Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
State News

তীব্র সিন্ডিকেট-খোঁচা, নাম করে কটাক্ষ মমতাকে, সরকার ফেলার ডাক মোদীর

রাজ্য জুড়ে সিন্ডিকেট-রাজের অভিযোগ এত চড়া গলায় তুলবেন মোদী এবং সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্বোধন করে এ ভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়বেন, এমনটা অনেকেই ভাবেননি। বাংলায় এই সরকারের আয়ু আর বেশি দিন নয়— এমন মন্তব্যও এ দিন শোনা গিয়েছে মোদীর মুখে।

বাংলায় এই সরকারের আয়ু আর বেশি দিন নয়— এমন মন্তব্যও এ দিন শোনা গিয়েছে মোদীর মুখে। ছবি: পিটিআই।

বাংলায় এই সরকারের আয়ু আর বেশি দিন নয়— এমন মন্তব্যও এ দিন শোনা গিয়েছে মোদীর মুখে। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৮ ১৮:১৪
Share: Save:

পৌনে দু’মাসের এ পার-ও পার। সে বারও বাংলায় এসে বাংলায় ভাষণ শুরু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এ বারও তাই করলেন। কিন্তু সে বারের সুর এ বারের সুরে আক্ষরিক অর্থেই আকাশ-পাতাল ফারাক। ২৫ মে বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে রাজনৈতিক কথা বলার অবকাশই ছিল না। কিন্তু ১৬ জুলাই মেদিনীপুরে কৃষক কল্যাণ সমাবেশে যে সুর চড়বে, তা এ রাজ্যের রাজনৈতিক শিবির আগেই আঁচ করেছিল। তবে রাজ্য জুড়ে সিন্ডিকেট-রাজের অভিযোগ এত চড়া গলায় তুলবেন মোদী এবং সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্বোধন করে এ ভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়বেন, এমনটা অনেকেই ভাবেননি। বাংলায় এই সরকারের আয়ু আর বেশি দিন নয়— এমন মন্তব্যও এ দিন শোনা গিয়েছে মোদীর মুখে।

কেমন ভিড় হবে নরেন্দ্র মোদীর সভায়? নজর ছিল সব শিবিরেরই। মুখে প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে টেনশনে ছিলেন রাজ্য বিজেপির নেতারাও। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ সভা করে গিয়েছেন সপ্তাহ দু’য়েক আগে। সে সভাতেও চোখে পড়ার মতো সমাগম হয়েছিল। সুতরাং নরেন্দ্র মোদীর সভায় ভিড় হবে না, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই বলেই একাংশ মনে করছিলেন। কিন্তু অমিত শাহের সভা ছিল পুরুলিয়ায়, যে জেলায় পদ্ম বেশ উল্লেখযোগ্য ভাবে ফুটেছে পঞ্চায়েতে। আর নরেন্দ্র মোদীর সভাস্থল পশ্চিম মেদিনীপুরে। সে জেলায় এমন কোনও সাফল্য বিজেপি দেখাতে পারেনি, যাতে কর্মী-সমর্থকদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে থাকতে পারে। সোমবার সকাল থেকে অবশ্য আর জল্পনার প্রয়োজন পড়েনি। অস্বস্তিতে পড়ার মতো অবস্থা যে হবে না, তা রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

যে রাজ্যে সভা, সেই রাজ্যের ভাষায় কয়েকটা লাইন বলা— এটা মোদীর পরিচিত স্টাইল। কিন্তু স্থানীয় ভাষায় কথা বলাটা মূলত সীমাবদ্ধ থাকে ভাষণের প্রথম কয়েকটা বাক্যেই। মেদিনীপুর কলেজ গ্রাউন্ডে কিন্তু সোমবার অন্য মোদীকে দেখা গেল। বাংলায় শুরু, তার পর হিন্দিতে ফেরা, তার পর ফের একটু বাংলা— অন্তত তিন বার বাংলা বললেন মোদী। প্রথমে সম্ভাষণ জানাতে। তার পরে এক বার গত রাতে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ দেখার বিষয়ে সমবেত জনতাকে প্রশ্ন করতে। আর তৃতীয় বার কৃষকের পাশে থাকার বার্তা দিতে— ‘‘বন্ধুগণ, আমার সরকার, আপনাদের সরকার, কৃষক দরদি সরকার।’’

দেখুন ভিডিয়ো

প্রধানমন্ত্রীর মুখে বাংলা শুনে ভিড় উৎফুল্ল হচ্ছিল বটে। কিন্তু উচ্ছ্বাস সবচেয়ে বেড়ে উঠল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী মুখ খুলতেই— ‘‘পশ্চিমবঙ্গের সরকারের হাল কী রকম, আমি ভাল ভাবেই জানি... কৃষক লাভ পান না, গরিবের উন্নতি হয় না, যুবকদের জন্য নতুন সুযোগ নেই।’’ মোদীর কটাক্ষ— পশ্চিমবঙ্গের নতুন পরিচিত হল ‘জগাই উন্নয়ন আর মাধাই উন্নয়ন।’’

আরও পড়ুন: মা মাটি মানুষের নামে এখানে সিন্ডিকেট চলছে, তোপ মোদীর

আরও পড়ুন: বিজেপির সভায় প্যান্ডেল ভেঙে বিশৃঙ্খলা, আহত ৬২, হাসপাতালে গেলেন মোদী

গোটা রাজ্যে সিন্ডিকেট-রাজ চলছে বলে মোদী এ দিন দাবি করেন। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল— কোনও কিছু তৈরি করতে হলে সিন্ডিকেট ঠিক করে দেয়, কাকে বরাত দিতে হবে, কোন দোকান থেকে মালপত্র কিনতে হবে, বলেন প্রধানমন্ত্রী। কৃষক এ রাজ্যে ফসলের দাম পান না, কারণ সিন্ডিকেট মাঝখান থেকে দালালি খেয়ে যায়, দাবি মোদীর। তাঁর সরকার কোন কোন ফসলের সহায়ক মূল্য কতটা করে বাড়িয়েছে, তার হিসেব দেন মোদী। কিন্তু ধান থেকে আলু, কোনও ফসলের ন্যায্য দামই এ রাজ্যের কৃষক পাওয়ার অবস্থায় নেই বলেও মন্তব্য করেন মোদী। কণ্ঠস্বর তুঙ্গে তুলে তিনি বলেন, ‘‘তোলাবাজির সিন্ডিকেট, কৃষকের লাভ ছিনিয়ে নেওয়ার সিন্ডিকেট, বিরোধীদের হত্যার ষড়যন্ত্রের সিন্ডিকেট, গরিবের উপর অত্যাচার করার সিন্ডিকেট, ভোটব্যাঙ্কের জন্য সিন্ডিকেট, ক্ষমতায় যে কোনও মূল্যে টিকে থাকার স্বপ্ন সফল করার সিন্ডিকেট। সব রকম অনৈতিক, সব রকম বেআইনি কাজ করে চলেছে এই সিন্ডিকেট।’’

কলেজে ভর্তি নিয়ে যে দুর্নীতির অভিযোগ এ বার উঠেছে কলকাতা-সহ রাজ্যের নানা প্রান্তে, তাও এ দিন উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। সিন্ডিকেটকে নজরানা না দিলে এ রাজ্যে কলেজেও ভর্তি হওয়া যায় না— মন্তব্য করেন মোদী।

বাংলার শাসক দল এবং প্রশাসনকে একসঙ্গে আক্রমণ করে মোদী বলেন, ‘‘দল আর সরকারে কোনও ফারাক নেই... দল আর প্রশাসন শুধু সিন্ডিকেটের ভাল করার জন্য রয়েছে।’’ রাজ্যকে যে অর্থ কেন্দ্র দিচ্ছে, তা খরচ হচ্ছে কি না, কোন খাতে খরচ হচ্ছে, সে সবের হিসেব দেওয়া হবে কি না, সব সিন্ডিকেটে ঠিক হয়— এমন খোঁচাও শোনা গিয়েছে এ দিন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে।

প্রধানমন্ত্রীর হাতে উপহার তুলে দিচ্ছেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ছবি: পিটিআই।

সিন্ডিকেট প্রশ্নে তৃণমূলকে তথা রাজ্য সরকারে তীব্র আক্রমণ করেই মোদী চলে যান পঞ্চায়েত ভোট প্রসঙ্গে। বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘গণতন্ত্রকে এ রাজ্যে রক্তাক্ত করে দেওয়া হয়েছে, তবু আপনারা সাহস হারাননি, আপনারা সোজা দাঁড়িয়ে থেকেছেন, এটাই বাংলার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা নিয়ে এসেছে।’’ গণতন্ত্রের উপরে তৃণমূলের ভরসা নেই, আদালতের উপরে ভরসা নেই, দেশের সব আদালত এ রাজ্যের সরকারকে তিরস্কার করে— এমন কথাও এ দিন শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখে। সে প্রসঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ, ‘‘দেওয়ালের লিখন পড়ে নিন— সব অত্যাচারীর বিদায় নিশ্চিত।’’

বামেদেরও এ দিন তীব্র আক্রমণ করেছেন মোদী। কয়েক দশকে বাংলাকে বামেরা বেহাল করে দিয়েছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন। তৃণমূল গত আট বছরে রাজ্যের হাল আরও খারাপ করে দিয়েছে বলেও তাঁর দাবি। তবে বামেদের সরাতে যতটা সময় লেগেছিল, তৃণমূলকে সরাতে ততটা লাগবে না বলে মোদী মনে করছেন। ‘কয়েক মাসের মধ্যেই’ বাংলা তৃণমূলের শাসন থেকে মুক্ত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। ত্রিপুরা যে ভাবে বামেদের প্রত্যাখ্যান করেছে, সে ভাবে বাংলাকেও এগোতে হবে— ‘পরামর্শ’ মোদীর।

বিজেপির টুইটার পেজের সৌজন্যে।

নিজের ভাষণের শুরুতে এবং শেষে নাম করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ দিন কটাক্ষ করেন মোদী। গোটা মেদিনীপুর শহর জুড়ে তৃণমূলের ব্যানার এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি যে ভাবে লাগানো হয়েছে, তা নিয়ে প্রথম কটাক্ষটি করেন প্রধানমন্ত্রী। রাস্তার দু’ধারে নিজের ছবি লাগিয়ে যে ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন, তাতে তিনি কৃতজ্ঞ— মুচকি হাসি নিয়ে মন্তব্য প্রধানমন্ত্রীর। আর শেষের কটাক্ষটা সভাস্থলের দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে। মোদীর ভাষণ শুরু হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই এ দিন সভাস্থলের তিনটি ছাউনির একটি ভেঙে পড়ে। তাতে অনেকেই জখম হন, ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়, মাঠের একটা দিকে বড়সড় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। মোদী নিজের ভাষণ থামিয়ে দেন। অন্য ছাউনিগুলির রেলিঙে যাঁরা উঠেছেন, তাঁদের সকলকে নেমে পড়তে বলেন তিনি। কয়েক মিনিট পরে ফের ভাষণ শুরু করেন। ভাষণের শেষ প্রান্তে পৌঁছে মোদী নিজেই দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ টানেন এবং বলেন, নিজের রাজ্য গুজরাতেও এই শৃঙ্খলা তিনি দেখেননি। মাঠের এক-তৃতীয়াংশের ছাউনি ভেঙে পড়ল, অনেককে বাইরে নিয়ে যেতে হল, বাকিরা সে কাজে হাত লাগালেন, কিন্তু তার পরেও মাঠের বাকি অংশ সুশৃঙ্খল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকল, কেউ নড়ল না, শান্তিপূর্ণ ভাবে সভা চালিয়ে গেল— এমনটা ভাবাই যায় না বলে মন্তব্য করেন মোদী। ‘‘বাংলার মানুষের নতুন এক শক্তি আজ আমি দেখলাম’’, বলেন তিনি। সে প্রসঙ্গেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে বলেন— ‘‘দিদি, এই দম দেখে নিন। এই সাহস দেখে নিন। এই শৃঙ্খলা দেখে নিন। প্রাকৃতিক দুর্যোগও যাঁদের নড়াতে পারল না, আপনার জুলুম তাঁদের কী করতে পারবে?’’

ভাষণের শেষ পঙ্‌ক্তিতে আবেগপ্রবণ মোদীর মন্তব্য, ‘‘বাংলার মানুষের পা যত বারই স্পর্শ করি, যথেষ্ট হবে না।… এই সভা সারা জীবন আমার মনে থাকবে। বাংলাকে, বাংলার জনতাকে, বাংলার বিজেপি কার্যকর্তাদের শত শত প্রণাম।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE