Advertisement
E-Paper

ফিল হিউজ মারা গিয়েছে টেকনিকের অভাবে

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তিদের মধ্যে এমন একরোখা কথা একমাত্র তিনি-ই বলতে পারেন! বলে এসেছেনও বছরের পর বছর। স্টিভ ওয়-র টিমই সর্বকালের সেরা কি না, জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন, “ধুর, আমাদের আটচল্লিশের টিম তো ওদের হারাতই। লয়েডের আশির ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছেও ওরা পাত্তা পেত না।” ছয় মাস আগে দ্বিতীয় স্ত্রীকে হারিয়েছেন। ছিয়াশি বছর বয়সে সিডনির পঁচিশ মাইল দক্ষিণের বাড়িতে একাই থাকেন। একা ঘোরাফেরা করেন। রোববারই যেমন একা ফিরেছেন অ্যাডিলেড থেকে।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩০

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তিদের মধ্যে এমন একরোখা কথা একমাত্র তিনি-ই বলতে পারেন! বলে এসেছেনও বছরের পর বছর। স্টিভ ওয়-র টিমই সর্বকালের সেরা কি না, জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন, “ধুর, আমাদের আটচল্লিশের টিম তো ওদের হারাতই। লয়েডের আশির ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছেও ওরা পাত্তা পেত না।” ছয় মাস আগে দ্বিতীয় স্ত্রীকে হারিয়েছেন। ছিয়াশি বছর বয়সে সিডনির পঁচিশ মাইল দক্ষিণের বাড়িতে একাই থাকেন। একা ঘোরাফেরা করেন। রোববারই যেমন একা ফিরেছেন অ্যাডিলেড থেকে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার আমন্ত্রণে বিশেষ অতিথি হিসেবে খেলা দেখতে গিয়েছিলেন। ম্যাচের শেষ এক ঘণ্টা বাদে পুরোটাই দেখেছেন। আধুনিক ক্রিকেটের সম্বন্ধে চট করে অভিভূত হওয়ার ঐতিহ্য তাঁর নেই। কিন্তু বিরাট কোহলি সম্পর্কে আপাতত উচ্ছ্বসিত! সিডনিতে এ দিন এবিপি-কে আধুনিক ক্রিকেট সম্পর্কে তাঁর গভীর হতাশা, তেন্ডুলকর, চলতি সিরিজ, ব্র্যাডম্যান, ফিল হিউজের মৃত্যু এবং অবশ্যই কোহলি, সব বিষয় নিয়েই বিস্ফোরক সাক্ষাত্‌কার দিলেন তিনি— নিল হার্ভি।

হার্ভি: বহু দিন বাদে ইন্ডিয়ান টিমের খেলা মাঠে বসে দেখলাম। লাস্ট কবে মাঠে বসে দেখেছি ভাবতে হবে।

প্রশ্ন: তাই নাকি? আপনি অ্যাডিলেডে ছিলেন?
হার্ভি: আমরা চার জন পাশাপাশি বসে খুব মন দিয়ে টেস্ট ম্যাচটা দেখেছি। আমি, কিম হিউজ, রডনি মার্শ আর অ্যাশলে ম্যালেট। কালকের মহাআতঙ্কিত শেষ ঘণ্টাটা শুধু আমার দেখা হয়নি। ঠিক তার আগে আমি বেরিয়ে যাই।

প্র: শেষ দিন ভারতের রান তাড়া করাটা কেমন লাগল?
হার্ভি: দুর্দান্ত। এই কোহলি ছেলেটার অ্যাডভেঞ্চার করার স্পিরিট দেখে আমি এই ছিয়াশি বছর বয়সেও মুগ্ধ। আমি আপ্লুত! আরে, এ ভাবেই তো ক্রিকেট খেলতে হয়। ছোকরাকে বলতে চাই একটা বিকেলে তুমি অস্ট্রেলিয়ার ঘরে ঘরে মানুষের মন জয় করে নিয়েছ। আমি শুধু আশা করব, ভারত যেন জেতার জন্য এই অ্যাগ্রেসিভ খেলার স্টাইলটা না বদলায়। ধোনি ক্যাপ্টেন হয়ে না আবার অন্য ছকে চলে যায়।

প্র: অ্যাডভেঞ্চার ভাল লাগাটা একটু ব্যাখ্যা করবেন?
হার্ভি: মনোভাবে কত আলাদা। আর সেটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ইন্ডিয়া যা খেলছিল তাতে চাইলে ইজি ওরা ম্যাচ ড্র করতে পারত। টি অবধি তো আমি নিজেই মাঠে বসে দেখছিলাম, হাতে শুধু আট উইকেটই নেই, দিব্য আরামে খেলছে। অতীতের ইন্ডিয়াকে সব সময় আমরা দেখেছি, প্রথমে ঘর বাঁচাও তার পর অন্য কিছু ভাবো...এই ছেলেটি তো সে দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জেতার জন্য শেষ অবধি চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে।

প্র: কিন্তু আপনাদের অস্ট্রেলীয় দর্শনে তো মনোভাবটা বোকামি। তা বলে, জিততে যদি বা না পারো, কিছুতেই শত্রুর কাছে হেরে ফিরো না। ভারতের তো শেষে হারই হল।
হার্ভি: ও ভাবে বিচার করাটা ঠিক হবে না। টেস্ট ক্রিকেটের মধ্যে একটা রোমান্টিসিজমও রয়েছে। যেটা আমরা আধুনিক সময়ে ভুলতে বসেছি। এত কাল ছিল ওয়ান ডে-র অ্যাগ্রেসন। এখন হয়েছে টি-টোয়েন্টির। তার সঙ্গে লড়াই করার জন্য টেস্ট ক্রিকেটকে এ রকমই অ্যাট্রাক্টিভ হতে হবে। কোহলিকে এত ভাল লাগল কারণ ছেলেটা নিজের ক্ষতির কথা না চিন্তা করেও টেস্ট ক্রিকেটে রোমান্সটাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

প্র: কোহলির ব্যাটিং কেমন লাগল?
হার্ভি: খুব ভাল। অফস্পিনারকে খেলার সময় বাকিরা যখন পুশ করছে, ও তখন সম্পূর্ণ আলাদা। অফস্টাম্পটা কভার করে চমত্‌কার খেলছিল। এটাই ঠিক টেকনিক। আজকাল যা উঠে গিয়েছে।

প্র: নাথন লিয়ঁকে কেমন লেগেছে?
হার্ভি: ওকে তো কিছুই বিশেষ করতে হয়নি। অপোনেন্ট চ্যারিটি করে রাউন্ড দ্য উইকেট বল করে করে একগাদা ফুটমার্কস তৈরি করে দিয়েছে, বাবু তার ওপর বল ঘুরিয়েছে। তাতে আর কৃতিত্ব কোথায়? এটুকু না পারলে তো ওর টেস্ট ক্রিকেট খেলারই মানে হয় না।

প্র: অ্যাডিলেডে এত দিন থাকলেন। ইন্ডিয়ান টিমের সঙ্গে নিশ্চয়ই আলাপ-টালাপ হল।
হার্ভি: থাকলাম মানে কী, একই হোটেলে থাকলাম। আমিও ইন্টারকন্টিনেন্টালেই ছিলাম।

প্র: কোহলির সঙ্গে আলাপ হল?
হার্ভি: না কারওর সঙ্গে কথা হয়নি (সলজ্জ হাসি)। দু’দিন ওরা যখন মাঠ থেকে ফিরছে আমি লবিতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে পাশ কাটিয়ে ওরা লিফটে উঠে গেল।

প্র: বলছেন কী, আপনি নিল হার্ভি! ব্র্যাডম্যানের আটচল্লিশ টিমের সদস্য। অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা দলে নির্বাচিত, আইসিসি হল অব ফেমে রয়েছেন। আপনাকে দেখে ইন্ডিয়ান টিমের কেউ চিনতে পারল না?
হার্ভি: হতেই পারে। আমি কোন সময়ের প্লেয়ার। এখনকার প্লেয়ার না-ই জানতে পারে।

প্র: হাজারের জোড়া সেঞ্চুরির দিন আপনি প্লেয়ার হিসেবে অ্যাডিলেড ওভালে ছিলেন। আর কোহলির দু’টো হান্ড্রেড দেখলেন মাঠে বসে। কী ভাবে তুলনা করবেন?
হার্ভি: হাজারের খেলার মধ্যে একটা স্টাইল ছিল। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের খেলাতে একই লাবণ্যের খোঁজ পেয়েছি। লালা অমরনাথও খুব ভাল ব্যাট করত। সেই সময় এই দু’জনকেই আমার ভাল লাগত। হাজারে আর অমরনাথ।

প্র: আপনার দেখা সেরা ভারতীয় ব্যাটসম্যান যদি বাছতে বলা হয়—হাজারে, গাওস্কর, তেন্ডুলকর আর কোহলি। কাকে বাছবেন?
হার্ভি: নিঃসন্দেহে তেন্ডুলকর! ও বাকিদের থেকে অনেক এগিয়ে।

আধুনিক সময়ে আমার যেটা দেখলে মর্মান্তিক লাগে তা হল খেলাটা কী ভাবে ব্যাটসম্যানদের দিকে একচেটিয়া চলে যাচ্ছে। এ তো পাগলামি! ডন এই সব ব্যাটে খেলার সুযোগ পেলে আজকের দিনে ১৯৯.৯৪ গড় নিয়ে শেষ করত। ৯৯.৯৪ নয়। কী হাল হয়েছে ক্রিকেটের! অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের দেখি কেউ ব্যাকফুটে যায়-ই না। ব্যাকফুট খেলাটাই উঠে গিয়েছে। সবার ইনিশিয়াল মুভমেন্ট হচ্ছে ফ্রন্টফুট। ওই গদা ব্যাটগুলো দিয়ে মারো। যত জোর পারো মারো। ব্যাটসম্যানদের অ্যাভারেজগুলো বাড়ছে, বোলারদেরটাও বাড়ছে। অথচ সবাই চুপ করে বসে আছে। আমার এক এক সময় মনে হয়, এটা যদি ক্রিকেট হয়, আমি ক্রিকেট খেলিনি। ব্র্যাডম্যানও ক্রিকেট খেলেনি!

প্র: আপনি তো প্রচণ্ড বিরক্ত দেখছি।
হার্ভি: বিরক্ত হওয়ার তো যথেষ্ট কারণ আছে। আমার তো এখন মনে হচ্ছে অ্যাডিলেডের শেষ দিনের মতো গণ্ডগোলের উইকেট পুরো সিরিজ জুড়ে হওয়া উচিত। একটু খেলাটা জমুক। তুল্যমূল্য লড়াই হোক। তবে না মজা। এখন তো আগে থেকে ঠিক হয়ে থাকছে যে ব্যাটসম্যান আসবে জবাই করতে আর বোলার সানন্দে জবাই হবে। আমার প্রায়ই মনে হয় আমার সময় থেকে ক্রিকেট খেলাটার শুধু দু’টো জিনিস এক আছে। টেস্ট ক্রিকেটে আজও লাল বল, আর দু’দিকে তিনটে করে স্টাম্প থাকে। বাকি সব বদলে গিয়েছে।

প্র: আপনি নিজে ব্যাটসম্যান হয়েও এত বোলারদের যন্ত্রণা তুলে ধরছেন, সেটা কিন্তু বেশ অবাক কাণ্ড।
হার্ভি: আমার তো কাউকে কিছু ভয় পাওয়ার নেই। আইসিসি বা কারও কাছ থেকে কিছু পাওয়ার নেই। আমার সত্যি কথাটা বলতে অসুবিধেটা কোথায়? ব্যাটসম্যানশিপটা তো একটা স্কিল। সেটা আয়ত্ত করতে হয়। তাকে সেটা করতে না দিয়ে তুমি নিয়মগুলো সব ওলট-পালট করে দিয়েছ। টেকনিক তৈরি হবে কী করে? এই কোহলি ছোকরাটা দেখলাম ব্যতিক্রম। বাকি আমায় বলুন না, কারও টেকনিক কিছু আছে? তাকে তুমি গদা ব্যাট দিচ্ছ, সহজ উইকেট দিচ্ছ, সব রকম আত্মরক্ষার জিনিস দিচ্ছ, নো বলের নিয়ম বদলেছ, বাউন্সার কমিয়ে দিয়েছ, তার পরও বাবুদের বায়নাক্কা, ভাল উইকেট দিতে হবে। আশ্চর্য কী যে লোকে খেলাই শিখছে না। ফিল হিউজের লাগল কারণ ও শর্ট বল খেলার টেকনিকটাই শেখেনি।

প্র: বলছেন কী?
হার্ভি: ঠিকই বলছি। টেকনিক ঠিক থাকলে ওই চোট হয় না। তার পর সে-ই মারা যাওয়ার পর রব উঠল কী, না বাউন্সার কমিয়ে আনো। যেন বাউন্সারের সব দোষ। আমি মনে মনে বলছিলাম, দে তুলে দে, বাউন্সার তুলে দে। ক্রিকেটটাও তুলে দে।

প্র: আপনি তো প্রচণ্ড রেগে আছেন দেখছি।
হার্ভি: এতটুকু রেগে নেই। আমি সত্যি কথা চাঁচাছোলা ভাবেই বলি। ভাল লাগলে সেটাও বলি। কোহলির কথা বললাম তো। কিন্তু আমার ভয়, খেলাটা না সর্বনাশে চলে যায়। কালকের অ্যাডিলেডের মতো দিন যত আসবে, তত টেস্ট ক্রিকেটের পক্ষে ভাল। খেলাটা বাঁচবে।

প্র: বিশ্বকাপ হবে আপনার দেশে। আপনার কোনও ভূমিকা থাকবে?
হার্ভি: টিভিতে এক-আধটা ম্যাচ দেখা ছাড়া কোনও ভূমিকা থাকা উচিত নয়। ওয়ান ডে ক্রিকেট আমার আগ্রহের বিষয় কোনও কালেই ছিল না।

প্র: ভারত অ্যাডিলেডেই এত ভাল খেলার পর এ বার আপনার সিরিজ পূর্বাভাস কী?
হার্ভি: ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়া যথেষ্ট বাউন্স ছেড়ে রাখবে। মাইকেল ক্লার্ক খেলতে পারবে না বলে ওরা কোনও চান্স নেবে না। গাব্বায় আমার মনে হয় না ইন্ডিয়ার কোনও সুযোগ আছে বলে। লাস্ট দু’টো টেস্ট মেলবোর্ন আর সিডনি, ফিফটি-ফিফটি। যে কোনও একটা ইন্ডিয়া জিতবে বলে আমার ধারণা। সিরিজ ১-২ হারবে শেষমেশ।

gautam bhattacharyay neil harvey phil hughes bouncer exclusive interview india australia series
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy