Advertisement
E-Paper

জন্মদিনটা নিজের দেশেই যেন কাটল লিও মেসির

পোর্তো আলেগ্রে হল ব্রাজিলের কন্যাকুমারিকা! একেবারে দক্ষিণ বিন্দুর ওপর বসা টিপের মতো। তার শুধু কোনও ভারত মহাসাগর নেই। আছে সমুদ্র-সদৃশ বিশাল এক নদী। যার ধারটা বিচের মতো ব্যবহার করেন স্থানীয়রা। গোটা ব্রাজিলের মধ্যে জীবনযাত্রার মান এখানে সবচেয়ে উঁচু। সাদা বাংলায় রিওয় যেটা পঞ্চাশ ডলারে পাবেন, সেটা এখানে চোখ বুজে পঁচাত্তর! আরও একটা বৈশিষ্ট ব্রাজিলীয় এই শহরের রয়েছে, যা গোটা দেশেরই নেই।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৪ ০৩:১০
জন্মদিনে নায়কের জন্য অপেক্ষা। পোর্তো আলেগ্রেতে।

জন্মদিনে নায়কের জন্য অপেক্ষা। পোর্তো আলেগ্রেতে।

পোর্তো আলেগ্রে হল ব্রাজিলের কন্যাকুমারিকা! একেবারে দক্ষিণ বিন্দুর ওপর বসা টিপের মতো।

তার শুধু কোনও ভারত মহাসাগর নেই। আছে সমুদ্র-সদৃশ বিশাল এক নদী। যার ধারটা বিচের মতো ব্যবহার করেন স্থানীয়রা। গোটা ব্রাজিলের মধ্যে জীবনযাত্রার মান এখানে সবচেয়ে উঁচু। সাদা বাংলায় রিওয় যেটা পঞ্চাশ ডলারে পাবেন, সেটা এখানে চোখ বুজে পঁচাত্তর! আরও একটা বৈশিষ্ট ব্রাজিলীয় এই শহরের রয়েছে, যা গোটা দেশেরই নেই।

পোর্তো আলেগ্রে বলে ব্রাজিলের একটা অদ্ভুত জায়গা আছে যেখানে বরফও পড়ে মাঝেমধ্যে, এটা নিশ্চয়ই লালমোহনবাবু বেঁচে থাকলে কোনও না কোনও দিন শুনতেন ফেলুদার কাছে!

জুনের শেষে সেখানে বরফের কাহিনি নেই, কিন্তু কনকনে ভাবটা বিস্তর। সেটা বোধহয় হাড়ে আরও জানান দিত ব্রাজিলের এই দক্ষিণ দেশে কোনও এক লিওনেল মেসির উপস্থিতি না থাকলে! এমনিতেই পোর্তো আলেগ্রে হল ব্রাজিলের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী প্রদেশ। যার আগে ঠেকাঠেকি করে রয়েছে এক দিকে উরুগুয়ে, এক দিকে আর্জেন্তিনা। বুয়েনস আইরেস থেকে পোর্তো আলেগ্রে প্রায় কলকাতা-আগরতলা করার মতো ব্যাপার!

আর্জেন্তিনার অনেক গরিবগুর্বো সমর্থক রয়েছে, যাদের প্লেনে লম্বা জার্নি করে ব্রাজিলের দূর-দূর খেলা দেখতে আসার সঙ্গতি নেই। কিন্তু পোর্তো আলেগ্রে তো বলতে গেলে নিজের পাড়া। তা-ও আবার তাদের ভালবাসার রাজকুমারের জন্মদিনে থাকা যাচ্ছে। প্লাস বুধবার দুপুরে নাইজিরিয়া ম্যাচ দেখে রাত্তিরেই দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ। কেউ ছাড়ে! ফিফার এক কর্তা ব্রাসিলিয়ার বিমানবন্দরেই হুঁশিয়ার করে দিলেন, “সকাল থেকে পোর্তো আলেগ্রের যা খবর পাচ্ছি, ব্রাজিলের ভূখণ্ড আর্জেন্তিনা এক রকম নিয়ে নিয়েছে।”

বিশেষ গ্রিটিং কার্ডও বেরিয়েছে বার্থডে বয়কে সম্মান জানাতে। মঙ্গলবার সকালেও ব্রাসিলিয়া বিমানবন্দরের দোকানগুলোয় দেখছিলাম প্রথম পাতায় রোনাল্ডোর বড় ছবি দিয়ে লেখা। কী লেখা, এক জন পাশ থেকে অনুবাদ করে দিলেন, প্লে-বয় গো হোম। একই দিনে লিওনেল মেসি যখন ব্রাজিলেও আদরের বার্থডে বয় হিসেবে বন্দিত হচ্ছেন, সেই একই দিন রোনাল্ডোর রকস্টার ইমেজকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁকে প্লে-বয় বলে কটাক্ষ করছে।

বিমানবন্দরের সামনে একটা কোচ থেকে নামলেন কার্লোস রবার্তো গালো। ইনি সক্রেটিসের বিরাশির ব্রাজিল টিমে ছিলেন। এখন এ দেশের নামী ভাষ্যকার। লম্বা পেটানো চেহারা। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। হাতে উল্কি করে ‘কার্লোস’ লেখা। ফিফা প্রতিনিধি তাঁকে দেখতে পেয়ে বলেন, মারাদোনার কাণ্ডটা সে দিন দেখলে? কার্লোস পর্তুগিজে কী একটা উত্তর দিলেন স্বদেশীয়কে, বুঝলাম না। চলে গেলেন চেক-ইন করতে। ব্রাজিলীয় ফুটবল ফেডারেশনের মাধ্যমে ফিফা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি তখন গজগজ করছেন, “মানছি তুমি অসাধারণ ফুটবলার ছিলে। তা বলে এত অসভ্যতা করবে কেন? মারাকানায় যে গেটটা দিয়ে তোমার ঢোকার কথা, সেখান থেকে তোমাকে যেখানে আটকানো হয়েছিল মাত্র পাঁচ মিটার কি না সন্দেহ। কেন তুমি বুঝবে না যে, ওই গেটটাই তোমার, প্লেয়ারদের গেটটা নয়! এমন দম্ভ তোমার যে, ওই গেট দিয়ে যখন ঢুকতে দেওয়া হল না, তুমি বেরিয়ে চলে গেলে। আর তার পর গালাগাল দিলে ফিফাকে।”


‘বার্থ ডে স্পেশ্যাল’ বুট পরে মঙ্গলবার প্র্যাকটিসে মেসি।

কর্তাটি এ বার গলা নামিয়ে বলেন, “ঘটনার সারমর্ম একটাই যে, তুমি তিন নম্বর। এক পেলে। দুই জিকো। তার পর তুমি। ড্রাগ না ধরলে তুমি পেলেকে নিশ্চয়ই হারাতে পারতে। কিন্তু পারোনি এটাই রেকর্ডে রয়েছে।” দেখলাম মারাদোনার ওপর বিস্তর ক্ষোভ। “এখানে এসে দুটো হোটেল ভাড়া করেছে। একটায় আছে পরিবার। একটায় বান্ধবীরা। এক বার এখানে যাচ্ছে। এক বার ওটায় গিয়ে রাত কাটিয়ে আসছে।” তিনি কি জানেন মেসির আজ জন্মদিন? বলেন, “নিশ্চয়ই। ফিফা তো ওকে শুভেচ্ছাও জানিয়েছে সকাল-সকাল।” এর পর বললেন, “এই হল ফুটবলার। আমার ধারণা ও পেলের পরেই চলে আসবে। রোনাল্ডোর মতো উদ্ধত নয়। আসে, খেলে, চলে যায়। অসাধারণ। প্লেয়ার এমনই হওয়া উচিত।”

যা নির্যাস পেলাম ব্রাজিল আসা ইস্তক দেখছি। হলুদ জার্সির বিরুদ্ধে মেসির দাঁড়ানোটা যাদের কাছে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের, তারাও মনে মনে মেসি মানুষটাকে পছন্দ করেন। তাঁর ফুটবল প্রতিভাকে বুক ঠুকে সার্টিফিকেট দেন। ব্রাজিল ফুটবল সমাজেরই যেখানে নীরব অনুমোদন রয়েছে, সেখানে আর্জেন্টাইন ফুটবল ভক্তদের তাঁকে নিয়ে কী উদ্দীপনা থাকতে পারে, সহজবোধ্য। সুরকার শান্তনু মৈত্র কাল ব্রাসিলিয়ায় ব্রাজিল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি আর পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী বিশ্বকাপের খেলা দেখে বেড়াচ্ছেন। তা শান্তনুর ব্রাজিলীয় সমর্থকদের সুর করে পরের পর গান দেখে অবিশ্বাস্য লেগেছে। “একটা মোটিভেশন নিয়ে এখান থেকে ফিরব যে, আমাকেও এক দিন এ রকম সুরেলা গান লিখতে হবে যা গোটা জাতিকে একসঙ্গে নাড়িয়ে দেবে।”

কিন্তু শান্তনু তো এখনও আর্জেন্তিনা দেখেননি। দেখলে বুঝতেন ভিনদেশে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে এসেও এরা কত চিত্তাকর্ষক, আমুদে এবং একই সঙ্গে মারকুটে হতে পারে।

আর্জেন্তিনার আগের ম্যাচে ইরান যখন প্রচণ্ড লড়াই করছে, গ্যালারির এক অংশ হঠাৎই ‘ওলে ওলে ইরান’ শুরু করে দিয়েছিল। সেটা চলছিল দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে। মেসির গোল হতেই আর্জেন্তিনার তীব্র চিৎকারে সে সব ধুয়ে দেয়। আর তার পর থেকে পোর্তো আলেগ্রে শহর ব্রাজিলের রাস্তায়-রাস্তায় তাদের সমর্থক বাহিনী এখন সুর করে গাইছে আর নাচছে। পোর্তো আলেগ্রে হল ব্যারেটোর বাড়ি। কে বলতে পারে, ব্যারেটোর বাড়ির বাইরেও সেই আর্জেন্তিনীয় কবিয়ালদের ব্যান্ড পার্টি নাচছে না আর গাইছে না... ওই গানটা যাকে তারা নাম দিয়েছে, ব্যাড মুন রাইজিং। আকাশে অশুভ চাঁদের উদয়।

এদের গানের লাইনগুলোর মানে খেউড়ের কাছাকাছি বঙ্গানুবাদ করে দিলাম:

ব্রাজিল বলো তো ভাই, এখন কেমন লাগছে/ তোমাদের বাবা যে তোমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে/ শপথ করে বলতে পারি এতগুলো বছর পরেও/ তোমরা ভোলোনি/ দিয়েগো কী ভাবে ড্রিবল করেছিল/ ক্যানিজিয়া তার পর সূঁচটা কেমন ঢুকিয়ে দিয়েছিল/ সে দিন থেকে আজ অবধি তোমরা কেবল কেঁদেই চলেছ/ এ বার দেখছ মেসিকে/ কাপটা যে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছে/ কারণ মারাদোনা যে পেলের চেয়েও বড় রে ভাই!

ব্রাজিলীয়রা শুনলাম পাল্টা গান বাঁধছেন। এ যেন ভোলা ময়রা আর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির ফুটবল-কবিতার লড়াই! কিন্তু যত দিন না ব্রাজিলীয়দের প্রত্যুত্তরের গানটা বাজারে আসে, ব্রাজিলের দক্ষিণ ভূখণ্ড শুধু নীলে ভরা। তার ওপর কেবল জন্মদিনের একটা লাল গোলাপ আর সাতাশটা মোমবাতি। কালকের ম্যাচ জেতাটাও জরুরি হঠাৎ উদ্দীপিত ফ্রান্সকে দ্বিতীয় রাউন্ডে এড়াবার জন্য। সুইৎজারল্যান্ড বা হন্ডুরাস পড়লে জন্মদিনের পার্টিটা এক সপ্তাহ চালানো যেতে পারে।

কিন্তু খেলার এ সব কচকচি সার্বিক বিচারে এই মুহূর্তে ব্রাজিলের দক্ষিণতম ভূখণ্ডে মূল্যহীন।

অনেক জরুরি কথা হল লিওনেল মেসি তাঁর নিজের সাম্রাজ্যে সাতাশতম জন্মদিনের দ্বিতীয় দিনটা কাটাবেন।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

ছবি: এএফপি

fifaworldcup gautam bhattacharya brasilia messi birthday
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy