সপ্তাহখানেক আগে খবরটা পড়ে অনেকেই হা হয়ে গিয়েছিলেন। খবরে ছিল অভিনয়ে সুযোগ করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে এক উঠতি অভিনেত্রীকে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন নামকরা সংস্থার এক বিজনেস ম্যানেজার। স্বাভাবিক ভাবেই খবরে সরাসরি কোনও ‘কোট’ ছিল না। রুপোলি জগতের এই অন্ধকার দিকটার কথা কেউ ‘অন দ্য রেকর্ড’ বলে না!
কিন্তু খবরটা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, পুরনো সেই সমস্যার সুরাহা এখনও হয়নি। কাস্টিং কাউচ, মানে সিনেমায় বা অন্য কোনও প্রজেক্টে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে শারীরিক সম্পর্ক অভিনয় জগতে প্রায় শুরু থেকেই চলে আসছে।
হলিউডেই দেখুন না। পৃথিবীর সেরা অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন চার বার বিয়ে করেছেন। মিলড্রেড হ্যারিস, লিটা গ্রে, পাওলেট গডার্ড, ওনা ও’নীল প্রত্যেককেই কিন্তু চ্যাপলিন তাঁর পরের ছবিতে অভিনেত্রী হিসেবে ভেবেছিলেন। ওনা’র ক্ষেত্রে তো ছবিটাই হল না। ছবিটা হওয়ার আগেই চ্যাপলিনকে আমেরিকা ছাড়তে হয় কমিউনিস্ট মনোভাব পোষণের জন্য। ইংল্যান্ডের এক গরিব পরিবারে ক্যাথলিক মূল্যবোধে বড় হয়েছিলেন চ্যাপলিন। ফলে ‘ক্যাজুয়াল সেক্স’য়ে সায় ছিল না তাঁর। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর নায়িকদের ছেড়ে দিতে পারেননি। বরং তাঁদের বিয়ে করেন চ্যাপলিন।
কিন্তু সেটা তো সব প্রযোজক, পরিচালক বা কাস্টিং এজেন্টের ক্ষেত্রে হয়নি! ভারতে কাস্টিং কাউচ বিতর্কে নৈতিকতার প্রশ্ন এসে পড়ে। ভারতীয়রা যে মূল্যবোধে বড় হন, সেখানে লাভ মেকিং পরবর্তী অধ্যায় প্রতিশ্রুতির দিকে নিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই সিনেমায় কাজের জন্য করা ‘কমপ্রোমাইজ’ অভিনেত্রীদের উপরই অপরাধবোধের বোঝাটা চাপিয়ে দেয়।
তবুও কাস্টিং কাউচ হয়েই চলে। এখন যেটা চমকে দেওয়ার মতো, তা হল, কাস্টিং কাউচ এ বার ‘কর্পোরেট টার্ন’ নিয়েছে। বলিউডে যখন কর্পোরেট আধিপত্য শুরু হল, লোকে ভুল করে মনে করেছিলেন কাস্টিং কাউচের মতো ঘটনা পেশাদারিত্বের কাছে হেরে যাবে। কিন্তু না, তার রূপটাই খালি বদলে গিয়েছে।
কিন্তু এ নিয়ে খবর করতে গেলে কোনও সরাসরি ‘কোট’ পাবেন না। মুখ খুললেই যে ফিল্ম কেরিয়ার যাবে রসাতলে। যদিও ‘অফ দ্য রেকর্ড’ বলার লোকের অভাব নেই। “ট্যালেন্ট বা বিজনেস ম্যানেজাররাই মেয়েদের পণ্য হিসেবেই তুলে ধরে। বিকিনি পরে কোনও হাই প্রোফাইল ফোটোশ্যুট হোক কী ফিল্মে ব্রেক পাওয়া উঠতি অভিনেত্রীদের তাঁরা বলেই থাকেন ‘কমপ্রোমাইজ’ করতেই হবে। সত্যি বলতে, অনেক মেয়ে সেটা করেও,” প্রথম সারির এক পাবলিসিস্ট বললেন।
“সব থেকে মজার হল, মহিলা ট্যালেন্ট ম্যানেজাররাও একই কথা মডেলদের বলেন। আমি একজন ট্যালেন্টেড অভিনেত্রীকে জানি, যাঁকে এক ফিল্মমেকারের জন্য ‘অ্যাডজাস্ট’ করতে বলা হয়। যোগা আর ফিটনেস ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ সেই ব্যক্তি প্রথম বারের জন্য পরিচালনায় এসেছিলেন। মুখের উপর না করে দেন সেই অভিনেত্রী। কারণ সেই পরিচালকের তখনও তেমন নামডাক হয়নি! এমনটাও হয়,” বলছিলেন আর এক পাবলিসিস্ট।
দুই ট্যালেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির তরুণী মহিলা ক্লায়েন্টরা তো একা একা সেই কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে মিটিংয়ে যাওয়াও এড়িয়ে চলতেন। “যখন তখন জড়িয়ে ধরত আর অস্বস্তিকর ভাবে কাছে চলে আসত,” এক কর্মী বলছিলেন। মানে সর্বসমক্ষে এমন কাজ করতেও কর্তারা পিছপা হতেন না। দুঃখের হল, এ সব মেনে নিলেও যে ফিল্মে কাজ পেয়ে যাবেন, তার কোনও গ্যারান্টি কিন্তু নেই। তবুও কোনও অভিনেত্রী মিডিয়াতে বা সহকর্মীদের সে কথা জানাবেন না।
কাস্টিং কাউচ সব থেকে খারাপ দিকে মোড় নেয়, যখন বিজনেস ম্যানেজাররা এর মধ্যে এসে পড়ে। সাধারণত, এখন অভিনেত্রীরা একটা করে ছবির বদলে ট্যালেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে এক বছরের চুক্তি করেন। ফলে বিভিন্ন সূত্র থেকে আসা সারা বছরের রোজগার দেখভাল করেন বিজনেস ম্যানেজাররা। তাঁরাই অভিনেত্রীদের রোজগার নিয়ন্ত্রণ করেন। নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অভিনেত্রীদের বিজনেস ম্যানেজারদের উপরই নির্ভরশীল থাকতে হয়।
আগের প্রযোজক বা পরিচালকরাও যে একেবারে ধোওয়া তুলসী পাতা ছিল, তেমনটা নয়। নব্বইয়ের দশকে পর পর অনেক ব্লকবাস্টার ছবি করেছিলেন এক পরিচালক। এখন অবশ্য বক্সঅফিসে তাঁর খরাই চলছে। নতুন কমেডির জন্য সেনসুয়াস নায়িকার খোঁজ করছিলেন তিনি। বিদেশে জন্ম, এমন এক অভিনেত্রীকে তিনি সরাসরি ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’য়ের প্রস্তাব দেন। এ দিকে সেই অভিনেত্রীর বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে, এমনকী তাঁর স্বামীই হলেন তাঁর ম্যানেজার। নব্বইয়ের দশকের সেই পরিচালক এ বেলায় আর সফল হতে পারলেন না। কিন্তু তার মানে তিনি চেষ্টা করা ছেড়ে দিলেন, তেমন তো নয়!
সব ফিল্মমেকার বা ট্যালেন্ট ম্যানেজাররাই যে শারীরিক সুবিধা নিতে চান, তা নয়। অনেকেই এই অবস্থায় ভীষণ বিরক্ত। অনেকেই এখন স্পষ্ট ভাবে ‘না’ বলা শুরু করেছেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় সম্পর্কে যাওয়া আর মেনে নেওয়ার মধ্যের সীমারেখাটা ভীষণ পাতলা। বাইরের থেকে সেটা দেখলে তা বোঝা যাবে না।
দু’বছর আগের ঘটনা। মার্ডার মিস্ট্রি নিয়ে এক ছবির অডিশনে সাত জন মেয়ে শর্টলিস্টেড হয়েছেন। সহকারী পরিচালক সেই সাত জনকে জানিয়ে দিলেন ‘কিছু কমপ্রোমাইজ করতে হতে পারে’। সে কথা শুনেই চার জন বেরিয়ে গেলেন। বাকি তিন জনের একজন ৩০ মিনিট রুদ্ধদ্বার ‘মিটিং’য়ের পর সেই ছবিতে সুযোগ পান। শ্যামলাবর্ণা সেই অভিনেত্রী আজ উঠতি তারা। অনেক সেনসুয়াল ফোটোশু্যট আর মাল্টিস্টারার কমেডিতে অভিনয় করে নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়িয়ে নিয়েছেন অনেকটা।
তবে অনেক অভিনেত্রীর মতে ছবিটা আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছে। “আমি আর আমার বন্ধুরা কোনও দিন এমন অবস্থার সামনে পড়িনি। আমরা তো অনেক কাস্টিং ডিরেক্টরদের সঙ্গে কাজ করেছি,” বলছিলেন ‘সিটি লাইটস্’ ছবির অভিনেত্রী পত্রলেখা।
এখন যে সব ফিল্মমেকার আসছেন, যাঁদের কোনও ফিল্মি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই তাঁরা এমন কাস্টিং কল করেন না। অভিনেত্রী-সহকারী পরিচালকদের সঙ্গে টুকটাক প্রেম করলেও, শারীরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নায়িকা নির্বাচন করেন না তাঁরা।
চোখে রুপোলি জগতে নাম করার স্বপ্ন নিয়ে মুম্বই আসা অনেক তরুণীই পুরুষপ্রধান হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির শারীরিক চাহিদার আগুনে জ্বালানির জোগান দেয়। সেলিব্রিটি নায়িকা না হলেও, বাসনা তৃপ্ত করার অভিনেত্রীর অভাব হয় না কর্পোরেট কর্তা বা পরিচালক-প্রযোজকদের।
দিল ধড়কানে দো: ফারহান আখতারদের সঙ্গে প্রিয়ঙ্কা চোপড়া।
সঙ্গে আছি: ইউনিসেফ-এর নতুন অ্যাপের উদ্বোধনে নেইমার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy