Advertisement
১৭ জুন ২০২৪

ওয়ান ডে অপূর্ণতার দুঃখ তাড়া করছে প্রত্যাবর্তনের ‘সিংহ’কে

একটা পা অন্যটার উপর অলস ঔদ্ধত্যে তোলা, বুটের ডগা নড়ছে মাঝেমধ্যে। ফোটোগ্রাফারের মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশবাল্ব, বিভিন্ন পোজে তাঁর প্রত্যাবর্তনের মেজাজকে ধরার আকুতি, কিছুতেই তো কিছু হচ্ছে না। কেমন যেন পাথুরে দৃষ্টি, মুখমন্ডলের জ্যামিতিকে ঘিরে বসে অপ্রসন্নতা। যুবরাজ সিংহ একটুও হাসছেন না! অথচ তাঁর তো আজ হাসা উচিত, প্রফুল্ল থাকা উচিত। দেড়টা বছর তো খুব কম সময় নয়।

যুবরাজের কলকাতা সফর। ম্যারাথনে নেহা ধুপিয়ার সঙ্গে।

যুবরাজের কলকাতা সফর। ম্যারাথনে নেহা ধুপিয়ার সঙ্গে।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:২১
Share: Save:

একটা পা অন্যটার উপর অলস ঔদ্ধত্যে তোলা, বুটের ডগা নড়ছে মাঝেমধ্যে। ফোটোগ্রাফারের মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশবাল্ব, বিভিন্ন পোজে তাঁর প্রত্যাবর্তনের মেজাজকে ধরার আকুতি, কিছুতেই তো কিছু হচ্ছে না। কেমন যেন পাথুরে দৃষ্টি, মুখমন্ডলের জ্যামিতিকে ঘিরে বসে অপ্রসন্নতা।

যুবরাজ সিংহ একটুও হাসছেন না!

অথচ তাঁর তো আজ হাসা উচিত, প্রফুল্ল থাকা উচিত। দেড়টা বছর তো খুব কম সময় নয়। লোকে তো বলেছিল, যুবরাজ সিংহ আর পারবেন না। আর সম্ভব নয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যে লোকের পরিচিতি ছিল স্টুয়ার্ট ব্রডকে ছ’বলে ছয় ছক্কা, সেই একই লোক তো বছর দেড়েক আগে বাংলাদেশে কাপ ফাইনালে ২১ বলে তুলেছিলেন ১১! ভারত হেরেছিল, বিশেষজ্ঞকুল একই সঙ্গে লিখে ফেলেছিল তাঁর ক্রিকেটীয় কেরিয়ারের ‘ডেথ সার্টিফিকেট’। যুদ্ধটা তো সহজ ছিল না। তা হলে মহানায়ক এত নির্লিপ্ত? এতটা বিষণ্ণ? কলকাতা ম্যারাথন, সেখানে তিনি এলেন ঠিকই। কিন্তু কোনও উদ্বেলিত উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত তো তৈরি হল না।

বোধহয় সম্ভবও নয়। কারণ যুবরাজ সিংহের স্বপ্নপূরণের অর্ধেকটা হয়েছে, পুরোটা নয়। সোজাসুজি বললে, তিনি হতাশ। টি-টোয়েন্টি টিমে ফিরলে কী হবে, ভারতের ওয়ান ডে টিমে ডাক না পাওয়ার চোরা দুঃখ তো প্রত্যাবর্তনের আনন্দে কোথাও যেন পথ আটকাচ্ছে।

‘‘আমি তো ভাল খেলছিলাম। বিজয় হাজারেতে (রঞ্জি ওয়ান ডে টুর্নামেন্ট) বেশ কয়েকটা নব্বই করেছি। বল হাতে পাঁচ-ছ’ওভারও করে দিচ্ছিলাম। নিজেকে প্রস্তুতও করছিলাম সে ভাবে,’’ রবিবার সকালে কলকাতার এক অভিজাত হোটেলে আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে আফসোস ছিটকে বেরোয় মৃত্যু়ঞ্জয়ীর কণ্ঠস্বর থেকে। একটু চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করেন, ‘‘কিন্তু আমার তো কিছু করারও নেই। এটা আমার হাতে নেই। আমাকে টি-টোয়েন্টিতে মন দিতে হবে। ওখানে ভাল খেলতে হবে। তবে এটা বলব যে, ওয়ান ডে টিমে না থাকায় আমি হতাশ।’’

স্বাভাবিক। ঘরোয়া ক্রিকেটের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান যদি ছেড়ে দেওয়াও যায়, যে জীবনযুদ্ধ তিনি লড়ে উঠেছেন তার পর প্রাপ্য না পেলে মন খারাপ স্বাভাবিক। গত দেড় বছরের প্রত্যাবর্তন যুদ্ধের বিবরণীতে এখনও মাঝেমধ্যে চলে আসে কর্কট রোগের বিরুদ্ধে চোয়ালচাপা যুদ্ধ। মনে পড়ে, সেই কালান্তক দিনগুলো। মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে পড়ে, ‘‘ না, না গত দেড় বছরের লড়াইটা নয়। অসুস্থতার বিরুদ্ধে ওই লড়াইটাই আমার জীবনে কঠিনতম...।’’

শরীর চলত না। ফিটনেস ট্রেনিংয়ের সময় বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। শূন্য থেকে আবার শুরু করতে হয়েছিল সব কিছু। এক-এক সময় কী ভাবে নিজেকে মোটিভেট করবেন, বুঝে পেতেন না। ‘‘আসলে আগে যা যা করতাম, সেগুলো আর সহজে হত না। শরীরটাই রিঅ্যাক্ট করত না। মাঝেমধ্যে নিজেকে মোটিভেট করাই সমস্যা হয়ে যেত,’’ টানা বলতে বলতে একটু থামেন ‘পিউমা’ অ্যাথলিট। আবার শুরু করেন, ‘‘নিজেকে তখন একটাই কথা বলতাম। যুবরাজ সিংহ, তোমাকে আবার ইন্ডিয়া খেলতে হবে। তুমি তো সেটাই মনেপ্রাণে চাও। আমার তো মনে হয় এটাই আমাকে আবার ফিরিয়ে এনেছে। ফিটনেস ট্রেনিং তো বটেই, দৌড়োতামও খুব। চিকিৎসার পর ওটাও গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্ট ছিল। সব খেলাতেই তো ওটা লাগে।’’ কিন্তু অবাধ্য শরীরের বিরুদ্ধে শুধু তো নয়, বাইশ গজের শাসানিও ছিল সঙ্গে। সবচেয়ে বড় হল যে যুবরাজকে লোকে চিনত, জানত, সে কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। ক্যানসারের বিরুদ্ধে জিতলেও ক্রিকেটীয় যুদ্ধের ময়দান থেকে ক্রমশ ধুসর হয়ে যাচ্ছিলেন। ফর্ম নেই। রান নেই। টি টোয়েন্টি— যা ছিল তাঁর নির্মম শাসনের পৃথিবী, সেটাও অপরিচিত হয়ে যাচ্ছিল। এবং শেষে বাদ। একেবারে দেড় বছরের ক্রিকেটীয় নির্বাসন।

কতটা কঠিন ছিল প্রত্যাবর্তন?

আনন্দবাজারের সামনে হোটেলে। রবিবার।

‘‘ভাল রকম। যা যা ঘটুক চাইতাম, যে যে জিনিসগুলো আশা করতাম, ঘটছিল না। পরিবারের সাপোর্টটা তখন খুব ভাল ভাবে পেয়েছি। বিশেষ করে মা, আমার গুরুজি, কাছের বন্ধুবান্ধব। এরা সব সময় বিশ্বাস জুগিয়ে গিয়েছেন আমাকে। এতে মোটিভেটেড হতাম। তার পর ভাল করতেও শুরু করলাম,’’ বলছিলেন যুবরাজ। যিনি জানেন, আসন্ন অস্ট্রেলিয়া সফর তাঁর জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক স্টেশন হতে যাচ্ছে। যেখানে তাঁর প্রত্যেকটা পারফরম্যান্স তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারের গন্তব্য ঠিক করে দেবে। নির্যাসে, শেষ সুযোগ। ‘‘আমি জানি, সফরটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আসলে আমার কাছে আগামী কয়েকটা বছরই খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেখানেই আমি খেলি, ভাল করতে হবে আমাকে। তবে লোকেরও বোঝা উচিত যে, যুবরাজ সিংহের কামব্যাক সহজ হবে না। নেমেই ছক্কা মারা সহজ হবে না। তারও সময় লাগবে। তাকেও সময় দিতে হবে কয়েকটা ম্যাচে গুছিয়ে নেওয়ার।’’ কিন্তু ভারতবাসীর প্রত্যাশা সে সব আর কবে শুনেছে? চাপ তো থাকবেই। ‘‘হ্যাঁ থাকবে। জানি, টি-টোয়েন্টি মানে দ্রুত রান তুলতে হবে। কিন্তু তৈরি হয়ে যাব।’’

আসলে যুবরাজ বোধহয় বুঝতে পারছেন যে, জীবন তাঁকে আরও এক বার অদ্ভুত এক সন্ধিক্ষণে এনে দাঁড় করিয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ তাঁকে গত বছর এপ্রিলে ফেলে দিয়েছিল ‘ব্রাত্যজনের’ চোরাবালিতে। আর এ বার অস্ট্রেলিয়ায় গোটা কয়েক ভাল ইনিংস তাঁকে একই টুর্নামেন্টের পাসপোর্ট দিয়ে দিতে পারে। পারবেন তিনি বিশ্বকাপ টিমে ঢুকতে? নতুন বছরে ব্যাটে ফিরবে সোনার সাফল্য? শুনে উত্তর এল, ‘‘দেখা যাক। আশা তো করছি নতুন বছরে ভাল সাফল্যই পাব। দেশকে গর্বিত করতে পারব।’’

এবং যুবরাজ সিংহ এ বারও, এতটুকু হাসলেন না!

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE