Advertisement
E-Paper

এগজিট পোল উল্টে আজি যত কেকেআর তারা তব আকাশে

ইডেন স্কোরকার্ড কী দেখাচ্ছে ভুলে যান! মোটেও ঠিক দেখায়নি। এটা রাজ্যের নির্বাচনও নয় যে, কার্যত দুটো টিমই লড়ছিল—তৃণমূল আর বিজেপি! বিষ্যুদবার রাতে গঙ্গার ধারের আইপিএল ম্যাচটায় গোটা পাঁচেক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কেবল কেকেআর আর আরসিবি নয়। কুড়ি ওভারের দ্রুত ভুলে যাওয়া যায় জাতীয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে তাই বৃহত্তর তাৎপর্যে উন্নীত হয়ে গেল।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৪ ০৩:২৮
নারিনে মত্ত জনজোয়ার। ছবি: উৎপল সরকার।

নারিনে মত্ত জনজোয়ার। ছবি: উৎপল সরকার।

ইডেন স্কোরকার্ড কী দেখাচ্ছে ভুলে যান! মোটেও ঠিক দেখায়নি। এটা রাজ্যের নির্বাচনও নয় যে, কার্যত দুটো টিমই লড়ছিল—তৃণমূল আর বিজেপি! বিষ্যুদবার রাতে গঙ্গার ধারের আইপিএল ম্যাচটায় গোটা পাঁচেক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কেবল কেকেআর আর আরসিবি নয়। কুড়ি ওভারের দ্রুত ভুলে যাওয়া যায় জাতীয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে তাই বৃহত্তর তাৎপর্যে উন্নীত হয়ে গেল।

--রোম্যান্স বনাম মধ্যবিত্ততা

--অফুরান ক্রিকেট বৈভব বনাম ম্যাচ ফর্ম

--কোহলি বনাম ধোনি

--আন্ডারডগ বনাম শাসক

এবং অবশ্যই ক্রোধ বনাম ক্রোধ! গম্ভীর বনাম কোহলি!

এ দিন রাতেও ইউটিউব খুলে দেখছিলাম, আইপিএলের সবচেয়ে বিখ্যাত সেই দ্বন্দ্বযুদ্ধ দেখার জন্য বাষট্টি হাজারেরও বেশি হিট হয়েছে। গত আইপিএলে কোহলি বনাম গম্ভীর। ফুটবল হলে দু’জনকেই লাল কার্ড দেখিয়ে দেওয়ার পরিস্থিতি। মাঠের ঝগড়া পরবর্তী কালে শুধরেছে বলে কেউ শোনেনি। বরং ক্রিকেট মহলের এমনই রটনা যে, ভারতীয় দল থেকে বাইরে থাকার এই সময়টা ধোনির দাক্ষিণ্য যেমন কখনও পাননি কেকেআর অধিনায়ক। তেমনই সহ অধিনায়কের সহানুভুতিও নয়। সব ড্রেসিংরুম গসিপ লেখা যায় না। এটুকু লেখা যায় যে, ইডেন দুই দিল্লিওয়ালার ভয়ঙ্কর ব্যক্তিগত সংঘর্ষ দেখছিল। আর কী ব্যতিক্রমী হয়ে দাঁড়াল তার বিভাজন!

ভারতীয় ক্রিকেটের পয়লা নম্বর পিন-আপ বয়। বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। তিনি কিনা বার্সেলোনাসদৃশ রূপকথার টিম নিয়ে তলিয়ে গেলেন আইপিএল থেকে। আর গরীবগুরবোর নেতা গম্ভীর টানা ছয় ম্যাচ জিতে চলে গেলেন আইপিএল প্লে অফে। আইপিএল শুরু হয়েছিল যাঁর ০, ০, ০, ১ দিয়ে আর প্রথম দিকেই পাঁচটা ম্যাচ হেরে, তাঁর টিম কিনা একটা ম্যাচ বাকি থাকতেই সেমিফাইনালমুখী! অরেঞ্জ ক্যাপ এখন তাঁদের। পার্পল ক্যাপও। অভাবিতভাবে টুর্নামেন্টের ফর্ম টিমও এখন তারা। এসআরকে-র কোনও স্ক্রিপ্ট রাইটার যদি তাঁর জন্য প্রথমার্ধে এত মার আর রক্তপাতের পর ইন্টারভাল-উত্তর এমন মহানাটকীয় প্রত্যাবর্তন রাখেন। নামী সমালোচক অবধারিত রিভিউতে তাকে আরও একটা ‘মশালা ঢিসুম ঢিসুম’ আখ্যা দিতেন..

অথচ জীবন কখনও স্বতঃসিদ্ধ সমাধানকেও রিখটার স্কেলে উল্টে দেয়। এ বারের কেকেআর তার সবচেয়ে বড় মডেল।

সৌরভরা যাঁর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন, ওজনদরে সেই আটলেটিকো মাদ্রিদ? না কি কাগজ কলমের হিসেবে তার চেয়েও নিম্নবিত্ত? নিলাম হওয়া মধ্য ফেব্রুয়ারির বেঙ্গালুরু সন্ধ্যা মনে পড়ছে। শাহরুখের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কর্তা লবিতে দাঁড়িয়ে থাকা কেকেআর মহাকর্তাকে কৌতুকের সঙ্গে বলছিলেন, “বস্ কো ম্যায়নে পুছা, আভি কৌন ব্যাট করেগা? আপ, ম্যায় অউর জয় মেটা?”

নারিন। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

বস অবশ্যই শাহরুখ। তখন আন্দাজও করা যায়নি যে, বসের হয়ে ব্যাট করবেন কোনও এক রবিন উথাপ্পা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বরাবর যিনি চলমান হতাশার প্রতীক। যাঁর মার্কশিটে কখনও ভুগেছেন দ্রাবিড়। কখনও কুম্বলে। কখনও সৌরভ। সাত বছর আগে উথাপ্পা কলকাতা থেকে একটা বিশেষ নোটবই পোর্ট অব স্পেনে আনিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে নিজের অভিজ্ঞতা লিখবেন বলে। এমনই মর্মান্তিক ছিল সেই অভিজ্ঞতা যে, ডায়েরিতে আঁচড় পড়েনি। এর বছর দুয়েক বাদে আরসিবি যখন জোবার্গে ফাইনাল জেতার মতো অবস্থায়, উথাপ্পা চাপ নিতে পারেননি। সর্বশেষ ভুক্তভোগী সৌরভ। পুণের একটা করে ম্যাচ হার সাঙ্গ হত আর উথাপ্পাকে দেখা যেত ম্লান মুখে অধিনায়কের ঘর থেকে বেরোচ্ছেন। বেয়াড়া ছাত্রদের যেমন নিয়ত ‘প্রিন্সিপাল টু সি’ হয়, তেমনই রোজ কৈফিয়ত দিতেন বিশ্রী আউট হওয়ার। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে পিছনে ফেলে তিনি অরেঞ্জ ক্যাপ মাথায় চড়াতে পারেন, এমন উদ্ভট ক্রিকেট এগজিট পোল কোনও চ্যানেল কোথাও দেখায়নি।

কেকেআর কোচিং স্টাফের এক সদস্য বরঞ্চ তাঁর মনোভাবে সমস্যা আছে, এই সব অভিযোগ তুলছিলেন। বারবার অনুরোধ করেও উথাপ্পা ওপেন করতে যেতে পারছিলেন না। শেষমেশ শোনা যায়, তাঁর মুম্বই নিবাসী এক মেন্টর বেঙ্কি মাইসোরকে কাতর অনুরোধ জানান, একটু ভেবে দেখুন। এই ছেলেটা ওপেন করলে অন্য খেলা খেলবে। বাকিটা আইপিএলের ইতিহাস! ইডেন গ্যালারি আগের ম্যাচ থেকেই উ-থা-প্পা, উ-থা-প্পা স্লোগান তুলছে। শনিবার শেষ ম্যাচে অবধারিত বাড়বে। ফিল্ম দুনিয়ায় বলা হয়ে থাকে, একজন নায়ক তখনই সত্যি সত্যি আবির্ভূত হয়, যখন বাজারে তার ডামি বেরোয়। ক্রিকেটেও একজন ক্রিকেটার তখনই আবির্ভূত হয়, যখন গ্যা লারি সবাইকে ছেড়ে তাকে নিয়ে আওয়াজ তোলে।

আরসিবি নিলাম-পরবর্তী সময়ে যদি আবেগের জাঁহাপনা হয়ে থাকে, কেকেআর মার্কামারা শ্রমিক ইউনিয়ন। দক্ষিণ আফ্রিকায় আইপিএল হলে যদি বা তাদের সম্ভাবনা ধরা হচ্ছিল, টুর্নামেন্ট দেশে সরে আসতেই অদৃশ্য এগজিট পোলে তাদের ভোট পার্সেন্টেজও অদৃশ্য হয়ে যায়। কে জানত, চোট থাকা মর্নি মর্কেল ভারতীয় পিচেও ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটারের উপর গতিতে বলই শুধু করবেন না, শর্ট থার্ড ম্যানে কোহলির ক্যাচটা বুফোঁর মতো দুর্ধর্ষ ডাইভ দিয়ে ধরবেন!

চতুর্থ উইকেটে শাকিব আর উথাপ্পার ৭১ বলে ১২১ রানের ওই সোনার পার্টনারশিপের পরেও আরসিবি যে ম্যাচে ছিল। মর্কেলের অসামান্য ক্যাচ তাকে চূড়ান্ত ভাবে ফাঁস পড়াল। তার আগে ক্যাপ্টেন কোহলি একটা অদ্ভুত চাল চেলেছিলেন। যোগেশ টাকাওয়ালেকে দিয়ে ওপেন করিয়ে। এটা ধোনি করে থাকেন। হঠাৎ অখ্যাত প্লেয়ারকে বিশাল দায়িত্বে ছুড়ে দিয়ে। আর তারা পারফর্মও করে দেয়। কিন্তু ওটা ধোনিরই সহ্য হয়, সবার নয়। এই টিমে যেখানে যুবরাজ, ডেভিলিয়ার্স, গেইল আর তিনি নিজে, সেখানে টুর্নামেন্টে ফর্মবিহীন টাকাওয়ালে আগে কেন! তাও ১৯৬ তাড়া করার দিনে। যে দিন হারলেই কিনা নীচে খাদে গিয়ে ডিনার বুফে সাজানো। টাকাওয়ালে যদি সুইসাইড বম্বারই হন, তা হলে ৩৬ বলে খুঁটে খুঁটে ৪৫ করবেন কেন? আজ তো অল আউট অ্যাটাকের দিন ছিল!

কেকেআরের কথা যত লিখছি, তত আশ্চর্য লাগছে। ক্ল্যাসিকাল আন্ডারডগদের এমন সমষ্টি, হারতে হারতে আরও জীর্ণ। তারা হঠাৎ টুর্নামেন্টের মধ্যিখানে ক্যালেন্ডার উল্টে মালিকের নতুন ফিল্মের মতো কী করে বদলে যেতে পারে— হ্যাপি নিউ আইপিএল।

সাকিব আল হাসান যেমন। উথাপ্পার চেয়েও বেশি করে ইডেনের আসল গেমচেঞ্জার। প্রথমে ৩৭ বলে ৬০। তার পর এমন ব্যাটিং লাইন আপের সামনে চার ওভারে দিলেন মাত্র ২৭। অথচ ৬ এপ্রিল মিরপুর রাতের যুবরাজের মতোই সাকিবও টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এক বিখ্যাত কয়েদি! দেশের মিডিয়া, ক্রিকেট মিডিয়া তীব্রতম সমালোচনা করেছিল। জনতা দুরছাই করেছে, কোথায় টেনে তুললে তুমি বাংলাদেশকে। সাকিব ভ্রুক্ষেপ করেননি। অদ্ভুত নির্লিপ্ত চরিত্র। এ দিন আউট হয়ে ফেরার পর এত হাততালির মধ্যেও ব্যাট তুলতে দেখলাম না। না কি আইপিএল ফাইনাল না এলে কয়েদিদের রাজ্যাভিষেক সম্পূর্ণ হবে না?

জেলখানার সেই ভিড়ে সুনীল নারিন অবশ্যই নেই। নাইটরা যা-ই খেলুক, তিনি বরাবরই মুক্ত। নারিনের নতুন কোনও ক্যালেন্ডার বর্ষও আসেনি। একটা বিষাক্ত ওভারের প্রথম বলে শেষ করলেন যুবরাজকে। আর শেষ বলে ডেভিলিয়ার্সকে নিয়ে আরসিবি-র এ বারের মতো রিগর মর্টিস সেট ইন করে দিলেন। বাই বাই আইপিএল। এককালে চন্দ্রশেখরের হাতে ভারত অধিনায়ক বল তুলে দিলে ইডেন যেমন অজানা প্রত্যাশায় রোমাঞ্চিত হয়ে বসত, এখন নারিনের জন্য তা-ই করছে। উইকেট সংখ্যায় শেষ অবধি এক নম্বর থাকুন বা না থাকুন, টুর্নামেন্টের সেরা বোলার তিনিই। তা নিয়ে ভারতের কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজিতেই কোনও দ্বিধা নেই!

কেকেআরের নিলামনীতি নিয়ে যা ভেতর-বাহির সর্বত্র ছিল। বলা হয়েছিল, শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট যেমন হোরেশিওকে বলেছিল, এই স্বর্গে আর মর্ত্যে অনেক কিছু ঘটে, যা অতিবুদ্ধিমানের দর্শন স্বপ্নেও ব্যাখ্যা করতে পারে না। প্লে অফে কেকেআর পৌঁছনোর পর তা-ই মনে হচ্ছে।

এই স্বর্গে আর মর্ত্যে অনেক কিছু ঘটে, যা অতিবুদ্ধিমানের দর্শন স্বপ্নেও ব্যাখ্যা করতে পারে না।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

কলকাতা নাইট রাইডার্স ২০ ওভারে ১৯৫-৪ (উথাপ্পা ৮৩ ন.আ., সাকিব ৬০, স্টার্ক ১-৩২),

রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু ২০ ওভারে ১৬৫-৫ (টাকাওয়ালে ৪৫, নারিন ৪-২০)

ipltag
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy