Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

রাউন্ড দ্য উইকেট আর খরুচে ফাটকায় বিদ্ধ ভারতের শেষ ভরসা অ্যাডিলেডের প্রাচীন প্রবাদ

ইয়ান চ্যাপেল ধৈর্য না রাখতে পেরে ঢুকেই পড়লেন স্টার স্পোর্টসের ঘরে! “এই রাহুল, হচ্ছেটা কী? রাউন্ড দ্য উইকেট বল করে করে তো তোমার টিম নাথন লিয়ঁকে ফুটমার্কগুলো দিয়ে যাচ্ছে। যার ওপর ও বল ফেলে সেকেন্ড ইনিংসে আবার ঝামেলায় ফেলবে। এটা কোন ধরনের ক্রিকেট?” কথাগুলো সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বলা হলে তিনি হয়তো নড়েচড়ে বসে চ্যাপেলের সেন্টিমেন্ট ভারতীয় শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার কথা ভাবতেন! হয়তো ভাবতেন।

ওয়ার্নার-ঔদ্ধত্যে রথের চাকা বসছে কর্ণের।

ওয়ার্নার-ঔদ্ধত্যে রথের চাকা বসছে কর্ণের।

গৌতম ভট্টাচার্য
অ্যাডিলেড শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৮
Share: Save:

ইয়ান চ্যাপেল ধৈর্য না রাখতে পেরে ঢুকেই পড়লেন স্টার স্পোর্টসের ঘরে!

“এই রাহুল, হচ্ছেটা কী? রাউন্ড দ্য উইকেট বল করে করে তো তোমার টিম নাথন লিয়ঁকে ফুটমার্কগুলো দিয়ে যাচ্ছে। যার ওপর ও বল ফেলে সেকেন্ড ইনিংসে আবার ঝামেলায় ফেলবে। এটা কোন ধরনের ক্রিকেট?” কথাগুলো সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বলা হলে তিনি হয়তো নড়েচড়ে বসে চ্যাপেলের সেন্টিমেন্ট ভারতীয় শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার কথা ভাবতেন! হয়তো ভাবতেন।

কিন্তু দ্রাবিড় হলেন চিরকালীন বিশুদ্ধবাদী। সামান্যতম লাইনের বাইরে যাবেন না। ন্যূনতম স্টেপ আউটও করবেন না। চ্যাপেলের প্যাশন তিনি প্যাডে খেললেন। বলটা জমি থেকে এক মিলিমিটারও উঠল না। ভারতীয় শিবিরেও পৌঁছল না।

প্রশ্নটাও আজকের মতো অমীমাংসিত থেকে গেল— ভারতীয় রাউন্ড দ্য উইকেটের স্ট্র্যাটেজিটা কেন? অজিঙ্ক রাহানে সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে গেলেন, টিম ম্যানেজমেন্টের সচেতন সিদ্ধান্ত।

যত দূর শোনা যাচ্ছে, ধোনি নন। শাস্ত্রী নন। কোহলি নন। ডানকান ফ্লেচারের নেতৃত্বে কোচিং গ্রুপের ইনপুট যে, রাউন্ড দ্য উইকেট করলে অস্ট্রেলিয়াকে বেশি সমস্যায় ফেলা সম্ভব। যা নিশ্চয়ই নেওয়া হয়েছে টিমের আইটি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বসে ডেটা গবেষণার পর। কিন্তু শুকনো ডেটা অনেক সময় শুকনো ডেটাই দেয়। প্রখর বাস্তববুদ্ধি নয়।

অ্যাডিলেড টেস্টে কোহলির সেঞ্চুরি এবং বাকিদের বুক চিতিয়ে লড়াইয়ের পরেও যে ভারত বিপন্নতার টেরেন্স নদী থেকে এখনও সাঁতরে বেরোতে পারেনি, তার প্রাথমিক কারণ রাউন্ড দ্য উইকেট স্ট্র্যাটেজি। একে তো নিজের বোলারদের বিপক্ষের এতগুলো বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে এলবিডব্লিউ পাওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছে। তার পর বিপক্ষ অফস্পিনারের জন্য ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে সযত্নে। অতএব কোনও এক নাথন লিয়ঁ, যিনি বাংলার হয়ে খেললে সৌরাশিস লাহিড়ীর সঙ্গে লড়াই করে লক্ষ্মীর টিমে ঢুকতেন কি না সন্দেহ। তিনি প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেয়ে বসে আছেন। আর শেষ দিন অস্ট্রেলিয়াকে সিরিজে ১-০ এগিয়ে দিতে মাইকেল ক্লার্কের পয়লা নম্বর ভরসা।

ধরে নেওয়া যায় ভোররাতে প্রায় ঘুমন্ত কলকাতা সারদা কেলেঙ্কারির নবতম নাটকীয় পরিস্থিতি কাগজে পড়ার অনেক আগেই মাইকেল ক্লার্ক ডিক্লেয়ার করে দেবেন। আজকের স্কোরে করা মানে ব্র্যাডম্যানের শহরের অব্র্যাডম্যানোচিত স্পিনিং পিচে ভারতকে কাটাতে হবে ৯৮ ওভার। যেটা একেবারেই সহজ নয়। আর জেতার জন্য চাই ৩৬৪, যার কথা আপাতত কেউ মাথাতেই আনছে না। অ্যাডিলেড মাঠে চতুর্থ ইনিংসে ৩১৫ করে জেতার ইতিহাস আছে। কিন্তু সেটা ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটা কার্জনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে লেখারও চার বছর আগে!

বোলিংয়ের আচমকা স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন যদি চতুর্থ দিনেও বিড়ম্বনার বিশাল কারণ হয়। তার সমান্তরাল কারণ, প্রথম টেস্টে হঠাত্‌ করে রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে বাদ দিয়ে দেওয়া। ভারতে অশ্বিন-নীতি বেশ কিছু দিন ধরেই দুর্বোধ্য। অশ্বিনকে ব্যবহার করা হয় হরভজনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার ঢাল হিসেবে। যে-ই সেই প্রয়োজন মিটে যায়, স্কোয়াডটা নির্বাচিত হয়ে যায়, চূড়ান্ত এগারোয় তাঁকে খেলানো হয় না। অদ্ভুত একটা স্ট্যাটিসটিক্স শুনলাম। গত চার বছরে বিদেশে তাঁকে খেলানো হয়েছে নাকি মাত্র তিনটে টেস্ট। অ্যাডিলেড ওভাল মাঠের একশো তিরিশতম জন্মদিন গেল শুক্রবার। এই যে সন্ধে থেকে শহরের তরুণ-তরুণীরা ফ্রাইডে নাইট ফিভারের ফূর্তি মেখে রাস্তাঘাটে বেরিয়ে পড়েছেন, সেই ফূর্তি ভারত তার আগেই জন্মদিন উত্‌সবে পেত। শুধু এক জন ভাল অফস্পিনার টিমে থাকলে।

স্পিনার হিসেবে যিনি খেলছেন, সেই কর্ণ শর্মা লেগস্পিনার। উল্টো দিকের রাউন্ড দ্য উইকেটের ক্ষত লেগস্পিনার ব্যবহার করবেন কী করে? তার চেয়েও বড় কথা, অস্ত্রশিক্ষায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এই কর্ণ। ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচের সংখ্যা কুড়ি পেরোয়নি। তাঁকে খেলিয়ে ফাটকা নেওয়া হয়েছে বোঝা গেল। কিন্তু বড্ড খরুচে ফাটকা। দু’ইনিংস মিলিয়ে আবির্ভাবে কর্ণ দিলেন ২৩৮ রান। উইকেট চারটে। এক বারের জন্যও মনে হয়নি চাপ তৈরি করতে পেরেছেন বলে। না তিনি সারথি, না রথের ওপর বসে থাকা তিরন্দাজ। চূড়ান্ত দল নির্বাচকেরা যদি ভেবে থাকেন কর্ণকে দিয়ে সেই অষ্টাশির নরেন্দ্র হিরওয়ানি বানানো যাবে। তা হলে সেটা এমনই ব্যর্থ হয়েছে যে, ভুল ঢাকার জন্য আজ মুরলী বিজয়-রোহিত শর্মাকে দিয়ে ১৮ ওভার করাতে হল। তাঁরা তো আর নিয়মিত স্পিনার নন। টি-টোয়েন্টিতে বল করা আর টেস্ট ম্যাচের এত বড় মঞ্চে উইকেট নেওয়া কি এক না কি? সৌরভের কথাটা সব সময় মনে রাখা উচিত, “অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে বেগ দিতে হলে অনেক স্মার্টনেস আর স্কিল চাই। এটা কলেজ স্ট্রিট থেকে সত্যজিত্‌ রায়ের বই কিনে ফেরা নয় যে, ঠিক করলাম আর বইটা আমার হয়ে গেল।”

শুক্রবার প্রেসবক্সে বসে বারবার মনে হচ্ছিল উদ্দীপ্ত অধিনায়কত্ব আর নিজের সেঞ্চুরিতে কোহলি একটা দারুণ সুযোগ তৈরি করেছিলেন। অথচ ছোট ছোট কিছু সিদ্ধান্তের ভুলে সেটা হাতছাড়া হয়ে যেতে বসেছে। সবচেয়ে দুঃখের কথা, অ্যাডিলেডের মতো স্পিনিং উইকেট গোটা সিরিজে আর পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। হতাশাটা আরও বেশি কারণ ভারত যে অনেক প্ল্যান করে এসেছে সেটা ফিল্ডিং সাজানো, বোলিং পরিবর্তন সবেতেই চোখে পড়ছে। তৃতীয় ইনিংসে রান ওঠা কমানোর জন্য কোহলি কখনও কখনও ৩+৬ কম্বিনেশনে চলে গেলেন। অফে তিন, অনের দিকে ছয়। তা-ও সেই ছয়তেও তিন জনকে অদ্ভুত অ্যাঙ্গলে দাঁড় করানো। মনে হল না কোহলির একক মস্তিষ্কপ্রসূত বলে। এটা নির্ঘাত ভিডিওর সামনে তৈরি টিম স্ট্র্যাটেজি। সমস্যা হল, স্ট্র্যাটেজি করলেই তো হল না। সেটা কাজে লাগানোর যোগ্য লোক চাই। অ্যাডিলেডে স্পেশ্যালিস্ট অফস্পিনার বাদ দেওয়াটা ভারতের কালিদাসীয় স্ট্র্যাটেজি। নিজেরাই নিজেদের গাছের ডাল কেটেছে।

নইলে প্রথম ইনিংসে ৭৩ রান পিছিয়ে পড়ার পরেও আশা জাগছিল, আবার যদি এগারো বছর আগের সোনালি বিকেল ফিরে আসে! সে দিনও তো এ রকমই সময়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে ধস নেমেছিল এর চেয়ে প্রবল প্রতাপান্বিত স্টিভ ওয়র ব্যাটিং লাইন আপে। বলা হয়ে থাকে ক্রিকেটজীবনে ওই প্রথম ও শেষ বার অজিত আগরকরের জন্য ভারতীয় টিম বাস দাঁড়িয়ে ছিল। আগরকর ৪১ রানে ৬ উইকেট নেওয়ার পর প্রশ্নে প্রশ্নে তাঁর মিডিয়া সম্মেলন শেষ হতে দেরি হয়ে যায়। ওয়াার্নারদের বেলাতেও কি তেমন কোনও অঘটন ঘটতে পারে না? এই ভারত তো আড়াইশো অবধি আরামে তাড়া করবে!

কিন্তু ওয়ার্নার যে নিষ্ঠুর পেশাদারি মেজাজে ম্যাচে তাঁর দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটা করলেন, তাতে মনেই হল অ্যাডিলেডেই সিরিজে এগিয়ে যেতে বদ্ধসংকল্প। বোঝাই যাচ্ছে গোটা সিরিজ ধরে ভারতকে অনবরত ভুগিয়ে যাবেন দু’জন। ব্যাটে ওয়ার্নার। বলে মিচেল জনসন!

আ-টা-ন-ব্ব-ই ওভার কাটবে কী করে! ভারতের একমাত্র আশা বার্থডে বয়কে ঘিরে থাকা প্রাচীন অরণ্যপ্রবাদ। অ্যাডিলেডে চার বা পাঁচ দিনে খেলা আচমকা ঘুরে যায়। এটাই নাকি মাঠটার বৈশিষ্ট্য।

দেখা যাক!

অস্ট্রেলিয়া

প্রথম ইনিংস ৫১৭-৭ ডিঃ।

ভারত

প্রথম ইনিংস (আগের দিন ৩৬৯-৫)

রোহিত ক ও বো লিয়ঁ ৪৩

ঋদ্ধিমান ক ওয়াটসন বো লিয়ঁ ২৫

কর্ণ বো সিডল ৪

শামি ক ওয়াটসন বো সিডল ৩৪

ইশান্ত ক স্মিথ বো লিয়ঁ ০

অ্যারন নটআউট ৩

অতিরিক্ত

মোট ৪৪৪।

পতন: ৩০, ১১১, ১৯২, ২৯৩, ৩৬৭, ৩৯৯, ৪০৬, ৪২২, ৪২২।

বোলিং: জনসন ২২-৬-১০২-২, হ্যারিস ২১-৬-৫৫-১, লিয়ঁ ৩৬-৪-১৩৪-৫,

সিডল ১৮.৪-২-৮৮-২, মার্শ ১১-৪-২৯-০, ওয়াটসন ৫-১-১৩-০, স্মিথ ৩-০-১৯-০।

অস্ট্রেলিয়া

দ্বিতীয় ইনিংস

রজার্স ক রোহিত বো কর্ণ ২১

ওয়ার্নার বো কর্ণ ১০২

ওয়াটসন বো শামি ৩৩

ক্লার্ক ক ঋদ্ধিমান বো অ্যারন ৭

স্মিথ ব্যাটিং ৫২

মার্শ ক বিজয় বো রোহিত ৪০

হাডিন ব্যাটিং ১৪

অতিরিক্ত ২১

মোট ২৯০-৫।

পতন: ৩৮, ১৪০, ১৬৮, ২১৩, ২৬৬।

বোলিং: শামি ১১-২-৪২-১, ইশান্ত ১৪-৩-৪১-০, কর্ণ ১৬-২-৯৫-২,

বিজয় ৬-০-২৭-০, রোহিত ১২-২-৩৫-১, অ্যারন ১০-০-৪৩-১।

ছবি: গেটি ইমেজেস

জেতার জন্য ঝাঁপাক ভারত: গাওস্কর

সংবাদ সংস্থা • নয়াদিল্লি

প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের জেতার সুযোগ রয়েছে, মনে করছেন সুনীল গাওস্কর। তার জন্য বিরাট কোহলিদের ইতিবাচক থাকতে হবে। ইতিমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া অ্যাডিলেডে ৩৬৩ রানের লিড নিয়ে নিয়েছে। তবে গাওস্কর বলে দেন, “ইতিবাচক থাকতে হবে। আমি এখনও বলব ভারত এই ম্যাচ জিততে পারে। ওপেনিংয়ে জুটিতে ভাল রান আর ক’য়েকটা বড় পার্টনারশিপ হলে ভাল জায়গায় চলে আসবে ভারত। মুরলী বিজয় বা শিখর ধবন ক্রিজে জমে গেলে কী হতে পারে কে বলতে পারে।” পাশাপাশি গাওস্কর আরও যোগ করেন, “বিরতিতে পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে হবে ভারতকে। খুব দূরের কিছু ভাবতে হবে না। ৩৬০ প্লাস রান তাড়া করা সোজা নয় ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধি করে ব্যাটিংটা করলে ম্যাচ জেতার সুযোগ থাকতে পারে।” অনেকে অস্ট্রেলিয়ার চতুর্থ দিনের শেষে দ্বিতীয় ইনিংস ডিক্লেয়ার না করা নিয়ে অবাক হলেও গাওস্কর কিন্তু মনে করেন অজিরা ঠিক সিন্ধান্তই নিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE