লেখার শুরুতেই একটা কথা পরিষ্কার জানিয়ে রাখি ক্রিকেটের আইপিএলের কায়দায় আমাদের দেশের এই পেশাদার ফুটবল লিগ নিয়ে আমি নৈরাশ্যবাদীদের দলে নেই। বরং এই আইএসএলের হাত ধরে ভারতীয় ফুটবলে আধুনিকতার ছোঁয়া আসবে বলেই আমার ধারণা।
গত পঞ্চাশ বছর ধরে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান, সালগাওকর, ডেম্পো, জেসিটি নিয়ে কচকচি তো অনেক হল। কিন্তু দেশের ফুটবল এগোলো কোথায়? বিগত তিরিশ বছরে ভারতীয় ফুটবলে এমন কোনও যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেনি, যাতে সাবেক সিস্টেমকে আমাদের আঁকড়ে থাকতে হবে! নতুন একটা সিস্টেমকে স্বাগত জানাতে ক্ষতি কী?
আসলে যে পেশাদার মানসিকতা আসার প্রয়োজন ছিল, সেটা ভারতীয় ফুটবলে আসেনি। উল্টে ফেড কাপ, ডুরান্ড, রোভার্স নিয়ে আমরা কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকতে ভালবেসেছি। দেশের ফুটবলে পেশাদারিত্ব আনার জন্য প্রচুর ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হয়েছিল জাতীয় লিগ। সেই লিগও গড়িয়ে গেল প্রায় বিশ বছর। আই লিগ হয়ে দাঁড়িয়েছে কলকাতা, গোয়া, মুম্বই শিলং আর হালফিলে বেঙ্গালুরুর লিগ। বিজয়নের কেরল, ভাইচুংয়ের সিকিম, রেনেডি সিংহের মণিপুর, রহিম সাহেবের হায়দরাবাদ, আমার প্রয়াত বন্ধু জার্নেল সিংহের পঞ্জাবের একটাও দল নেই জাতীয় লিগে। অথচ এই অঞ্চলগুলো ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সাপ্লাই লাইন।
ভারতীয় ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে ফুটবল সংস্কৃতি দরকার। আর কে না জানে, যে কোনও নতুন টুর্নামেন্ট হলে জনসচেতনতা অনেকটাই বাড়ে। আমি তো বলব, এই নতুন পেশাদার লিগটা ঠিকঠাক চললে আমাদের দেশের ফুটবলের ছবিটাই পাল্টে যাবে।
মানছি, মেসি, রোনাল্ডোদের মতো টাটকা তারকারা এই লিগে খেলবে না। কিন্তু ডোয়াইট ইয়র্ক, হের্নান ক্রেসপোদের মতো প্রাক্তন তারকারাও যখন নবি বা মেহরাজদের পাশে খেলবে বা একসঙ্গে অনুশীলন করবে সেটা কিন্তু আমার দেশের ফুটবলার কিংবা কোচদের কাছে একটা মস্ত বড় পাওনা। ক্রিকেটের আইপিএলে যেমন বাংলার মনোজ তিওয়ারি টেকনিক বাড়ানোর জন্য কেভিন পিটারসেনের টিপস পায় দিল্লি ডেয়ারডেভিলসে খেলতে গিয়ে, ঠিক তেমনই।
এতে আমাদের ছেলেদের এক দিকে বাড়বে আত্মবিশ্বাস, আর এক দিকে বাড়বে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। বিজ্ঞানসম্মত ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি ফুটবলারদের হাতে আসবে মোটা অর্থও। এত বছর পরেও মনে আছে, মোহনবাগানে আমার প্রথম দিনটার কথা ক্লাব তাঁবুতে আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড বলাইবাবু (প্রয়াত বলাইদাস চট্টোপাধ্যায়) যখন ‘চাইনিজ ওয়াল’ গোষ্ঠ পালের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন, সে দিন নিজের মনের মধ্যে একটা ভাল পারফর্ম করার বাড়তি তাগিদ আপনাআপনিই অনুভব করেছিলাম। আইএসএলেও কেনি ডালগ্লিশদের সামনে সুনীল ছেত্রীদের ঠিক সে রকম একটা ছবিই যেন দেখতে পাচ্ছি।
রবিবার বিকেলে একটা থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে বিরতিতে অনেককে বলতে শুনলাম, সলমন, রণবীর, জন আব্রাহাম, সচিন, সৌরভ দেখতেই আইএসএলে লোক ভিড় করবে। ফুটবল যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে। আমি যদিও তা মনে করছি না। বরং মনে করি এই ‘স্টার ভ্যালু’টা আমাদের দেশের ফুটবলে ভীষণ ভাবেই দরকার। ক্রিকেটের আইপিএলে শাহরুখকে দেখার জন্য স্টেডিয়াম বাড়তি ভরে উঠছে এই যুক্তি তর্কের খাতিরে না হয় মেনে নিলাম। সঙ্গে এটা তো ঠিক, এই আইপিএলে খেলার সুবাদেই সন্ত্রাস কবলিত কাশ্মীর থেকেও ভারতীয় দলে ক্রিকেটার উঠে আসছে! আইপিএলের আগে কে চিনত পরভেজ রসুলকে? কে-ই বা মনবিন্দর বিসলা বা পল ভালথাটিকে নিয়ে রঞ্জিতে খবর লেখে? ক্রিকেটের মতো ইন্ডিয়ান সুপার লিগও এ রকম অজানা প্রতিভাদের খুঁজে একটা ছাতার তলায় দাঁড় করানোর প্ল্যাটফর্ম হবে বলেই আমার ধারণা।
আর শহরভিত্তিক টুর্নামেন্ট হওয়ায় একটা উন্মাদনা তো থাকবেই। যেহেতু এই লিগ পেশাদার মানসিকতা নিয়ে বিপণনে নামবে, ফলে ক্যাচমেন্ট এরিয়া থেকে নতুন প্রতিভা তুলে আনার জন্য স্কাউটিংয়ের কাজটাও হবে পুরোদমে। যেখানে টিমগুলোর পরিচালনায় পেশাদার লোকজনেরা রয়েছে, সেখানে আশা রাখতেই পারি।
এখন বলতে পারেন, গোটা বিশ্ব জুড়ে ফুটবলে যে ম্যাচ গড়াপেটার খবর রোজ পাচ্ছি সেই ভাইরাসের সংক্রমণ এই লিগের সুবাদে আমার দেশে এসে পড়বে না তো? আমি এখানেও ব্যাপারটা ইতিবাচক ভাবেই দেখছি। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সম্ভাবনা নেই তা বলব না। কিন্তু সেটা দেখার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে প্রশাসনকে। তারা কঠোর এবং স্বচ্ছ হলেই এই সংক্রমণ রুখে দেওয়া যায়।
সব শেষে আরও একটা কথা। ষোলোটা কর্পোরেট সংস্থা নিলামে অংশ নিয়েছিল। অর্থাৎ আটটা সংস্থা কিন্তু বাদ গিয়েছে। এ বার ভারতীয় ফুটবলের মূলস্রোতে থাকার জন্য সেই সংস্থাগুলো যদি আই লিগের দল কিনতে ঝাঁপায়, তা হলেও লাভ ভারতীয় ফুটবলের। আর ফেডারেশন তো বলেই দিয়েছে বেঙ্গালুরু এফসি-র মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি দল আই লিগে আরও বাড়ানোর জন্য তাদের চিন্তা ভাবনা চলছে পুরোদমে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy