ছবি: উৎপল সরকার
লং অফ আর লং অনের মাঝখান দিয়ে বাউন্ডারিটা মেরে বোলারের দিকে তাকালেনও না সাকিব-আল-হাসান। চিলতে একটা হাসি, নির্লিপ্ত চোখমুখ। মাথা নিচু করে স্টাম্পটা শুধু তুলে নিলেন।
গৌতম গম্ভীরকে দেখে মনে হবে সিএসকে নয়, আজ বোধহয় তিনি দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ম্যাচ জিতে উঠেছেন! বোধহয় টুর্নামেন্টে এই প্রথম তাঁর হাতের নখে দাঁত গেল না, টেনশনাক্রান্ত চোখ অদৃশ্য, শেষ ওভার চলছে যখন কেকেআরকে ক্যাপ্টেনকে দেখা গেল জল-টল খাচ্ছেন! মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে কিছুক্ষণের মধ্যে ধরল টিভি সঞ্চালক। ‘টসই শেষ করে দিল’ বলে যখন ভারত অধিনায়কের বিলাপ চলছে, গম্ভীর তখন একমনে জুতোর ফিতে বাঁধলেন, বেঁধে টিমের আর পাঁচ জনের সঙ্গে শুষ্কং-কাষ্ঠং করমর্দন সেরে সোজা ড্রেসিংরুমের দিকে।
মাফিন নামের খুব কাছের এক জনকে জয়টা উৎসর্গ করে গেলেন রবিন উথাপ্পা। সেটা কে? পরে প্রেস কনফারেন্সে এসে বলে গেলেন, ওটা তাঁর খুব প্রিয় একজনের পোষ্য! অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছে? শোনালেও এটাই নির্জলা সত্যি।
আশ্চর্য!
শেষ কবে চেন্নাইয়ের রাজাধিরাজদের বিরুদ্ধে একপেশে জিতেছে নাইটরা? শেষ কবে সিএসকে-র রান তাড়া করে জিতেছে আট উইকেটে? শেষ কবে আঠারো ওভারের মধ্যে ম্যাচ খতম করে তারা উঠে পড়েছে বিজয়মঞ্চে? খুুঁজতে গেলে ক্রিকেট-উৎসাহী কেন, ক্রিকেট-পরিসংখ্যানবিদেরও হাতে ব্যথা হয়ে যাবে। আজ পর্যন্ত রেকর্ডের পৃথিবীতে একাধিপত্য ছিল সিএসকের, কেকেআরের নয়। মঙ্গলবারের আগে পর্যন্ত ইডেনেও পাঁচ বারের মধ্যে চার-চার বার জিতে গিয়েছেন ধোনিরা। সিএসকে বনাম কেকেআর মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেকেহার। ব্যতিক্রমের দিনে সৃষ্টি হত অমর কিছু ফ্রেম। আজ সে সবে ব্যতিক্রম কেন? নাইটরা এত নির্লিপ্ত কেন?
রাত বারোটার ইডেনে বসে একটাই যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা মাথায় আসবে। যাতে হয়তো এই উচ্ছ্বাসহীনতা, পরোক্ষে তাচ্ছিল্য-প্রদর্শনকে ধরা যাবে।
শীতল ঔদ্ধত্য!
যা এত দিন ভারতীয় ক্রিকেটে নিরঙ্কুশ ভাবে ছিল এমএসডি-র ট্রেডমার্ক, সেখানে তাঁর যে কোনও কপিরাইট নেই, ষাট হাজারের ইডেনে মঙ্গলবার বুঝিয়ে দিল গম্ভীরের কেকেআর। কেকেআর দেখিয়ে দিল, মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকেও সময়-সময় তাঁর বিশ্বখ্যাত ‘অলঙ্কার’ ফিরিয়ে দেওয়া যায়। তাঁকেই ফিরিয়ে দেওয়া যায় তাঁর অতিপ্রিয় শীতল ঔদ্ধত্য। ১২ ম্যাচে ১৪ পয়েন্ট নিয়ে প্লে অফের টিকিট প্রায় নিশ্চিত করে ফেলার দিনেও (বেঙ্গালুরু এ দিন হেরে যাওয়ায় কেকেআরের রাস্তা আরও নিষ্কণ্টক হল) প্রতিপক্ষের প্রতি ‘অবজ্ঞা’ ধরে রেখে উচ্ছ্বাসহীন থেকে যাওয়া যায়। কেকেআর দেখিয়ে গেল, মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও কোনও কোনও দিন রক্তমাংসের মানুষ। তাঁরও ভুল হয়। বোলারদের চরম ব্যর্থতার দিনে তাঁকেও প্রবল অসহায় লাগে, প্রয়োজন হয় টস নামক অজুহাতের।
সোজাসুজি বললে, এমএসডি আজ তিনটে জায়গায় টিম গম্ভীরের কাছে পরাভূত হলেন।
প্রথমত, সিএসকে ম্যানেজমেন্ট ইডেন পিচে খবরদারি চালিয়েও টিমের ‘রক্ষাকবচ’ জোগাড় করে উঠতে পারল না। ইডেন পিচ থেকে টার্ন তেমন না পেয়েও সুনীল নারিন দেখিয়ে গেলেন তাঁর রহস্য ধরতে এ বার থেকে কোনও প্রদোষচন্দ্র মিত্র বা ব্যোমকেশ বক্সীর দরকার পড়বে। ব্যাটসম্যানে হবে না। বরং রানটা এতটাই কম উঠল যে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে সেটা বড়ই ‘শিশুসুলভ’ দেখাতে লাগল। পরিবর্তিত ইডেন পিচ উল্টে টিম ধোনির কাছে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এল।
ইডেনের নায়ককে গ্যালারির অভিনন্দন। মঙ্গলবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
দ্বিতীয়ত, ধোনি বুঝে গেলেন টি-টোয়েন্টির বাদশাকেও মাঝে মাঝে টি-টোয়েন্টির নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। যে ক্রিকেটের সংজ্ঞা বলে, টিমের সেরা ফিল্ডাররা পাওয়ার প্লে-তে তিরিশ গজি বৃত্তে থাকবে। পাওয়ার প্লে শেষে বাউন্ডারি লাইনের আশেপাশে। সেখানে সিএসকের স্লিপে কে দাঁড়ালেন? না, রবিচন্দ্রন অশ্বিন। রায়না নন। জাডেজা নন। নিদেনপক্ষে ফাফ দু’প্লেসিও নন। মহেন্দ্র সিংহ বলতে পারবেন তো, রায়নাদের চেয়েও অশ্বিন স্লিপে বিশ্বস্ত হাত? বলতে পারবেন তো, ফার্স্ট স্লিপে অশ্বিনের জায়গায় একটা দু’প্লেসি বা জাডেজা থাকলে শুরুতেই কেকেআরের পরাক্রমী মহারথীর ক্যাচ পড়তই পড়ত?
তৃতীয় এবং সবচেয়ে বৃহত্তর কারণ রবিন উথাপ্পা। কর্নাকট-নিবাসী এই ক্রিশ্চান যুবককে নিয়ে যা গল্প আছে ভারতীয় ক্রিকেটমহলে, তা তাঁর বাইশ গজে বর্তমান বিক্রমগাথার চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। রাহুল দ্রাবিড় বেঙ্গালুরুর যে স্কুলে ছোটবেলায় যেতেন, ওই একই সেন্ট জোসেফ বয়েজ স্কুলে রবিন উথাপ্পাও যেতেন। যদিও দু’জনের ব্যাটিং-ঘরানায় ঠিক ততটাই মিল যতটা ওস্তাদ রশিদ খাঁ আর ইয়ো ইয়ো হানি সিংহে! ভারতীয় ক্রিকেটে একসময় রেগুলার ওপেনার স্পটে তাঁকেই ভাবা হয়েছিল। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ক্যাপ্টেন কুলের উত্থানের সময় থেকেই উথাপ্পারও উত্থান। ক্রিকেট সার্কিটে তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল, ‘চলমান অ্যাসাসিন’। মাঝে বহু দিন তাঁর ব্যাটের এমন খুনে মনোবৃত্তি দেখেনি ক্রিকেটমহল, যা আইপিএল সেভেনে দেখছে। মঙ্গলবার নেমেই যে ভাবে সিএসকে বোলিংকে ‘কালবৈশাখী’-র মুখে ছেড়ে দিলেন, প্রকৃতি সে রকম দু’একটা উপহার দিলে এমন অসহ্য দাবদাহে শহরবাসী স্বস্তি পেত! দশটা বাউন্ডারি আর একটা ছক্কা সমেত ৩৯ বলে ৬৭ যে রুদ্রমূর্তি নিয়ে সিএসকে-উপকুলে আছড়ে পড়ল, তার পাশে কোথায় লাগে সুরেশ রায়না। ধোনিকে দেখা গেল, মাঝেমধ্যেই হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। আর ভারতীয় নির্বাচকরা দেখে নিলেন, আসন্ন ইংল্যান্ড সফরে উথাপ্পাকে ভাবার সময় এসে গিয়েছে। ইডেন ধরে গত আট ম্যাচে তিনটে হাফসেঞ্চুরি, তিন বার ম্যান অব দ্য ম্যাচ এর পরেও তাঁকে না ভাবাটা অন্যায়ই হবে।
আজ একটা নয়, বেশ কিছু স্বপ্নের মূহূর্ত ম্যাচে তৈরি হয়েছে। যা আজ পর্যন্ত কেকেআর বনাম সিএসকে ম্যাচে খুব বেশি দেখা যায়নি। ফাফ দু’প্লেসিকে নামতে দেখে অকুতোভয় গৌতম গম্ভীর সোজা হেলমেট নিয়ে সিলি মিড অফে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। প্যাট কামিন্সের হাত থেকে এমন একটা ডেলিভারি বেরিয়েছে যা কি না নভজ্যোত সিংহ সিধুর ভাষায় ‘আইপিএল সেভেন’-এর সেরা। সূর্যকুমার যাদব লং অন থেকে দৌড়ে এসে আবার এমন এক দুর্ধর্ষ ক্যাচ নিয়েছেন যে, স্রেফ ফিল্ডিংয়ের জন্যই তাঁকে টিমে এ বার থেকে সিলেক্ট করে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু এগুলোর একটাও নয়। ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটা তৈরি হল রবিন উথাপ্পাকে নিয়ে। ধোনির কাছে যেটা ‘ডেথ মোমেন্ট’। গম্ভীরের কাছে যেটা ‘মোমেন্ট অব দ্য ম্যাচ’।
কেকআর ইনিংসের প্রথম ওভার চলছে। বেন হিলফেনহসের আউটসুইঙ্গারটা উথাপ্পার ব্যাট ছুঁয়ে উড়ে গেল অশ্বিনের দিকে, ডান দিকে ঝুঁকেও পড়লেন অশ্বিন...।
ইডেন নিস্তব্ধ। অশ্বিন ধরবেন, না ধরবেন না? ধরবেন, না ধরবেন না?
কেকেআর কার্যত প্লে অফে!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
চেন্নাই সুপার কিংস ১৫৪-৪ (রায়না ৬৫, নারিন ১-২৪),
কলকাতা নাইট রাইডার্স ১৮ ওভারে ১৫৬-২ (উথাপ্পা ৬৭, সাকিব ৪৬ ন.আ, জাডেজা ১-২৩)
ধন্যবাদ ইডেন। বেলুনগুলো তোমাদের উচ্ছাসের মতোই উঁচুতে উঠে গিয়েছে। পরের ম্যাচে থাকছি। রাতে সবাই মিলে খুব নাচব। এসআরকে-দা তোমাদের খুব মিস করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy