Advertisement
১৬ মে ২০২৪

চারটে ভাল দিনে পঁচাশির সেই রাত ফেরাতে চায় ভারত

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে চূড়ান্ত সফল ভারত অধিনায়কত্ব ছাড়া আর মিল কী? হাতে গরম মিল, দু’জনের কারওরই অস্ট্রেলিয়া থেকে নিউজিল্যান্ড উড়ে এসে ভাল ঘুম হচ্ছে না। বুধবার দুপুরে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের কমেন্ট্রি দিতে ওয়েলিংটন উড়ে যাওয়ার আগে সৌরভ বলছিলেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে এ দেশে আসার পর তাঁর ঘুমই হচ্ছে না।

গৌতম ভট্টাচার্য
অকল্যান্ড শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৫ ০৪:০০
Share: Save:

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে চূড়ান্ত সফল ভারত অধিনায়কত্ব ছাড়া আর মিল কী?

হাতে গরম মিল, দু’জনের কারওরই অস্ট্রেলিয়া থেকে নিউজিল্যান্ড উড়ে এসে ভাল ঘুম হচ্ছে না। বুধবার দুপুরে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের কমেন্ট্রি দিতে ওয়েলিংটন উড়ে যাওয়ার আগে সৌরভ বলছিলেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে এ দেশে আসার পর তাঁর ঘুমই হচ্ছে না। হ্যামিল্টন বিমানবন্দরে অপেক্ষমান সৌরভের দ্রুতই মনে পড়ল যে, জীবনে একবারই স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়েছেন। সেটা এই নিউজিল্যান্ডে এসে। টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগের দিন রাত দু’টো অবধি ঘুম আসছে না দেখে বাধ্য হয়ে ওটা খেতে হয়েছিল।

এ দিন অকল্যান্ড পৌঁছনো ভারত অধিনায়কেরও নাকি তাই অবস্থা। দু’টো দেশের মধ্যে টাইম ডিফারেন্স, বিমানযাত্রার ধকল, আবহাওয়ার পরিবর্তন সব মিলে এমন অবস্থা যে ধোনি সহ গোটা টিমেরই অস্থির অস্থির হচ্ছে। টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী বলছিলেন, “ভাগ্যিস পরের ম্যাচের আগে গ্যাপ আছে। শনিবারের মধ্যে সামলে নেব। নইলে নিউজিল্যান্ড এসে বিশ্রাম পাওয়াটাই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।” বিশ্রামের অভাব বোধ করতে থাকা টিম এ দিন প্র্যাকটিস করা দূরে থাক, শুনলাম কালকেও করবে না।

তা-ও ধোনিরা সেই ভয়াবহ সরু প্লেনটা করে এ দিন হ্যামিল্টন থেকে অকল্যান্ড আসেননি যেটায় চাপলে ঘুম কম নয়, চিরঘুমের ভীতি এসে যেতে পারে। উনিশ সিটারের এই প্লেনে এ দিন উঠতে গিয়ে দেখলাম বিমানবন্দরে কোনও সিকিওরিটি চেক অবধি হল না। এই যুগে যাত্রীরা সিকিওরিটি চেক না করিয়ে বিমানে উঠে যেতে পারছেন, কল্পনাতীত। তার চেয়েও আশ্চর্য ককপিট খোলা। প্লেন হাওয়ায় তীব্র ঘুরপাক খাওয়ার সময় দুই পাইলটের মুখভঙ্গী এবং দ্রুত কর্মপদ্ধতি যাত্রীরা দেখতেই পাচ্ছেন। আদতে প্লেন হয়েও ওটাকে হ্যামিল্টন-অকল্যান্ড হেলিকপ্টার সার্ভিসই বলা উচিত! এ হেন উড়ানযাত্রায় কিছু ভারতীয় সমর্থকের সাক্ষাত্‌ পাওয়া গেল যাঁর মাঝআকাশে ভয়ের দু’চারটে মুহূর্ত ছাড়া সবিস্তারে বলছিলেন, পয়সা উসুল।

অকল্যান্ডের রাস্তাতেও রাতে কিছু বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমীর সাক্ষাত্‌ পাওয়া গেল যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের জেলা শহর থেকে এসেছেন এবং টিম ইন্ডিয়ার খেলা দেখে একই রকম আলোড়িত। কেউ আসানসোলের। কেউ শিলিগুড়ির। কেউ নৈহাটির। কাল ধোনি বলছিলেন, ভারতীয় সমর্থকদের সমর্থনের উত্তাপটা ছেলেদের ভীষণ মোটিভেট করছে। বোধহয় ঠিকই বলছিলেন।

বিরানব্বইয়ের অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে দেখেছি গোছা গোছা চিঠি ভারতীয় সমর্থকেরা পাঠিয়েছেন আর সেগুলোকে পোস্টঅফিসের মতো একটা বস্তা থেকে খুলে অধিনায়ক আজহারউদ্দিনের দিকে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তেইশ বছর পর চিঠির কোনও কাহিনি নেই। সমর্থকেরা নিজেরাই তো সশরীরে চলে আসছেন। পর্যটন সংস্থার লোকজন বলছিলেন, গড়পড়তা ভারতীয়র মধ্যে এখন বিদেশ যাওয়ার চল অনেক বেশি। তাই অন্য গোলার্ধে বিশ্বকাপ হলেও প্রতি ম্যাচেই অনাবাসী দর্শকের বাইরেও টিম এমন ভারতবাসীর প্রত্যক্ষ সমর্থন পাচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় নিউজিল্যান্ড অনেক বেশি বিশ্বকাপ নিয়ে আহ্লাদিত। রাস্তায় রাস্তায় বিশ্বকাপের ছবি। কোনও কোনও জায়গায় তো বড় স্ক্রিন লাগানো। অকল্যান্ড ওয়াটারফ্রন্টের কাছে একটা হুকাবারের সামনে দেখছিলাম, রাতে টিভি চলছে আর লোকে ভিড় করে সঙ্গকারার সেঞ্চুরি দেখছে। একটু এগিয়ে কাস্টমস স্ট্রিট। অকল্যান্ড বন্দরের এক রকম উল্টো খুব সুদৃশ্য জায়গা হলেও কাস্টমস স্ট্রিট মূলত ব্যবসাকেন্দ্রিক জায়গা। ব্যাঙ্ক, মানিচেঞ্জার, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এই সবে ভর্তি। সেই এলাকাতেও দেখলাম, ক্রিকেটের রমরমা। খেলার দোকানে নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত অল ব্ল্যাক জার্সি বিক্রি না করে ম্যাকালামদের বিশ্বকাপ ক্রিকেট টিমের ক্যাপ আর জার্সি ডিসপ্লেতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এমন আশ্চর্য ঘটনা রিচার্ড হ্যাডলির সেরা সময়ও নিশ্চয়ই হয়নি।

একটু এগিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিছু ভারত সমর্থক। পিছনে লেখা নম্বর ১৮ কোহলি। অকল্যান্ডের বিশ্ববিখ্যাত স্কাইটাওয়ার খুব কাছে দেখাই যাচ্ছে। টিম হোটেলও আশেপাশে কি না, খোঁজ নেওয়া হল না। আন্দাজ করছি এঁরা হয়তো ও দিকটা ঘুরেই এলেন। এঁরা অবশ্য অকল্যান্ডবাসী এবং গাড়ি চালিয়ে দেড়-দেড় তিন ঘণ্টা শুধু রাস্তায় খরচা করে ম্যাচ দেখতে গেছিলেন। আবার অকল্যান্ডেই ক্রিকেটউত্‌সাহী ট্যাক্সি ড্রাইভার পাওয়া গেল যিনি হ্যামিল্টন গেলেও শনিবার ইডেন পার্কে জিম্বাবোয়ে ম্যাচের টিকিট এখনও কাটেননি। ও দিন নাকি বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।

এদের সকলেরই কমন ফ্যাক্টর— সবাই নিখাদ কোহলি ভক্ত। শিখর ধবন কাল সেঞ্চুরি করলেও অপরাজিত ৪৪ রানে চোখ টেনেছেন বেশি কোহলি। শাস্ত্রী এ দিন গড়পড়তা ক্রিকেটউত্‌সাহীর মতো অপার বিস্ময় নিয়ে বললেন, “কয়েকটা ড্রাইভ আর স্কোয়ার কাট মারল দেখলেন! শট এবং এই অ্যাটিটিউড মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে!” শাস্ত্রী মনে করেন, অবসর নেওয়ার পর ওয়ান ডে প্লেয়ার হিসেবে বিরাটের নাম ভিভ-সচিনদের সঙ্গেই এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ হবে!

কোহলি না হয় বোঝা গেল। কিন্তু শনিবারের বৃষ্টির পূর্বাভাস? এখানে লোকে তো প্রায় সেই সব পূর্বাভাসকে ভ্যাটিক্যানের বাণী হিসেবে মানে। শাস্ত্রী বললেন, “বৃষ্টি আমাদের হাতে নেই। আমাদের হাতে আছে আর চারটে সুন্দর দিনের জন্য প্রার্থনা করে যাওয়া। অকল্যান্ড আর তার পর তিন দিন যে ঈশ্বর হঠাত্‌ করে বিগড়ে যেও না।” মেলবোর্নে তাঁর অডি জেতার তিরিশ বছর পূর্তি হল মঙ্গলবার। শাস্ত্রী ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার সেই রাত রোমন্থন করতে করতে বলছিলেন, “সেই মেলবোর্নে এরাও যদি রাতটা ফিরিয়ে আনতে পারে কী দারুণ হয়!”

শিখর ধবন এবং কোহলি যখন ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজের সময় ব্যর্থতার সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে হেঁটেই চলছিলেন, তখন থেকে তাঁদের পাশে শাস্ত্রী। বিশ্বকাপের শুরুর দিকে চাপের সময় এঁদের পাশে থাকা নিয়ে খুশিতে ভরা আলোচনাও করেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। কিন্তু এখন তো ওই দুটো যুদ্ধ জেতা হয়ে গিয়েছে। আর বেশি ঘাঁটার তাই ইচ্ছে আছে বলে মনে হল না। বরং ভারতীয় টিম ডিরেক্টরের নতুন প্রোজেক্ট মহম্মদ শামি। গত ক’দিন ধরেই বলে যাচ্ছেন শামি হলেন বাংলার নবাব। সিরাজদৌল্লার পর প্রথম এহেন উপাধিতে ভূষিত হওয়া শামির তাগড়াই লড়াইতে নাকি টিম ম্যানেজমেন্ট উচ্ছ্বসিত। বিশেষ করে চোট পাওয়ার পরেও তাঁর ফিরে আসার মনন দেখে!

কারও কারও মনে হচ্ছে এই যে একই গতিতে বয়েই চলেছে ভারতের বিজয়তরণী, একটা ধাক্কা প্রাথমিক পর্যায়ে এলে আশীর্বাদ হত। কিছু খুঁত থেকে গেলে কঠোর স্ক্যান রিপোর্ট ধরিয়ে দেবে সটান। শাস্ত্রী বা তাঁর টিম সে ভাবে ভাবছেই না। তাঁদের চিন্তা একটা সরল লাইনে নেমে এসেছে— আর চারটে ভাল দিন!

বাংলাদেশ এমসিজিতে সামনে পড়লে ভারত তাদের নিয়ে বিরাট ভাবিত হবে বলে মনে হল না। শাস্ত্রী বরং বারবার করে বলছিলেন, “খুব মারাত্মক টিম হল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওরা যে দিন ক্লিক করবে ফেভারিটদেরও কাঁদিয়ে দিতে পারে।” বাংলাদেশ? শাস্ত্রী তেমন কিছু বললেন না।

বাংলাদেশ শিবির অবশ্য এখন এমন তুরীয় মেজাজে যে, শাস্ত্রীয় ভাবনায় তাদের কিছু আসে যায় না। তিনটে ম্যাচ জিতে তারা এমন টগবগ করছে যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ হিশ্বকাপের সময়ও করেনি।

বুধবার সাইমন ডুল বলছিলেন, “বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের সামনে পরশু দিন কিছু করতে পারবে না। এই উইকেটে ওদের স্পিন কাজ করবে না। আমার তাই একটাই প্রশ্ন নিউজিল্যান্ড এমনি জিতবে, না মাস্তানি করে জিতবে?”

ডুলের এই বিপরীতমুখী কথাবার্তা পাত্তা দিতেই রাজি নয় বাংলাদেশ। এ দিন সঙ্গকারার টানা চার নম্বর সেঞ্চুরির ওপর ভর করে শ্রীলঙ্কা জিতে যাওয়ায় বাংলাদেশের গ্রুপ থেকে চতুর্থ হওয়ার সম্ভাবনাটাই থেকে গেল। মানে মেলবোর্নে ভারতের সামনে পড়ার। বাংলাদেশ টিম অবশ্য এখনও তৃতীয় হওয়াকেই পাখির চোখ রেখেছে। টিমের জনৈক কর্মকর্তা রাতে এবিপিকে বললেন, “চাপ পুরোটাই তো নিউজিল্যান্ডের ওপর। সবাই ধরে নিয়েছে ওরা জিতবে। অথচ ওদের-আমাদের শেষ সাত ওয়ান ডে-র রেকর্ড হল আমাদের পক্ষে ৭-০। সাতটাই আমাদের দেশে তো কী— রেকর্ডের একটা ভার তো বইতে হবে।”

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

ধোনির ইন্ডিয়া এই সব আলোচনায় মন দেওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ দেখছে না। তাদের মনোভাব হল, বিপক্ষ ঠিক করা তো আমাদের হাতে নয়। ওটা নিয়ে ভেবে কী করব? আমাদের কাজ যারা সামনে পড়বে, তাদের হারাও।

বহু বছর পর কোনও ভারতীয় দল এই ভঙ্গিতে ভাবছে বা কথা বলছে। যা দু’বছর আগে বিলেতের মাঠে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার সময়ও দেখা যায়নি। শনিবার বৃষ্টি হয়ে একটা সুন্দর দিন চাহিদা থেকে কমে গেলেও কিছু আসে যায় না।

ধোনির নিট চাহিদা যা তাতে থাকলেই তো হয়! একটা দিন যদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেনে শনিবার ধুইয়েও দেয়, পরের তিনটে ভাল দিন পেলেই তো চলছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

world cup 2015 gautam bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE