Advertisement
E-Paper

পেলের দেশেও আবেগের রাজপুত্র সেই দিয়েগো

গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়ার পর দেখলাম কোয়াম্পির চোখে জল। চোখ মুছছে। পিঠে হাত রাখতেই একটু অস্বস্তিতে। পেশাদারদের যে এ ভাবে আবেগে ভেসে যেতে নেই। চোখের জলও ফেলতে নেই। কিন্তু ও বেচারা কী করবে! গাড়িতে বসে একটু আগে যে লোকটা বেরিয়ে গেলেন ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং সেন্টার থেকে, তিনি তো আবেগের মাঝসমুদ্রে বাস করেন।

অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৪ ০৩:০৬
টেলিসুর স্টুডিওয় ভালদেরামার সঙ্গে মারাদোনা।

টেলিসুর স্টুডিওয় ভালদেরামার সঙ্গে মারাদোনা।

গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়ার পর দেখলাম কোয়াম্পির চোখে জল। চোখ মুছছে। পিঠে হাত রাখতেই একটু অস্বস্তিতে। পেশাদারদের যে এ ভাবে আবেগে ভেসে যেতে নেই। চোখের জলও ফেলতে নেই। কিন্তু ও বেচারা কী করবে! গাড়িতে বসে একটু আগে যে লোকটা বেরিয়ে গেলেন ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং সেন্টার থেকে, তিনি তো আবেগের মাঝসমুদ্রে বাস করেন। একটু আগে সেই লোকটাকে দেখেছি ছলছল চোখে এক স্টুডিয়ো লোককে জড়িয়ে ধরতে। আর চোখের জলের এই সংক্রমণটা থেকে বাঁচতে স্টুডিয়ো থেকে ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠতে। শুধু গাড়িতে ওঠার আগে কোয়াম্পিকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। গত একমাসের প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী যে ও-ই।

কোয়াম্পি কলম্বিয়ান ক্যামেরাম্যান। কর্মসূত্রে আর্জেন্তিনায় থাকে। এ বার বিশ্বকাপের আগে ওর অ্যাসাইনমেন্ট শুনে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল। মারাদোনাকে ফলো করতে হবে ২৪ ঘণ্টা। ভেনেজুয়েলার বিখ্যাত টিভি নেটওয়ার্ক টেলিসুরে একটা প্রোগ্রাম প্রোডিউস করবে ওদের কোম্পানি। স্টুডিয়ো শো। অতিথি দিয়াগো আর্মান্দো মারাদোনা। আর স্টুডিয়োর বাইরে মারাদোনাকে কভারের দায়িত্ব কোয়াম্পির। ওর নিজের কথায়, “অ্যাসাইনমেন্টটা শুনে ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। আমাকে আমাদের কোম্পানির একজনই বলেছিলেন, পেলের সঙ্গে নাকি এক বার বিশ্বকাপের সময় এ রকমই একটা টিভি শোয়ের কনট্র্যাক্ট করেছিল একটা সংস্থা। পেলে প্রচুর টাকা নিয়েও স্টুডিয়োয় হাজির ছিলেন মোটে ৪-৫ দিন। আর আমাদের কোম্পানি প্যানেলিস্ট হিসেবে যাঁকে ভাবছে, তাঁর নিজেরই তো কোনও ঠিকঠিকানা নেই। ক্যামেরাম্যানরা যে তাঁর খুব পছন্দের এমন খবরও ছিল না। একসময় এয়ারগানও তো তাক করেছিলেন বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া ক্যামেরাম্যানদের দিকে। আর সেই ভদ্রলোকের সঙ্গেই ২৪ ঘণ্টা কাটানো। খুব নার্ভাস ছিলাম ব্রাজিলে আসার আগে।”

তারপর? একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল কোয়াম্পি, “এই এক মাসে মানুষটা সম্পর্কে সব ধারণা এক এক করে বদলে গেল। প্রতিদিন আমার খবর নিত। আর্জেন্তিনায় আমার পরিবারের খবর নিত। আমার কাজটাও বুঝতে চাইত। কী করলে আমার কাজের সুবিধা হবে, জানতে চাইত। এই এক মাসে যেন আমি ওর পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিলাম।” কোয়াম্পির পাশেই তখন দাঁড়িয়ে টেলিসুরের এডিটর আন্দ্রেস। ওঁর সঙ্গে হয়তো মারাদোনার ততটা ঘনিষ্ঠতা হয়নি। কোয়াম্পির তুলে আনা ছবিতেই মারাদোনাকে চেনা। কিন্তু আন্দ্রেসের চোখেমুখেও বিস্ময়। বললেন, “এক নতুন মারাদোনাকে চিনলাম। এই মারাদোনা দায়িত্ববান। পেশাদার। বন্ধু। স্নেহশীল বাবা।”

ইউটিউব ঘাঁটার পুরনো অভ্যেসেই চোখে পড়ল একটা বিশেষ ভিডিও। মারাদোনা আর্জেন্তিনা-বসনিয়া ম্যাচের আগে বসনিয়া টিম হোটেলে। কোনও একজন মারাদোনা ভক্ত নিজের উদ্যোগে এই ভিডিয়ো তুলে ইউটিউবে আপলোড করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, হোটেল র্যাডিসন। জায়গাটা বাহা দ্য থ্রিজুকা।

ওই রাতেই ছুটলাম বাহা দ্য থ্রিজুকা। রিওয় কোপাকাবানা ছাড়া আরও দু’টো বিচ আছে। বাহা দ্য থ্রিজুকা হল রিওর পাশে হাতে গড়া উপনগরী। অনেক রাত হল পৌছতে। রিসেপশন জানাল, হ্যাঁ মারাদোনা এখানেই আছেন। তবে বাইরে গিয়েছেন। রাত প্রায় ১২টার সময় তিনি এলেন। সঙ্গে বান্ধবী ভেরোনিকা, পুত্র ফার্নান্দো, গোটা চারেক নিরাপত্তারক্ষী, বন্ধুবান্ধব। এসেই ঢুকে গেলেন রিসেপশনের পাশে থাকা কফিশপে। ডিনার করলেন। ছেলে ফার্নান্দোকে বসালেন নিজের ঠিক পাশেই।

কোয়াম্পি বলছিল, “প্রায় প্রতিদিনই ছেলেকে নিয়ে স্টুডিয়োতে আসতেন মারাদোনা। ফাদার্স ডে-তে আমরা একটা স্পেশাল প্রোগ্রাম করি। তাতে ফার্নান্দোকে একেবারে লাইভ শোয়ে নিয়ে আসেন। গায়ে আর্জেন্তিনার নীল-সাদা জার্সি। পিছনে দশ নম্বর আর মেসি লেখা। মারাদোনার ছেলের গায়ে মেসির দশ! ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন সেদিন। এটা মেসির প্রতি তাঁর ‘শ্রদ্ধাজ্ঞাপন’। অবাক হয়ে ভাবছিলাম এই লোকটাই তারই একটু আগে শেষ বার স্টুডিয়ো ছাড়ার সময় বলে গিয়েছেন, মেসিকে গোল্ডেন বল দেওয়াটা ফিফার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি।’’

মেকআপ আর্টিস্টের সামনে।

টেলিসুর চ্যানেলে মারাদোনার শো-টার নাম ছিল ডিসুরদা। ওদের প্রোগ্রামিং ভাইস প্রেসিডেন্ট প্যাট্রিসিয়াকে দেখেছিলাম মারাদোনার স্টুডিয়ো ছাড়ার আগে জড়িয়ে ধরেছেন। চোখে জল। প্যাট্রিসিয়া বলছিলেন, “এই এক মাস আমাদের চ্যানেলকে মারাদোনা যা দিয়ে গেলেন, তা কোনও দিন ভোলা যাবে না। গোটা সাউথ আমেরিকায় আমাদের চ্যানেল বিশ্বকাপের এই এক মাস এক নম্বর জায়গায় থেকেছে।” প্যাট্রিসিয়াই বলেছিলেন, “‘টেলিসুর’ মূলত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের খবর দেয়। বিশ্বকাপ ফুটবলকে আমরা সেই জায়গা থেকেই ধরতে চেয়েছিলাম।” বাহা দ্য থ্রিজুকার ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং সেন্টারে বসে কিন্তু সত্যিই বিশ্বকাপকে রাজনীতির মঞ্চে নিয়ে গেলেন মারাদোনা। প্রতিপক্ষ ফিফা। সুয়ারেজকে শাস্তি দিল ফিফা। কড়া সমালোচনা মারাদোনার। ডিসুরদার স্টুডিয়ো থেকে সুয়ারেজকে ফোনে ধরলেন। কথাবার্তা বললেন। উৎসাহ দিলেন, ভেঙে পড়তে বারণ করলেন, কলম্বিয়া-ব্রাজিল ম্যাচ। সরাসরি বলেছিলেন ফিফার রেফারিরা ব্রাজিলকে বাড়তি সুবিধে দিতে তৈরি। আর্জেন্তিনার ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি গ্রন্দোনা মারাদোনাকে অপয়া বললেন। মধ্যমা দেখিয়ে গ্রন্দোনাকে বলেছিলেন, ফিফার দালাল। প্রবল সমালোচনা করলেন পেলে, বেকেনবাউয়ারদের। আসলে ফিফার এই বিশাল সাম্রাজ্যবাদে তিনি একাই ফুটবল বিপ্লবী। ব্লাটাররা কোনও দিন তাঁকে স্বীকৃতি দেননি। মারাদোনাও পরোয়া করেননি ফিফার। এই মসনদের নীচে মাথা নত করা পেলে, বেকেনবাউয়ারদের সুযোগ পেলেই খোঁচা দিতে ছাড়েননি। অথচ এই শিবিরে তিনি একেবারে বন্ধুহীন ভাবলে ভুল হবে। কোয়াম্পি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ছবি বের করে দেখাচ্ছিল সেদিন। ডিসুরদার স্টুডিয়োতে মারাদোনার কাছে কে আসেননি! রবার্তো কার্লোস, ভালদেরামা, বেবেতো, জিকো, হুগো স্যাঞ্চেজ, ক্যাম্পোস থেকে রিভেলিনো। রিভেলিনো আবার নিয়ে গিয়েছিলেন মারাদোনার জন্য এক জার্সি। তাতে লেখা, ‘বন্ধুর জন্য’।

এমনিতে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনার ফুটবল সম্পর্কটা ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটীয় সম্পর্কের চেয়েও খারাপ। কিন্তু মারাদোনার প্রতি অদ্ভুত শ্রদ্ধা লক্ষ করলাম ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের। রবার্তো কার্লোস, বেবেতো, জিকোরা তো স্টুডিয়োতেই গিয়েছিলেন। র্যাডিসন হোটেলের লবিতে দেখলাম মারাদোনার সঙ্গে দুঙ্গা দেখা করলেন। মারাদোনা তখন হোটেল ছেড়ে স্টুডিয়ো যাচ্ছেন। কোলে ছেলে ফার্নান্দো। দুঙ্গাই দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। মারাদোনার মুখে একগাল হাসি। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর ফার্নান্দোকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘আমার ছেলে ফার্নান্দো। তুমি বোধহয় ওকে আগে একবার দেখেছ। দেখো তো, চিনতে পারছ কি না!’ দুঙ্গা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন। বাবা মারাদোনা খুশি।

সেমিফাইনালের ঠিক দু’দিন আগে ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং সেন্টার থেকে যখন বের হচ্ছিলেন তখন রাত প্রায় বারোটা। অত রাতেও রিও-র ওই নির্জন প্রান্তরে গোটা দশেক আর্জেন্তিনার সমর্থক। মারাদোনার জন্য তাদের গলায় গান। হোটেল থেকে বের হচ্ছেন দেখি এক জাপানি সমর্থক তাঁর জন্য চিৎকার করছেন। মারাদোনাকে একবার দেখার পর কাঁদতে শুরু করলেন। শেষ দিন ডিসুরদার গোটা ইউনিটটার চোখে জল। কোয়াম্পি, প্যাট্রিসিয়াদের চোখের কোল ভিজে। কলকাতার এক সাংবাদিক বন্ধুর কথা মনে পড়ছিল। মারাদোনার জন্মদিনে পাড়ায়, অফিসে এখন নিয়ম করে চকোলেট খাওয়ায়। নিজের কথাও ভাবছিলাম। মহেশতলায় মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে যখন পাগলের মতো চেস্ট বাম্প করে যাচ্ছিলেন, তখন জিভে নোনতা স্বাদ পেয়েছিলাম যে আমিও!

কে জানে, এই লোকটা কী করে এক-পৃথিবী লোককে আবেগে ভাসিয়ে দিয়ে যান!

maradona anilabha chattopadhyay valderrama
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy