Advertisement
E-Paper

এ বার মেসি, ঐতিহ্য ধরে রাখল মারাকানার হাড়িকাঠ

আলেজান্দ্রো সাবেয়া ব্রাজিল বিশ্বকাপের যাবতীয় কোচেদের মধ্যে মোটামুটি ভাবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সব চেয়ে কম গ্রহণযোগ্য। এমনকী, নিজের দেশের মিডিয়াতেও! সাবেয়ার কথাবার্তা প্রায় বিদেশ দফতরের মুখপাত্রের মতো। এত সতর্ক, বাহারহীন এবং মাপা যে, তাঁকে টিমের কোনও প্লেয়ারবিহীন একা প্রেস কনফারেন্সে ঢুকতে দেখলেই সকলের ভ্রূ কুঁচকে যায়, আবার সময়টা তা হলে বেকার গেল!

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৪ ০২:৫৭
ম্যাচের শেষে। ছবি: উৎপল সরকার

ম্যাচের শেষে। ছবি: উৎপল সরকার

আলেজান্দ্রো সাবেয়া ব্রাজিল বিশ্বকাপের যাবতীয় কোচেদের মধ্যে মোটামুটি ভাবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সব চেয়ে কম গ্রহণযোগ্য। এমনকী, নিজের দেশের মিডিয়াতেও! সাবেয়ার কথাবার্তা প্রায় বিদেশ দফতরের মুখপাত্রের মতো। এত সতর্ক, বাহারহীন এবং মাপা যে, তাঁকে টিমের কোনও প্লেয়ারবিহীন একা প্রেস কনফারেন্সে ঢুকতে দেখলেই সকলের ভ্রূ কুঁচকে যায়, আবার সময়টা তা হলে বেকার গেল!

এ হেন সাবেয়া যখন ফাইনাল পরবর্তী মিডিয়া বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে হাততালি দিল গোটা মিডিয়া! তার আগের যে আলোচনা হয়েছে তা থেকেও পরিষ্কার হাততালিটা কেন? আর্জেন্তিনা হেরেছে তিনটে সুযোগ কাজে লাগাতে না পেরে। কিন্তু ফেভারিট জার্মানিকে তারা একটু হলেই কাঁদিয়ে ছেড়েছিল। ফিফার ম্যাচ স্ট্যাটসে দেখাচ্ছে, ম্যাচে বল দখলের যুদ্ধে আর্জেন্তিনাকে শতকরা কুড়ি ভাগ পিছনে রেখেছিল জোয়াকিম লো-র বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি। তারা বল নিজেদের দখলে রেখেছে ম্যাচের ষাট ভাগ। আর্জেন্তিনীয়রা রেখেছে শতকরা চল্লিশ ভাগ। অথচ পেনিট্রেটিভ জোনে জার্মানির ঢোকার অনুপাত যেখানে ১১%, সেখানে মাসচেরানোর আর্জেন্তিনার ১৭%।

চুরাশি বছরে পড়া বিশ্বকাপ একশো চুরাশি বছরে পড়ে গেলেও হয়তো এই দার্শনিক তর্কটা থাকবে যে, মারাকানার ফাইনালে সে দিন জার্মানি তাদের বাড়তি স্ট্যামিনা আর বিশ্ববিখ্যাত জার্মান রোখের জোরে কি অতিরিক্ত সময়ে জিতেছিল? নাকি আর্জেন্তিনাই আর্জেন্তিনাকে হারিয়েছিল তিনটে সহজতম সুযোগের অপচয়ে?

একটা বিষয় নিয়ে অবশ্য কোনও দর্শন নেই। কোনও তর্কও না। লিওনেল মেসির যে চূড়ান্ত হার হয়েছে।

আর্জেন্তিনাকে এই মুহূর্তে ‘পৃথিবীর সব চেয়ে বিষাদগ্রস্ত দেশ’ বলেছে জনপ্রিয় মার্কিন দৈনিক। আর মেসিকে ‘বিশ্বের সব চেয়ে বিষণ্ণ মানুষ’। এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গেও কোনও তর্ক আমদানি হওয়ার প্রশ্ন নেই!

মেসি যে বিজয়মঞ্চে উঠবেন বলে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটাতেই উঠলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা বা অন্য বিশ্বকাপের মতো এখানে মাঠের মধ্যে প্রাইজ দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। প্লেয়ারদের হেঁটে উঠতে হল দেড় তলা সাইজের অস্থায়ী মঞ্চে। এই সরণিটাই তো মেসি হাঁটতে চেয়েছিলেন। কাপটাও হাতে পেলেন।

কিন্তু এটা ভুল ট্রফি! ভুল মুহূর্ত! আর ভুল পুরস্কারও! যা পাওয়া নিয়ে জীবনে এই প্রথম নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে হবে আধুনিক ফুটবলের বরাবরের ফার্স্ট বয়টাকে! যেখানে কি না জীবনে তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম দাঁড়িয়ে পড়বেন দিয়েগো মারাদোনাও! এমনকী যারা দিল এই ট্রফি, সেই ফিফা প্রেসিডেন্ট অবধি বলে দেবেন, “আরে, মেসি প্রাইজটা নিতে উঠে আসছে দেখে আমি তো আশ্চর্য হয়ে গেলাম!”

ফিফার বিচারেই চার বারের বর্ষসেরা। কিন্তু এমন কাঁটার মুকুট জীবনে পরেননি লিওনেল মেসি!

তখন অবশ্য অতশত না জেনেও একটা পৃথিবী অস্ত যাওয়ার জেরেই তিনি রক্তশূন্য আর চরম অবসাদগ্রস্ত! সরণি বেয়ে ওঠার সময় ভিভিআইপিদের বাড়ানো হাত এড়িয়ে গেলেন। ম্যানুয়েল নয়্যার এবং তিনি পাশাপাশি হেঁটে প্রাইজ নিতে গেলেন। মনে হল নয়্যারকে তিনি চেনেনই না। মাঠে তাঁর সর্ব ক্ষণের প্রহরী সোয়াইনস্টাইগার এসে জড়িয়ে ধরলেন। তাতেও মুখ সেই রক্তশূন্য। দল নিয়ে রানার্স আপের প্রাইজ নিতে যাওয়ার সময়েও মেসিকে মনে হল ঘোরের মধ্যে। যেন নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে চলছেন। গোল্ডেন বল যে জেতে সে ম্যান অব দ্য ম্যাচের মতোই প্রেসের সামনে তিনটে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আসে। মেসি এলেন না।

একমাত্র তখন তাঁর মুখোমুখি হওয়া সম্ভব মিক্সড জোনে। ঘিরে রাখা সেই জায়গাটা যেটাকে অতিক্রম করে প্লেয়াররা হোটেলে ফেরার জন্য বাসে ওঠেন। নিয়ম হল ওখানে সাংবাদিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে প্লেয়ারকে উত্তর দিতেই হবে। স্থানাভাবের ফলে ভারতীয় সাংবাদিকরা সেই মিক্সড জোনের কার্ড গোটা বিশ্বকাপে এক-দু’বারও পায় কি না সন্দেহ! ফাইনালের দিন তো পাওয়ার প্রশ্নই নেই। যে দু’টো দেশ খেলছে, আগে তাদের রিপোর্টার। তার পর ফুটবল-উন্নত দেশগুলোর।


অধরাই থেকে গেল বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন। ছবি: এএফপি

প্রেসরুমের টিভিতে অবশ্য বাসে উঠে যাওয়ার ছবিটা দেখাচ্ছে। আর্জেন্তাইন সাংবাদিকরা ঘিরে ধরেছেন তাঁদের অধিনায়ককে। খেলার প্রথমার্ধে মেসি বমি করা শুরু করেন। সময়-সময় আনফিটও লাগছিল তাঁকে। কিন্তু স্বদেশীয় রিপোর্টারদের কাছে নাকি তিনি কথা বলেছেন এমন এক ব্যক্তির মতো যে কাঁদছে না, কারণ ভেতরে ভেতরে রক্তস্নান করছে বলে। “এই প্রাইজ দিয়ে আমি কী করব? এর কী মূল্য। আমার কাছে কোনও কিছুই আর কোনও সান্ত্বনা নয়,” বলে চলে যাচ্ছিলেন মেসি। সাংবাদিকেরা আবার ডাকায় থমকে বলেছেন, “তিনটে স্পষ্ট সুযোগ। আমি, ইগুয়াইন, রডরিগো। ফাইনালে এর চেয়ে বেশি সুযোগ কোনও দিন আসে?” শুনলাম যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন, “পুরো আর্জেন্তিনা আশা করে বসেছিল। তাদের স্বপ্নে আমরা চুনকালি মাখিয়ে দিলাম।”

যে বার্সিলোনার কথা মাথায় রেখে ঝুঁকি নেবে না, এই যন্ত্রণাকাতর শরীরী ভাষা ও কণ্ঠস্বর কি তার হওয়া সম্ভব?

তবু এ বার বার্সার হয়ে ভাল খেললেও তো অনিবার্য প্রশ্নটা উঠবেই যে, ক্লাবের কথা ভেবে সে দিন মারাকানায় চোটের ঝুঁকি নেননি? প্রতিযোগিতা সেরার পুরস্কার নিয়ে জলঘোলা, সেটা তো থাকলই। মারিও গোটজে অবধি গোল-পরবর্তী হালকা নুন-লঙ্কা ছড়িয়ে দিয়েছেন: আমি জার্মান মেসি নই। জার্মান ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। টুর্নামেন্ট এমন অসাধারণ শুরু করেও নক আউট ম্যাচে গোল নেই। সেমিফাইনাল-ফাইনালে জেতাতে পারেননি দেশকে। লোকে তো কটাক্ষ করবেই।

মেসি-ঘনিষ্ঠ আর্জেন্তিনীয় সাংবাদিক বলছিলেন, “গত পনেরো দিন ধরেই ও যথেষ্ট ফিট নয়। আর টানতে পারছে না। ভেতরে মারাত্মক টাফ বলে টুর্নামেন্টটা শেষ করল। কিন্তু সেটা এখন কে বুঝবে? আর প্রাইজটাও তো নিজে নেয়নি। ওকে বেছেছে ফিফার টেকনিক্যাল গ্রুপ। লিও-র দোষ কোথায়?”

রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রোমো এ দিনই ফিফা সরকারি ভাবে প্রকাশ করল। দেখাল, রাশিয়ানরা বলছে ২০১৮ আমরা তৈরি হচ্ছি। কিন্তু লিওনেল মেসি কী করে তৈরি হবেন? ছ’টা লা লিগা, তিনটে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ যদি বা মধ্যিখানে আরও বাড়ে তখন তো তাঁর বয়স দাঁড়াবে একত্রিশ। ফুটবলারের মাপে প্রৌঢ়ত্বে!

মারাকানা গত কাল এমন গমগমে থাকার পর আজ অনেকটাই অবাধ। খোলামেলা, কার্যত নিঃশব্দ। ভল্যান্টিয়াররা খেলছে। কোনও কোনও দর্শনার্থী ছবি তুলছে সেই গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে যেখানে মারিও গোটজের বাঁ পায়ের নিষ্ঠুর ভলিটা ঢুকে লিওনেল মেসির সম্মান এবং সাফল্য দু’টো পৃথিবীকেই সাময়িক চূর্ণ করে দিয়েছে!

কাল ম্যাচ রিপোর্টে দেখছি বিশ্লেষণটা মারাত্মক ভুল হয়েছিল। মারাকানার ওই আপাত-নিরীহ রূপে কোথায় একটা ছোবল আছে! চৌষট্টি বছর আগে তা নিঃস্ব করে দিয়েছিল বিশ্বসেরা হিসেবে স্বীকৃত একটা ফুটবলার-গোষ্ঠীকে। এ বার ঐতিহ্য রক্ষায় বেছে নিল বিশ্বসেরা ফুটবলারকে।

যে যত বড়, যত প্রসিদ্ধ, মারাকানার হাড়িকাঠ আগে তার রক্ত দেখতে চায়। এটাই কালের নিয়ম। লিওনেল মেসি নিছকই ঘটনাক্রমে এক হতভাগ্যের নাম।

world cup messi marakana gautam bhattacharya rio de generio
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy