খাদের কিনারায় চলে গিয়েও প্রাণ ফিরে পাওয়া বা দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সত্ত্বেও লড়াইয়ে ফেরা— এর দৃষ্টান্ত হিসেবে অদূর ভবিষ্যতে যদি কেকেআরের টানা আট ম্যাচ জয়ের অভিযানের কথা তুলে ধরেন কোনও কোচ, তা হলে অবাক হব না। বরং বলব, এটাই হওয়া উচিত। ক্রিকেটের ইতিহাসে কেকেআর এমনই এক মাইলফলক গড়ে দিল।
প্রথম সাতটা ম্যাচের মধ্যে মাত্র দু’টিতে জয়। বাকি আটটার মধ্যে আটায়। নাইটদের এই স্বপ্নের প্রত্যাবর্তনের পিছনে কারণগুলো কী?
দুটো কারণের কথা প্রথমে বলতে চাই। জাক কালিসের সরে দাঁড়ানো আর রবিন উথাপ্পার ওপেনিংয়ে উঠে আসা। আমিরশাহি পর্ব শেষ হওয়ার পর কালিসকে সরিয়ে উথাপ্পাকে ওপেনে নিয়ে আসা হয়। রাঁচিতে চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে উথাপ্পা ওপেন করতে নেমে করে ৩৮ বলে ৪৭। কালিস আসে তিন নম্বরে। ম্যাচটা নাইটরা জিততে পারেনি ঠিকই, কিন্তু প্রত্যাবর্তনের রাস্তায় ওখান থেকেই চলা শুরু।
উথাপ্পার আসল জায়গাটা যে ওপেনিং, এই নিয়ে প্রশ্ন তোলা কখনওই উচিত হয়নি। এই মুহূর্তে যে সেরা স্ট্রাইকার, তাকেই তো ওপেন করতে পাঠানো উচিত। এই সত্যিটা কেকেআর টিম ম্যানেজমেন্টের বুঝতে এত সময় লাগল কেন, কে জানে। তাই বলব, কোটলা নয়, রাঁচি থেকেই নাইটদের আসল লড়াইয়ে ফেরা শুরু।
উথাপ্পার ওপেন করতে যাওয়া দু’ভাবে কাজ করল। এক, কেকেআর-এর শুরুটা ভাল হতে শুরু করল। দুই, গম্ভীরের উপর থেকে চাপ কমিয়ে ওকে রানে ফিরতে সাহায্য করল। আগে যে প্রথম ছ’ওভারে ২৫-৩০-এর বেশি উঠছিল না, এ বার উথাপ্পা এসে যাওয়ায় সেটা ৪৫-৫০ হতে শুরু করল। কালিসের প্রতি একটু অশ্রদ্ধা না দেখিয়েই বলছি, টেস্ট, ওয়ান ডে-তে ও কিংবদন্তি। কিন্তু টি-টোয়েন্টির পক্ষে ও যে মানানসই নয়, এ বারের আইপিএলে সেটা আরও প্রকট হয়ে উঠল। অন্তত এখন তো নয়ই। সে জন্যই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওকে দলে রাখেনি দক্ষিণ আফ্রিকা।
বহু কষ্ট করে একশোর স্ট্রাইক রেট তুলতে হচ্ছিল কালিসকে। আবু ধাবিতে প্রথম ম্যাচে সেই যে ৪৬ বলে ৭২ করল, তার পর থেকে আর ওর স্ট্রাইক রেট তেমন ওঠেনি। সব মিলিয়ে যে সাতটা ইনিংস খেলেছে, তাতে ওর স্ট্রাইক রেট ১১৭। এ জন্যই ক্রমশ ও দলের বোঝা হয়ে উঠছিল। কটকে কালিসের শেষ ম্যাচের পর থেকে তাই নাইটদের ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই।
দলের দু’জন ব্যাটসম্যান যখন দুরন্ত ফর্মে থাকে, তখন অন্যান্য ব্যাটসম্যানের উপরেও যে তার প্রভাব পড়ে, তা নিজের খেলোয়াড় জীবনেও বহু বার দেখেছি আমি। কেকেআরেও সেটাই হল। উথাপ্পা-গম্ভীররা সেরা ফর্মে এসে যাওয়ায় মণীশ, দুশখাতে, সূর্যকুমার যাদবদের মতো তরুণদের উপরও তার প্রভাব পড়ল। ইউসুফ পাঠানই বাকি ছিল, সেও লিগের শেষ ম্যাচে জ্বলে উঠল।
ব্যাটিংটাই শুরুতে ডোবাচ্ছিল নাইটদের, বোলিং নিয়ে কিন্তু তেমন সমস্যা ছিল না। শুধু বিনয় কুমার অতটা ধারালো হয়ে উঠতে পারেনি। তাই যখন উমেশ যাদবকে প্রথম এগারোয় নিয়ে আসা হল, তখন যেমন ওদের পেস বোলিংয়ের ধার আরও বাড়ল, তেমনই নারিন, সাকিবের সঙ্গে চাওলাকে জুড়ে দিয়ে তিন স্পিনারে চলে যাওয়ায় পুরো বোলিং বিভাগটাই আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পঞ্জাব ম্যাচের বোলিং লাইন-আপটার কথা ভাবুন। মর্কেল, উমেশ, নারিন, সাকিব, চাওলা ও দুশখাতে। যে কোনও দলের কাছেই ত্রাস।
কাগজে, ওয়েবসাইটে এ পর্যন্ত কেকেআরের যে ক’জন ক্রিকেটারের সাক্ষাৎকার পড়েছি, তাদের প্রত্যেককেই বলতে শুনেছি, হতাশ না হওয়ার, আত্মবিশ্বাস জিইয়ে রাখার মন্ত্র তাদের জানা ছিল। এই মন্ত্রটা ওদের মধ্যে কে ঢুকিয়েছে, ঠিক জানা নেই। হয় কোচ, নয় ক্যাপ্টেন। হয়তো বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চারিস্ট মাইক হর্নের ভোকাল টনিকেও কাজ হয়েছে কিছুটা। তবে এ সব ক্ষেত্রে কোচ-ক্যাপ্টেনকেই বাড়তি দায়িত্ব নিতে হয়।
আমার বাংলা দলটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে এ প্রসঙ্গে। এ বার রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা খাদের কিনারা থেকে ফিরে শেষ চারে পৌঁছেছিল। আর মনোজ, শামিহীন দলকে চাঙ্গা করার দায়িত্বটা নিতে হয়েছিল আমাকে ও লক্ষ্মীকেই। নাইটদের ক্ষেত্রে সম্ভবত বেইলিস ও গম্ভীরই সমানে মনোবল জোগানোর কাজটা করে গিয়েছে।
গম্ভীর ক্যাপ্টেন হিসেবে আমার কাছে কিন্তু ভালই নম্বর পাবে। সেটা শুধু মাঠের নেতৃত্বের জন্য নয়। ওর ব্যাকরুম প্ল্যানিং এবং ম্যান ম্যানেজমেন্টের জন্যও। এ বারের রঞ্জি ট্রফির মরসুমের কথাই ধরুন। গম্ভীর যে সবার আগে টিমের কথা ভাবে সেটা রঞ্জিতে শুধু দলের কথা ভেবে ওর গ্রিন টপ চাওয়া দেখেই বুঝেছিলাম। ওই সময়ে ভারতীয় দলে ফেরার জন্য ওর প্রচুর রান দরকার। তা সত্ত্বেও শুধু দলের কথা ভেবে ছেলেটা সবুজ উইকেটের জন্য লড়ে যায় সমানে। এই না হলে ক্যাপ্টেন। এ রকম ক্যাপ্টেনই কিন্তু দলের প্লেয়ারদের শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়।
আর এমন অধিনায়কের জন্যই কিন্তু মাঠে একশো দশ ভাগ দিয়ে দেয় ক্রিকেটাররা। যেমন নাইটরা দিচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy