Advertisement
E-Paper

নাটকীয় ভাবে মন্ত্রী খুইয়ে ধ্বস্ত শ্রীনির চোখ মাটিতে

ফোন কানে দৌড়োদৌড়ি করছেন অনবরত। পার্ক শেরাটন লবিতে চেনা কাউকে পেলেই পাকড়াচ্ছেন ভদ্রলোক। সে সাংবাদিক হতে পারে। বোর্ড কর্তা হতে পারে। বিহ্বল পূর্বাঞ্চলীয় কর্তার উত্তেজিত প্রশ্নটা শুধু কমন— ক্রস ভোটিংটা করল কোন কোন ব্যাটাচ্ছেলে? কাশ্মীরের ‘বিভীষণ’ আছে তো নিশ্চিত। কিন্তু সঙ্গেরটা? শোনা যাচ্ছে, সেটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৬
নির্বাচনে পর্যুদস্ত শ্রীনিবাসন। সোমবার চেন্নাইয়ে। ছবি: পিটিআই

নির্বাচনে পর্যুদস্ত শ্রীনিবাসন। সোমবার চেন্নাইয়ে। ছবি: পিটিআই

ফোন কানে দৌড়োদৌড়ি করছেন অনবরত। পার্ক শেরাটন লবিতে চেনা কাউকে পেলেই পাকড়াচ্ছেন ভদ্রলোক। সে সাংবাদিক হতে পারে। বোর্ড কর্তা হতে পারে। বিহ্বল পূর্বাঞ্চলীয় কর্তার উত্তেজিত প্রশ্নটা শুধু কমন— ক্রস ভোটিংটা করল কোন কোন ব্যাটাচ্ছেলে? কাশ্মীরের ‘বিভীষণ’ আছে তো নিশ্চিত। কিন্তু সঙ্গেরটা? শোনা যাচ্ছে, সেটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের।

অনুরাগ ঠাকুর এতক্ষণ খুব ভাল ভাল কথা বলছিলেন। বোর্ড সচিব হিসেবে নির্বাচিত প্যানেলের সই করা প্রিন্টআউট একটু আগে ধরিয়েছেন দেশজ মিডিয়াকে। ‘এখন থেকে টিমগেম’, ‘ক্রিকেটের উপর দেশবাসীর বিশ্বাস ফেরাতে হবে’ জাতীয় সুমধুর কথাবার্তা শুনতে শুনতে ভিড় থেকে আচমকা উড়ে এল প্রশ্নটা আর মুহূর্তে গলার স্বরের পরিবর্তন ও আসল অনুরাগের প্রত্যাবর্তন! ডালমিয়া বোর্ড প্রেসিডেন্ট হলেন। কিন্তু শ্রীনিবাসন কেন আইসিসি নমিনি? নিয়ম মতো তো ডালমিয়ারই যাওয়া উচিত। “ছ’টা মাস দেখুন। এই সিদ্ধান্তটা আগামী সেপ্টেম্বরের এজিএম পর্যন্ত বহাল থাকছে!” উত্তর সংক্ষিপ্ত। ইঙ্গিত? জোরালো, বেশ জোরালো।

বছর সত্তরের বেঁটেখাটো চেহারাটা বেরোল যখন বিকেল সাড়ে চারটে। এত দিনের জাঁদরেল প্রশাসক আজ কোথায়? এ তো সর্বস্বান্ত হওয়া ন্যুব্জ পরাজয়ের প্রতীক! চোখ মাটি থেকে উঠছে না, চার দিকে দেখছে না, মিডিয়ার প্রশ্ন কানে ঢুকছে না, অনুগামী পরিবৃত অবসন্ন শরীর শুধু কোনও মতে গাড়িতে উঠে পার্ক শেরাটন ছাড়ছে! বললেও আজ আর কী বলতেন নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন? বলতেন, নিজের শহরে আজ আমি হেরে গিয়েছি?

ভুল হল। নির্বাক সাড়ে চারটেয় নয়, তিনি হয়ে গিয়েছিলেন তারও ঘণ্টা চারেক আগে। সুপ্রিম কোর্ট শ্রীনিকে ভোটাধিকারের বাইরে নির্বাচন টেবলে আর কিছু বরাদ্দ রাখেনি। বোর্ডরুমের বাইরে সাড়ে ন’টা থেকে বসেছিলেন শ্রীনি। কত প্ল্যান, পওয়ারদের কত প্রতিআক্রমণের ছক— সবই তো এক নিমেষে নিক্ষিপ্ত ভারত মহাসাগরের অতলে।

অনুরাগ ঠাকুর— ১৫। সঞ্জয় পটেল— ১৪। ভোট ভেঙেছে, পাশা উল্টেছে, দুর্গ তাঁর আজ খানখান। নির্বাচনী শক্ কাটাতে তো বার্ষিক সভা মাঝে বন্ধই রাখতে হয় এক ঘণ্টা!

শ্রীনির অবস্থার কথা দুপুরের দিকে বেশ রসিয়ে উপভোগ করছিলেন পওয়ার শিবিরের এক কর্তা। বললেন, “ও তো জানতই না গত রাতেই খেলাটা ঘুরে গিয়েছে। পঞ্জাবের পাণ্ডবকে আমরা এমনি এমনি তুলে নিয়েছিলাম নাকি?” সত্যি হলে, স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো স্ট্র্যাটেজি। পওয়ারদের দাবি ধরলে শ্রীনি যাঁকে উত্তরাঞ্চল থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করেছিলেন, সেই এমএল নেহরু নাকি আসলে ছিলেন বিরোধী পক্ষের! পওয়ার-গ্রুপের। অনুরাগ-ম্যাচ বার করতে তাঁকে নাকি রাজনৈতিক শীর্ষমহল থেকে বলে দেওয়া হয়, আপনি ভোটটা পওয়ার-প্রার্থী অনুরাগকে দেবেন। শ্রীনি-প্রার্থী সঞ্জয় পটেলকে নয়। নেহরু মেনে নেন, এবং পাণ্ডবকে উত্তরাঞ্চল থেকে পাল্টা প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েও পরে নাম তুলে নেওয়া হয়। শ্রীনি শিবির ভেবেছিল, পওয়ারদের ঘরে ভাঙন শুরু হয়ে গিয়েছে। তারা বুঝতেও পারেনি, নিজেদের ‘মৃত্যুবাণ’ রোপণ হচ্ছে নিজেদেরই হাতে। যাঁর সঙ্গে যুক্ত হল আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রস ভোট। দুইয়ে মিলে শ্রীনি-দুর্গ বদলে এখন প্রায় ‘জতুগৃহ’!

প্রেসিডেন্ট চেন্নাইয়ের শ্রীনিবাসন নন। কলকাতার জগমোহন ডালমিয়া। সচিব— সেটাও শ্রীনির বিশ্বস্ত অনুচর নন। বিজেপি ও পওয়ার সমর্থিত অনুরাগ ঠাকুর। স্কোরবোর্ড সরকারি ভাবে শ্রীনির দিকে। ৮:১। ন’টা পদে নির্বাচনে আটটাই তাঁর। কিন্তু পওয়ার শিবির তো নিশ্চিন্ত। সুর চরমে তুলে বলা হচ্ছে, সচিব শ্রীনির নন। আর ডালমিয়া কারও রিমোটে চলবেন না। তা হলে সক্রিয় দু’টো পদ আর কোথায় পেলেন শ্রীনি?

যে দৃশ্যকে কিছুতেই মেলানো যাবে না সোমবার সকালের সঙ্গে। উড়ো খবর, রোমাঞ্চকর সব দৃশ্যপট, শ্রীনি শিবির থেকে ধূর্ত স্ট্র্যাটেজির গল্প শুনিয়ে রাখা— সব মিলিয়ে কিছুতেই মনে হওয়ার উপায় ছিল না যে, পওয়ার-মনোহর বলেও কেউ বোর্ডরুমে থাকবেন। তাঁরাও বকলমে নির্বাচন লড়ছেন। বোর্ডরুমে ঢোকার আগে রাজীব শুক্লকে দেখা গেল হোটেল লবির গণেশ মূর্তির সামনে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে। জোড়হাত কপালে। পওয়ারদের কোষাধ্যক্ষ প্রার্থী। চোখ খুলে মিডিয়াকে দেখে ম্লান মুখে বললেন, “খুব টাফ। জানি না কী হবে।” প্রায় একই সময়ে তখন দলবল নিয়ে বোর্ডরুমের দিকে এগোচ্ছেন শ্রীনি। দু’টো ছক নিয়ে। এক, শিবলাল যাদবের মিটিং প্রিসাইড করা নিয়ে কথা উঠবে। পাল্টা হিসেবে তখন বেরোবে তাঁকে কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত করা সুপ্রিম কোর্ট অর্ডারের কপি এবং গরিষ্ঠ বোর্ড সদস্যের সই করা চিঠি। যা সমর্থন দেবে শিবলালকে। দুই, শ্রীনির আইসিসি নমিনেশন। সেখানেও চিঠি গরিষ্ঠ সদস্যের সই করা। অনুগামীদের বলে দেওয়া হয়, পওয়ার-মনোহররা চিৎকার-চেঁচামেচি করলে তোমরাও একই কাজ করবে। চেঁচাবে।

মিটিংয়েও শ্রীনি শিবিরের আন্দাজ মতো নাটক শুরু হয়। মনোহররা বলতে থাকেন, শিবলাল কেন চেয়ার করবেন? অজয় শিরকে (অতীতে শ্রীনির বিরুদ্ধে যিনি বিদ্রোহ করে বোর্ড ছেড়েছিলেন) কেন করবেন না? বরোদার হয়ে কেন শ্রীনি-লবির সমরজিৎ গায়কোয়াড় ভোটাধিকার পাবেন, তা নিয়ে আবার লাগে। শিবলাল বলে দেন, তিনি প্রেসিডেন্ট রুলিংয়ে এটা অনুমোদন করছেন। পরে লিখিত দিয়ে দেবেন। ওটাও মিটিংয়ে আর এগোয়নি। মিটিংয়ে এগনোর নাকি কথাও ছিল না। মনোহররা জানতেন, শ্রীনি শিবির সব প্রশ্নের জবাব নিয়েই ঢুকেছে। ছুটকো হল্লার বাইরে তাই না গিয়ে ওঁত পেতে থাকা হয়েছে আসলটার জন্য। সচিব পদটার জন্য। জানাই নাকি ছিল, আসলটা আসছে!

বোর্ডরুমের বাইরের পৃথিবীতেও কি কম কিছু হল? ভোট গণনা শেষ হয়নি, অথচ তার আগে খবর ছড়িয়ে পড়ল সঞ্জয় পটেল-সহ শ্রীনির সব প্রার্থী জিতে বেরিয়ে গিয়েছেন! সচিব, যুগ্ম-সচিব, কোষাধ্যক্ষ— সব। টুইটারে যা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। আধ ঘণ্টার মধ্যে দেখা গেল, বাকি সব আছে। শুধু শ্রীনির ‘মন্ত্রী’ পদটা কাটা! আর কোনও পজিশনেই শ্রীনির নিরঙ্কুশ আধিপত্য নেই। যুগ্ম সচিব নির্বাচিত হয়েছে শিবলালের কাস্টিং ভোটে। ‘টাই’ ভাঙতে। কোষাধ্যক্ষ পদে শ্রীনি প্রার্থী অনিরুদ্ধ চৌধুরি ১৬-১৩ ভোটে রাজীব শুক্লকে হারালেন। দু’টো ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে শ্রীনি প্রার্থী একটায় জিতলেন দু’ভোটে, অন্যটায় একটায়। পওয়ারদের পক্ষ থেকে পরে মিডিয়ার কোনও কোনও অংশে বলা হল, বোর্ড নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করা হবে আদালতে। মুম্বই হাইকোর্টে মামলা হবে মঙ্গলবার। বরোদার শ্রীনি ঘনিষ্ঠকে ভোটাধিকার দিয়েছেন শিবলাল। অন্যায় সুবিধে দিয়েছেন। নইলে বোর্ড নির্বাচনে আধিপত্যের সরকারি হিসেবও নাকি তাদের দিকে হত। যা শুনে আবার শিবলালের শ্লেষ মেশানো উত্তর, “কেউ আদালতে গেলে যেতেই পারে। আমি কেন বাধা দেব? আর আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনাদের ব্যাখাও বা কেন দেব?”

নাটকীয় নির্বাচনের পর বিজয়ী অনুরাগ ঠাকুর।

শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বইয়ে দেওয়ার মতো যুদ্ধ। মরণপণ দড়ি টানাটানি।

যেটা নির্বাচন শেষেও চলল। সচিব পদে রেজাল্ট বেরনোর পর শ্রীনি নতুন করে পড়েন ডালমিয়াকে নিয়ে। তাঁর ঘরে গিয়ে নতুন বোর্ড প্রেসিডেন্টকে বলে দেন, অতীতেও এটা হয়েছে। সব সময় প্যানেলের সবাই জিতেছে, এমন নয়। কিন্তু বোর্ডে কর্তৃত্ব করতে অসুবিধে হয়নি। আপনি নিজেই একটা সময় এটা সামলেছেন। এ বারও সব কর্তৃত্ব আপনার। নিজের কন্ট্রোলে বোর্ড রাখবেন। তবে বোর্ড আর দশ বছর আগের মতো নেই। আপনাকে সাহায্য করার জন্য একটা বিশেষ পদ করে দিচ্ছি। এক্সিকিউটিভ অ্যাসিসট্যান্ট টু প্রেসিডেন্টের পদ। যেটা হবেন আপনারই সংস্থার বিশ্বরূপ দে। কমিটি কী হবে, আপনারা ঠিক করবেন। তিন সপ্তাহ পরপর কলকাতায় বসে বোর্ড সদস্যরা দেখে নেবে, কত দূর কী এগোচ্ছে।

কত দূর কী এগোবে, কী হবে না হবে, ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বর্তমান বলবে, সোমবারের চেন্নাই অফুরন্ত নাটকের দিন ছিল। নাটক দিয়ে শুরু, নাটকীয়তায় শেষ। সন্ধের দিকে কলকাতার ফ্লাইট ধরতে যে ডালমিয়া বেরোলেন, তাঁর মাথায় বোর্ডের রাজমুকুট। আবার সেই ঝাঁকে ঝাঁকে সাংবাদিকের দৌড়, উদ্ধৃতির খোঁজ। ডালমিয়া বলে দিলেন, ক্রিকেটকে পরিচ্ছন্ন করবেন। একটা নয়, পরিষ্কার করার আছে অনেক কিছু। বলে গেলেন, সবাইকে মিলে সেটা করতে হবে।

ইতিহাসের বোধহয় মৃত্যু নেই। সে ফিরে ফিরে আসে। চোদ্দো বছর আগে বোর্ডে তাঁর প্রথম রাজমুকুট এই চেন্নাই-ই তাঁকে দিয়েছিল না?

aurag thakur jagmohan dalmiya rajarshi gangyopadhyay bcci president bcci election n srinivasan bcci agm
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy