Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রত্যাবর্তনের পদক্ষেপ

হাজার ডেলিভারি, সতেরো কেজি ও আচরেকর-মন্ত্র

বৃহস্পতিবারের বারবেলায় পঁয়ষট্টি হাজারের ইডেন দর্শক রবিন উথাপ্পার পুনরুত্থানের আরও এক উদাহরণ দেখলেন। দেখলেন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মাথা থেকে অরেঞ্জ ক্যাপ খুলে নিতে! কিন্তু ইনকামিং ডেলিভারিতে ‘ওয়াকিং অ্যাসাসিন’-এর পায়ের মুভমেন্ট কি খেয়াল করলেন কেউ? কেউ বলতে পারবেন, উথাপ্পার ক’টা বল লেগেছে ইনকামিং ডেলিভারি খেলার টেকনিক আয়ত্তে আনতে?

ইডেনে বিধ্বংসী উথাপ্পা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

ইডেনে বিধ্বংসী উথাপ্পা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৪ ০৩:৩৫
Share: Save:

বৃহস্পতিবারের বারবেলায় পঁয়ষট্টি হাজারের ইডেন দর্শক রবিন উথাপ্পার পুনরুত্থানের আরও এক উদাহরণ দেখলেন। দেখলেন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মাথা থেকে অরেঞ্জ ক্যাপ খুলে নিতে! কিন্তু ইনকামিং ডেলিভারিতে ‘ওয়াকিং অ্যাসাসিন’-এর পায়ের মুভমেন্ট কি খেয়াল করলেন কেউ? কেউ বলতে পারবেন, উথাপ্পার ক’টা বল লেগেছে ইনকামিং ডেলিভারি খেলার টেকনিক আয়ত্তে আনতে?

বৃহস্পতিবারের পর আইপিএল সেভেনে কেকেআরের রবিনহুডের মোট রান যে ৫৭২, সবাই জানে। কিন্তু ক’জন জানে, এমন মারণ-ফর্মে ফিরতে উথাপ্পাকে ঠিক কত কেজি ওজন ঝরাতে হয়েছে?

সচিন রমেশ তেন্ডুলকর আর রবিন উথাপ্পার মধ্যে মিল কোথায়? ব্যাটিং ঘরানায় নয়, রেকর্ড বা রানেও নয়। তা হলে?

যে কোনও ক্রিকেট-কুইজে এর পর থেকে ধূর্ত কুইজমাস্টার উপরের তিন মোক্ষম প্রশ্নবাণ ব্যবহার করতেই পারেন। উত্তরগুলো জলবৎ তরলং নয়, যথেষ্ট কঠিন। যথাক্রমে যা হাজার। সতেরো কেজি। রমাকান্ত আচরেকর ও শিবাজি পার্ক!

জীবনের বিগত দু’টো বছর কখনও ভুলতে পারবেন উথাপ্পা? আদৌ ভোলা সম্ভব ফেলে আসা চব্বিশ মাসের কঠোর কৃচ্ছসাধন? যখন চড়া রোদ্দুরে মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে গিয়ে উথাপ্পা পড়ে থাকতেন ঝাড়া দু’ঘণ্টা? রোজ, একা একা? যখন পছন্দের খাবার ছেড়ে দ্বারস্থ হতে হয়েছিল ডায়েট চার্টের? শরীরের উপরের অংশের ওজন বেড়ে গিয়েছিল, যা তাঁর মতো একটু ঝুঁকে স্টান্স নেওয়া ব্যাটসম্যানের পক্ষে প্রবল ঝুঁকির। এক নয়, দুই নয়, এক ধাক্কায় ওজন কমিয়ে ফেলেন সতেরো কেজি। শুধু তাই নয়, জাতীয় প্রত্যাবর্তনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে বানিয়ে ফেলেছিলেন আস্ত একটা টিম! যেখানে ফিটনেস ট্রেনার থেকে ডায়েটিশিয়ান কেউ বাদ ছিল না।

ম্যাড-ম্যাক্সকে ‘সেকেন্ড বয়’ করে অরেঞ্জ ক্যাপ কুক্ষিগত করার পর উথাপ্পা বলছিলেন, ওটা তিনি প্রবীণ আমরেকে উৎসর্গ করতে চান। তাঁর কোচকে। যাঁকে ব্যক্তিগত কোচ হিসেবে নিযুক্ত করাটা উথাপ্পার মনে হচ্ছে, জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত। গুরুদক্ষিণার ব্যাপারটা দেখা গেল আমরেও জানেন। মুম্বই থেকে ফোনে উথাপ্পার ক্রিকেটগুরু আনন্দবাজারকে বলছিলেন, “এতেই বোঝা যায় ওর মন কত বড়। কিন্তু আজকের রবিনের সাফল্য দেখে আন্দাজ পাওয়া যাবে না, কতটা পরিশ্রম ওকে করতে হয়েছে।” শোনা গেল, মানুষ আমরে যতটা ভদ্রলোক, পেশাদার হিসেবে ঠিক ততটাই রূঢ়। শিক্ষার্থী বড় ক্রিকেটার হোক বা রাম-শ্যাম-যদু, রগড়ানির মাত্রা একই থাকে। উথাপ্পার ক্লাস যেমন বসত সকালে। শিবাজি পার্ক বা জিমখানা গ্রাউন্ডে। যেখানে থাকত আনকভারড উইকেট। শোনা গেল ভারতের পূর্বতন ওপেনার তাঁর কোচিং নিতে আগ্রহী হওয়ায় আমরে বলে দিয়েছিলেন, পরিবার ছেড়ে বেঙ্গালুরুতে গিয়ে কোচিং করানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। উথাপ্পাকেই মুম্বই আসতে হবে।

এসেছিলেন উথাপ্পা। পড়ে থাকতেন সচিনের ধাত্রীভূমি শিবাজি পার্কে। যেখানে তাঁর জন্য মাঝে মাঝেই ‘অদৃশ্য’ ম্যাচ সিচুয়েশন তৈরি করে দেওয়া হত। ছুড়ে দেওয়া হত কঠিন লক্ষ্যমাত্রা। বলে দেওয়া হত, ম্যাচে তুমি সব সময় সহজ পরিস্থিতি পাবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাপ নিয়ে ক্রিজে যেতে হবে। অতএব, চাপটা প্র্যাকটিসেই নাও। পুরো ওভার খেলার টেম্পারামেন্ট তৈরি করো। টি-টোয়েন্টি খেলতে নামলে মনে রাখবে, ছ’বলে তোমাকে কিছু করে দেখাতে কেউ বলছে না। তুমি পাবে একশো কুড়িটা বল। ওই কুড়িটা ওভার পুরো খেলে বরং কিছু করে দেখাও। সঙ্গে কানের কাছে ক্রমাগত বাজানো হত আচরেকরের থেকে আমরের পাওয়া ক্রিকেটমন্ত্র। “আচরেকর বলতেন, কোনও অবস্থাতেই নিজের স্বাভাবিক খেলা থেকে সরে আসবে না। যা অদলবদল করার, করবে নিজের সহজাত ক্রিকেটে বদল না করে। সেটা রবিনকেও বলেছিলাম,” বলছিলেন আমরে। যে ‘গুরুকুল’ ধীরে ধীরে সৃষ্টি করেছে পরিবর্তনের রবিনকে। যে ‘গুরুকুল’ শুধরে দিয়েছে তাঁর ইনকামিং ডেলিভারি খেলার টেকনিক। যা আয়ত্ত করতে লেগেছে হাজার-হাজার বল। পরিণাম? যে ডেলিভারিতে আগের উথাপ্পা অবধারিত এলবিডব্লিউ, সেই একই ডেলিভারি আজ বাউন্ডারিতে যায়!

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটা কথা প্রায়ই বলতে শোনা যায়। এক জন ক্যাপ্টেন ততটাই ভাল, যতটা তার টিম। সৌরভের কথার ধাঁচে বোধহয় এটাও বলা যায় যে, এক জন কোচ ততটাই ভাল, যতটা তাঁর ছাত্র। প্রমাণ উথাপ্পা নিজে। আমরে আরও অনেককেই শেখাচ্ছেন, শেখাবেনও। কিন্তু ক’জনই আর রবিন থেকে রবিনহুড হয়ে বেরিয়ে আসবে?

মহাসাফল্যের সমুদ্রে দাঁড়িয়েও যাঁর মধ্যে মহানায়কোচিত অ্যাটিটিউড দেখা যাবে না। বরং ওপেনিং নিয়ে প্রশ্ন করলে বলতে শোনা যাবে, “ওপেনিং নিয়ে প্ল্যানগুলো এখনও ঠিকঠাক চলছে। ওটাই তো আমার ব্রেড অ্যান্ড বাটার!”

রেকর্ডে রবিন

বিশ্বরেকর্ড:

• টানা আট ম্যাচে চল্লিশ বা তার বেশি রান।

• টানা ছ’ম্যাচের আগের রেকর্ড ছিল এইচ ডি অ্যাকারম্যানের (২০০৬)।

আইপিএলে:

• এক মরসুমে টানা আট ম্যাচে চল্লিশ বা তার বেশি রান।

• টানা পাঁচ ম্যাচের রেকর্ড ছিল ম্যাথু হেডেন (২০০৯), বীরেন্দ্র সহবাগ (২০১২) ও মাইকেল হাসির (২০১৩)।

আইপিএল সাতে:

• সবচেয়ে বেশি বাউন্ডারি, ৬৫টি। দ্বিতীয় স্থানে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, ৪৬টি।

• সবচেয়ে বেশি হাফ সেঞ্চুরি। এ দিনের ৮৩ ন.আ. উথাপ্পার পঞ্চম হাফ সেঞ্চুরি (আইপিএলে মোট ১৩টি)। পাঁচটি হাফ সেঞ্চুরি ডেভিড ওয়ার্নার, ডোয়েন স্মিথেরও।

• উথাপ্পার শেষ আট ইনিংস: ৪৭, ৬৫, ৪৭, ৪৬, ৮০, ৪০, ৬৭, ৮৩ ন.আ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rajarshi gangopadhyay ipltag
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE