Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

আমি পারিনি, দেশ পারেনি, মেসি জিতুক

ছবিটা ইন্টারনেটে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। ইউটিউবে ভিডিওটাও। বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিলগ্নে কোথাও তো ছিলেন না তিনি! দেশের মাটিতে তাঁর নিজের বিশ্বকাপ-বিসর্জন হয়ে গিয়েছিল সপ্তাহখানেক আগে। আর দিন তিনেক আগে তাঁর দেশও এত দিনের ফুটবল-বীরত্বের মুকুটটা খুলে ফেলেছে। তবু বিশ্বকাপ-গ্রহ জুড়ে আজ শুধুই নেইমার দ্য সিলভা।

যন্ত্রণা... চোট পেয়ে ছিটকে যাওয়ার পর এই প্রথম সাংবাদিক বৈঠকে। সেখানেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন নেইমার। তেরেসোপোলিসে ব্রাজিল দলের বেস ক্যাম্পে।  ছবি: রয়টার্স

যন্ত্রণা... চোট পেয়ে ছিটকে যাওয়ার পর এই প্রথম সাংবাদিক বৈঠকে। সেখানেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন নেইমার। তেরেসোপোলিসে ব্রাজিল দলের বেস ক্যাম্পে। ছবি: রয়টার্স

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৪ ০৪:২১
Share: Save:

ছবিটা ইন্টারনেটে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। ইউটিউবে ভিডিওটাও।

বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিলগ্নে কোথাও তো ছিলেন না তিনি! দেশের মাটিতে তাঁর নিজের বিশ্বকাপ-বিসর্জন হয়ে গিয়েছিল সপ্তাহখানেক আগে। আর দিন তিনেক আগে তাঁর দেশও এত দিনের ফুটবল-বীরত্বের মুকুটটা খুলে ফেলেছে। তবু বিশ্বকাপ-গ্রহ জুড়ে আজ শুধুই নেইমার দ্য সিলভা।

যে নেইমার কাঁদছেন। কলম্বিয়া ম্যাচের সেই ভয়ঙ্কর চোটের পর এই প্রথম সশরীরে আবির্ভূত হলেন। সাংবাদিকদের সামনে, বিশ্ব দরবারে। কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে এল বারবার। আর চোখ উপচে কান্না।

ব্রাজিলের যে বৃদ্ধ সমর্থকের হাতে কাপ ধরা হতবিহ্বল ছবিটা সাম্প্রতিক সাম্বা সমাধির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল, নেইমারের কান্না বোধহয় তাকে গভীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দিল। কান্না নিজের দেশের রক্তাক্ত হওয়ার কথা ভেবে। কান্না মারের চোটে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারতেন ভেবে। কথায় কথায় যন্ত্রণা।

তাঁরা তো সত্যিই পারলেন না।

কী বললেন নেইমার?

যেটা বললেন, সেটা অনেককেই স্তম্ভিত করার মতো। বিশেষ করে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা ‘সুসম্পর্কের’ খবরাখবরে যারা অবহিত, তাঁদের। বিশ্বকাপ ঘিরে যে কলকাতা প্রত্যেক চার বছর অন্তর আড়াআড়ি হলুদ আর নীল-সাদায় ভাগ হয়ে যায়, কথাটা তাকেও চমকে দেওয়ার মতো।

ব্রাজিল-বোমা কি না এখন আর্জেন্তিনার জয় চাইছেন! বলছেন, “আমি পারিনি। আমার দেশ পারেনি। তা হলে মেসি জিতুক।”

আর এই ‘আমি পারিনি’র প্রসঙ্গে ঢুকতেই ঝরঝরিয়ে কান্না। বৃহস্পতিবারই তেরেসোপোলিসে জাতীয় দলের বেসক্যাম্পে গিয়ে সহযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছিলেন। বিদগ্ধ কোচ লুই ফিলিপ স্কোলারিকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন স্বাভাবিক থাকার। তবু জীবনের এমন আকস্মিক বিপর্যয়কে উপেক্ষা করতে পারলেন কই! আবেগ বরাবরের মতো আবার গ্রাস করল তাঁকে।

নেইমারের ‘ঘাতক’, কলম্বিয়ার ডিফেন্ডার জুয়ান জুনিগা তাঁকে ফোন করেছিলেন। ক্ষমা চেয়েছেন নিঃশর্তে। কিন্তু নেইমার আজও বুঝে উঠতে পারেননি, আদৌ ক্ষমা করতে পেরেছেন কি না। “মাত্র দু’সেন্টিমিটার, জানেন! দু’সেন্টিমিটার নীচে যদি লাগত, তা হলে আমার ফুটবল জীবনটাই শেষ হয়ে যেতে পারত। হয়তো পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে কাটাতে হতো বাকি জীবনটা। হয়তো দেখতেন আমি হুইলচেয়ারে ঘুরছি!” বলতে বলতে আবার কান্না, আবার বলে ফেলা, “জুনিগাকে আমি কিছু বলিনি। কিন্তু ওর কাজটাকে সমর্থনও করতে পারিনি। জানি না ও আমাকে মারার জন্যই ইচ্ছে করে গুঁতো মেরেছিল কি না। কিন্তু ফুটবল যদি আপনারা বোঝেন, তা হলে বলুন তো, ওটা কি স্বাভাবিক চ্যালেঞ্জ ছিল?”

নেইমারের আরও খারাপ লাগছে যে, ঘটনাটা ঘটল তাঁর ফুটবল কেরিয়ারের এমন গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিক্ষণে। জুনিগার মারের প্রতিরোধটাই তিনি করতে পারলেন না পিছন ফিরে থাকায়। হাহাকার করে উঠলেন, “আমি তো নিজেকে বাঁচাতেই পারলাম না!”

নেইমার-বিহীন ব্রাজিলও বাঁচেনি। “৭-১! কী যে হল সে দিন, আমি সত্যিই বুঝে পাইনি। হেরে যেতেই পারি। কিন্তু এ রকম ভাবে নয়। তবে আপনারা যদি ভাবেন এর পর থেকে মাথা নিচু করে ঘুরব, ব্রাজিল ফুটবল ধ্বংস হয়ে গেল— তা হলে ভুল ভাবছেন।” নেইমারের কথায়, যন্ত্রণাটা অনেক দিন থাকবে ঠিকই। কিন্তু ভাল দিন আবার আসবে... আসবেই। কিন্তু হল কেন এ রকম? নেইমারের কাছে কোনও ব্যাখ্যা নেই। “ছ-সাত গোল খাওয়ার পরেও দেখছিলাম ওরা চেষ্টা করছে। দৌড়চ্ছে। আমি লজ্জিত নই এই টিমের সদস্য হিসেবে। বরং এরা আমার টিমমেট বলে গর্ব হয়।”

কোচ স্কোলারিকেও নেইমার ছাড়তে চান না। জার্মানদের হাতে চরম হেনস্থার পরেও তাঁর মনে হয়, ফিলিপাও থাকুন। তাঁর এজেন্ট যতই স্কোলারিকে ‘অপদার্থ বুড়ো ভাম’ বলুন, দেশজুড়ে যতই স্কোলারি-হটাও আওয়াজ উঠুক, বিকল্প হিসেবে উঠে আসুক কোরিন্থিয়ান্স কোচ টিটে, নেইমারের ছোটবেলার কোচ রামালহো বা প্রাক্তন ব্রাজিল ও রিয়াল মাদ্রিদ ম্যানেজার লুক্সেমবুর্গোর নাম, নেইমার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। বলে দিচ্ছেন, “আমার এজেন্ট কী বলেছে, সেটা ওর অভিমত। আমার নয়। আমার তরফে শুধু আমি আর আমার বাবা কথা বলব। আমি মনে করি স্কোলারির কোচ থাকা উচিত।

এবং তিনি মনে করেন রবিবার কাপটা ওঠা উচিত লিওনেল মেসির হাতে। “ও তো সবই পেয়েছে জীবনে। বিশ্বকাপটাও পাওয়া উচিত। তা ছাড়া ও আমার খুব ভাল বন্ধু। বার্সেলোনায় আমার টিমমেট মেসি, মাসচেরানো। তাই ওরা যদি জেতে, খারাপ লাগবে না,” বলছেন নেইমার।

তা হলে কি তিনি আচমকা আর্জেন্তিনার সমর্থক হয়ে গেলেন?

হাঁ হাঁ করে ওঠেন ব্রাজিল-বোমা। “না, না। বার্সার কথা ভেবে মেসির নাম বললাম।” মুখে তখন আবেগের অতটা বহিঃপ্রকাশ না থাকলেও এটা তো ঘটনা যে, তিনি আর্জেন্তিনার হাতে কাপ চাননি। ফাইনালে আর্জেন্তিনাকে চেয়েছিলেন বটে। কিন্তু উল্টো দিকে দেখতে চেয়েছিলেন নিজের ব্রাজিলকে। চেয়েছিলেন মারাকানায় দাঁড়িয়ে চৌষট্টি বছর আগের ক্ষত ‘মারাকানাজো’ ভুলিয়ে দিতে।

কোথা থেকে কী হয়ে গেল! মারাকানায় আর্জেন্তিনা থাকবে। আর তাঁকে থাকতে হবে টিভির সামনে। দেখতে হবে বন্ধু মেসি বিশ্বজয়ের যুদ্ধে লড়ছেন, আর তিনি ভাঙা শিরদাঁড়া নিয়ে শুয়ে। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে হবে, আমি এ বার পারিনি। আমার বন্ধু তো পারুক!

মুখে যা-ই বলুন, নেইমার দ্য সিলভার বাইশ বছরের জীবনে সত্যিই এটা সবচেয়ে ঘৃণ্য সপ্তাহ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

fifaworldcup neymar messi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE