ্বকাপের প্রতি ম্যাচেই চোখে পড়ছে রঙিন গ্যালারি।

বিশ্বকাপের প্রতি ম্যাচেই চোখে পড়ছে রঙিন গ্যালারি।

লিয়োনেল মেসির যে ছবিগুলো রাস্তার ধারের বোর্ডে লাগানো ছিল, সেগুলো রাতারাতি উধাও!

সেখানে মঙ্গলবার দুপুরে নেমার দা সিলভা স্যান্টোস (জুনিয়র) আর ফিলিপে কুটিনহোর হাসিমুখের ছবি লাগাতে দেখলাম একটি বিখ্যাত গাড়ি সংস্থার কর্মীদের।

ক্রেমলিনের উল্টো দিকের রাস্তায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর একটা ছবি আছে বটে, কিন্তু সেটাও বেশ বিবর্ণ। মনে হল সি আর সেভেনের স্পনসররা ওটা লাগিয়েছিলেন বিশ্বকাপের আগে। ধুলো জমে যাওয়ার পরে আর পরিষ্কার হয়নি। আসলে প্রয়োজন হয়নি।

কিন্তু রাশিয়ার নতুন জাতীয় নায়কদের ছবি কোথায়?

আধুনিক রাশিয়া তৈরির পরে যাঁদের গৌরবগাথা দেখে চমকে গিয়েছে ফুটবল-বিশ্ব। লেভ ইয়াশিনের পরে গোলকিপার হিসাবে সেরাদের তালিকায় যাঁর নাম উঠে গিয়েছে রবিবার রাতে, সেই ইগর আকিনফেভের একটা ছবিও চোখে পড়েনি কোথাও! গোল করার পরে যাঁর আঙুল মুখে-দেওয়া সেলিব্রেশন দেখে গ্যালারি থেকে উড়ন্ত চুমু ছোড়েন রুশ সুন্দরীরা, সেই ফিদর স্নোলভের মুখের ছবিও বা কোথায়? অথচ তিকিতাকার পীঠস্থান স্পেনকে হারিয়ে রাশিয়ার এই ফুটবল-পুনর্জন্মকে তুলনা করা হচ্ছে লিও তলস্তয়ের সেই ‘রেজ়ারেকশন’ উপন্যাসের সঙ্গে। মস্কভা নদীর দু’পার ধরে যাওয়া-আসার পথে সেই বিস্ময় আরও বাড়ে, যখন দেখা যায় রাস্তায় ঝোলানো হয়নি একটাও সাদা-নীল-লাল পতাকা। কলকাতার অলি-গলিতে বিভিন্ন দেশের পতাকা টাঙিয়ে সমর্থকদের মাতামাতি দেখা চোখে যা বেমানানই লাগল।

এ বারের বিশ্বকাপের গ্রুপ লিগে প্রচুর বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে শেষ ষোলোর মধ্যে একসঙ্গে এত মহানায়কের বিদায় সম্ভবত প্রথম। তা সত্ত্বেও ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ৭০ নম্বর দেশের শেষ আটে যাওয়াটাই ছাপিয়ে গিয়েছে সব চমককে। তবু কেন এই ছবি ভ্লাদিমির পুতিনের দেশে? স্থানীয় কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, এক) আধুনিক রুশরা উচ্ছ্বাস দেখানোর ব্যাপারে বরাবরই সংযত। যত বড় সাফল্যই আসুক, আদিখ্যেতা করেন না কিছু নিয়েই। এ দিক দিয়ে স্তালিন-লেনিনের পথেই এখনও হাঁটতে পছন্দ করেন তাঁরা। দুই) এ দেশে আইস হকি এবং জিমন্যাস্টিক্স ফুটবলের চেয়ে বরাবর বেশি জনপ্রিয়। দেশের টিমের ফুটবল খেলা দেখতে মাঠ ভর্তি হলেও, গোটা ব্যাপারটা রাশিয়ার মজ্জাগত হয়নি এখনও।

মাতামাতি না করলেও অবশ্য আইএস জঙ্গিদের ফতোয়া উপেক্ষা করে টুর্নামেন্টকে মসৃণ রেখেছেন রুশরা। সব চলছে যান্ত্রিক গতিতে। কিন্তু ফুটবলের বিশ্বকাপ তো শুধুই একটা প্রতিযোগিতা নয়, এ হল আবেগের সমুদ্র। যা নাড়িয়ে দেয় সারা বিশ্বকে। গেঁথে ফেলে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের সঙ্গে কলকাতাকে। পর্তুগালের সঙ্গে গোয়াকে। গ্রামের উঠোন থেকে চল্লিশ তলার ড্রয়িংরুমে যা নিয়ে তুফান ওঠে। সেই বিশ্বকাপ তা হলে মাতিয়ে রাখছেন কারা?

লুঝনিকি থেকে স্পার্টাক স্টেডিয়াম, ক্রেমলিন থেকে রেড স্কোয়ারের ফ্যান জ়োনে ঘুরে যা দেখা এবং জানা গেল, তাতে চমকে উঠতে

হয়। ফিফার হিসেব বলছে, বিশ্বকাপ খেলিয়ে দেশের মধ্যে ব্রাজিল থেকে এসেছেন সব চেয়ে বেশি সমর্থক। সংখ্যাটা প্রায় ষাট হাজার। তার পরেই ছিল আর্জেন্টিনা। কুড়ি হাজারের মতো। কিন্তু আগত দর্শক-সংখ্যার হিসেবে মারাদোনার দেশকে হারিয়ে দিয়েছে বিশ্বকাপ না-খেলা এক দেশ। ভারত।

আমাদের দেশের প্রায় সাড়ে বাইশ হাজার দর্শক রাশিয়ায় এসেছেন বা আসছেন খেলা দেখতে। এবং তাঁদের মধ্যে ৪৮৮৯ জন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বলে জানালেন ফিফার এক কর্তা। এক দল বাঙালি ফিরে গিয়েছেন, আর এক দল আসছেন দেখতে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে সাতটায় যে বিমান মস্কোর মাটি ছুঁল, তাতেই দেখা গেল এসেছেন আটত্রিশ জন বঙ্গসন্তান। তাঁদের কেউ ডাক্তার, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরি করেন। ওঁরা হিসেব দিচ্ছিলেন, কেউ চারটে, কেউ পাঁচটা বিশ্বকাপ মাঠে বসে দেখেছেন। চৌধুরী, সরকার, বসু, গঙ্গোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, মণ্ডল, গুহ-র ছড়াছড়ি ফ্যান জ়োনে। যাদের কণ্ঠস্বরে রেড স্কোয়ার সরগরম। এঁদের অনেকেই যুবভারতী বা ময়দানে খেলা দেখতে যাননি কখনও। নেমার, হ্যারি কেনদের দেখতে আসা সল্টলেকের এক ডাক্তার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন স্পার্টাক স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তায়। ইংল্যান্ড-কলম্বিয়া ম্যাচ শুরু হওয়ার সাত ঘণ্টা আগে চলে এসেছেন স্টেডিয়ামে। স্বীকার করলেন, বাড়ির পাশের মাঠ হওয়া সত্ত্বেও যুবভারতীতে অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ দেখতে যাননি। কখনও ময়দানের কোনও দলেরও খেলা দেখেননি। যা হিসেব দিলেন তাতে পাঁচটা ম্যাচ দেখতে মাথা-পিছু সাত লাখ টাকা খরচ হবে ওঁদের।

কীসের টানে গাঁটের কড়ি খরচ করে বাঙালির এমন বিশ্বকাপ দর্শন? জনা দশেক বঙ্গসন্তানের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, একটা অংশ স্রেফ ভালবেসেই চার বছর অন্তর ফুটবল-যজ্ঞের আঁচ নিতে আসেন বিশ্বকাপে। এটা একটা নেশা। সঙ্গে দেশটাও ঘোরা হয়ে যায়। হাতে টিকিট থাকলে ভিসা পাওয়া নিশ্চিত। সঙ্গে ফ্যান কার্ড। কারও কারও অবশ্য দেশে ফিরে ‘বিশ্বকাপ দেখে এলাম’ গল্প শোনানোর দায়ও আছে।

আর তাই রাশিয়ানরা যা করছেন না, তা-ই করছেন বঙ্গসন্তান বা ভারতীয়রা। সাম্বার দলের সমর্থকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে বিশ্ব ফুটবলের যজ্ঞে শামিল সবাই! ভারত খেলছে না। আর্জেন্টিনা নেই। রোনাল্ডোর পর্তুগালও দেশে ফিরে গিয়েছে। ফলে ব্রাজিলই ভরসা। ব্রাজিলের জার্সি বা পতাকা তাই বিকোচ্ছে দেদার।

Indian supporters Football FIFA World Cup 2018 বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy