Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

যা বীরেন্দ্র সর্বভূতেষু

এখনও তাঁকে মানুষ চেনে শুধুই মহালয়া দিয়ে! অথচ অসীম প্রতিভাধর মানুষটির অনায়াস যাতায়াত ছিল কত বিচিত্র ক্ষেত্রে! যাঁর শেষবেলা কেটেছে সতীর্থদের অনাদরে, অবহেলায়, অপমানে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বহু অজানা কাহিনি বললেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জগন্নাথ বসু১৯৭৬ সাল। আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে উত্তমকুমারকে দিয়ে করাবেন। তাঁদের গোপন বৈঠকে বাদ পড়লেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এই নতুন উদ্যোগ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বীরেনদা। পরিবর্তিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। ভদ্রলোক ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান। নির্দিষ্ট দিনে রেডিয়োয় বাজল নতুন অনুষ্ঠান ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। এবং চূড়ান্ত ফ্লপ।

অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অনুলিখন: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

১৯৭৬ সাল। আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে উত্তমকুমারকে দিয়ে করাবেন। তাঁদের গোপন বৈঠকে বাদ পড়লেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

এই নতুন উদ্যোগ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বীরেনদা। পরিবর্তিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। ভদ্রলোক ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান। নির্দিষ্ট দিনে রেডিয়োয় বাজল নতুন অনুষ্ঠান ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। এবং চূড়ান্ত ফ্লপ।

সমালোচনার ঝড় উঠল। বেতার অফিস ভাঙচুর হল। অফিসের সামনে লোকে গালিগালাজ করতে লাগল। অনেকের এমনও মনে হয়েছিল যে মহালয়ার পুণ্য প্রভাত কলুষিত হল! এ বার বুঝি অমঙ্গল কিছু ঘটবে!

উত্তমকুমার কিন্তু এ দায়িত্ব নিতে চাননি। তিনি বীরেনদার কাছে গিয়ে তাঁর অস্বস্তি ও অযোগ্যতার কথাও বলেছিলেন। বীরেনদা অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করে উৎসাহই দিয়েছিলেন।

সম্প্রচারের দিন খাটে বসে ছেলের সঙ্গে মন দিয়ে বীরেনদা শুনেছিলেন উত্তমকুমারের মহালয়া। সবটা শোনার পরে বীরেনদা নাকি শুধু এটুকুই বলেছিলেন, “লোকে যদি নেয় নিক।” এ কথা শুনেছি বীরেনদার পুত্র প্রদ্যোৎকুমারের কাছে।

বেতার কর্তৃপক্ষ একেবারে গোপনে বীরেনদাকে কিছু না জানিয়ে এই নতুন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, “ওরা একবার আমায় জানালোও না। আমি কি নতুন কিছুকে কোনও দিন বাধা দিয়েছি?”

বহু মানুষের চাহিদায় সে বছরই ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণর মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার করা হয়। আশ্চর্যের কথা হল, এই সম্প্রচার হবে শুনে অভিমান, ক্ষোভ সব ভুলে বীরেনদা কাজে নেমে পড়েছিলেন।

প্রথম দিকে টেপরেকর্ডিং করা অনুষ্ঠানের চল হয়নি। আকাশবাণী-তে সব অনুষ্ঠানই হত লাইভ। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে যাঁরা অংশ নিতেন তাঁরা অনেকেই আগে মহড়ার জন্য চলে আসতেন বেতারে। মহড়ার অবসরে চলত চা-পান, রঙ্গরসিকতা। একবার হয়েছে কী, যথারীতি কেউ আড় হয়ে শুয়ে পড়েছেন, তো কেউ বা ঘুরছেন এদিক-সেদিক। বাণীকুমার বসে আছেন রেকর্ডিং-এ।

ও দিনের আগে ভাষ্য অংশ পাঠ করা হত স্বাভাবিক কথ্যভঙ্গিতে। সুরে নয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর নিজস্ব ধারায় চণ্ডীপাঠ করছিলেন সুরেলা কণ্ঠে। হঠাৎই অলস রসিকতার ছলে বাংলা ভাষ্যটিও স্তোত্রের সুরের অনুকরণে বলতে শুরু করলেন। তাতে চারিদিকে বেশ একটা মৃদু হাসির ভাব জাগল। ...কিন্তু বাণীকুমার দ্রুত রেকর্ডিং রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “আরে আরে থামলে কেন? বেশ তো হচ্ছিল! হোক! হোক না ওই ভাবেই...।” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ হেসে বললেন, “আরে না না একটু মজা করছিলাম!” কিন্তু বাণীকুমার গভীর আগ্রহ নিয়ে বললেন,“মোটেই না! দারুণ হচ্ছিল! ওইভাবেই আবার করো তো।” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আবার শুরু করলেন, “দেবী প্রসন্ন হলেন...।”

সেদিনই বাংলার ইতিহাসে সংযুক্ত হল এক নতুন মাত্রা। অন্য ধারায় মহালয়ার পাঠ। দুর্গাপুজোর কার্টেন রেজার! এক হলদে রঙের রোদ্দুরে মায়া যেন! শরৎ এসে হাজির হয় পুজোর আকাশে। অনেকের বাড়িতে এক সময় রেডিয়ো এসেছিল মহালয়ার আগমনী হিসেবেই, আর এই রেডিয়ো বলতে আমরা বুঝতাম তখন ওই মানুষটিকে। যাঁর নাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

দেশে-বিদেশে মহিষাসুরমর্দিনী নিয়ে এত উচ্ছ্বাস, অথচ বীরেনদা কিন্তু সে সবে বিন্দুমাত্র সাড়া দিতেন না। বলতেন, “বেশ মজা আর কি, পুরাণ পড়ব না, চণ্ডীপাঠ করব না, শুধু বৈঠকখানায় বসে স্টিরিয়োতে মহিষাসুরমর্দিনী শুনে কর্তব্যকার্য শেষ। কাজীদা (নজরুল) হলে কী বলতেন জানো? বলতেন, দে গরুর গা ধুইয়ে, যত্তোসব!”

স্টাফ আর্টিস্ট হয়েই অবসর নিয়েছিলেন বীরেনদা। পেনশন জোটেনি। আসলে আখের গোছানোর কথা কখনও তো ভাবেননি। অবসরের পরে, শেষ পর্যন্ত ‘মহাভারতের কথা’ বলার জন্য ক’টা টাকা পেতেন। ক্রমশ স্মৃতিভ্রংশ হয়ে আসছিল। তাতে অস্বস্তিতে পড়ছিলেন তখনকার প্রোগ্রাম অফিসার। সেই অনুষ্ঠানও আর করানো গেল না! তখন অর্থাভাব মেটাতে পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে বেড়াতে লাগলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেখান থেকেও যে বেশি কিছু পেতেন, তা’ও নয়। সামান্য কিছু জুটত।

বড় অভিমান ছিল তাঁর। মুখে কিছু বলতেন না, আমি বুঝতাম কেন এই অভিমান। আকাশবাণীর এমেরিটাস প্রোডিউসার-এর মতো সম্মাননার পদ জোটেনি তাঁর। বলতে গেলে কিছুই মেলেনি, না কোনও সরকারি খেতাব, না পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ। মিলেছে তো কেবল গুচ্ছের চাদর আর উত্তরীয়!

রেডিয়ো-র মস্ত দায় বয়ে বেড়িয়েছেন চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত। অথচ এমন মানুষকেও কী ভাবে যে বারবার অপমানের মুখে পড়তে হয়েছে! একবারের কথা বলি। অবসর নেওয়ার পর রেডিয়ো-য় কী একটা কাজে এসেছিলেন বীরেনদা। ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলেন। সিংহ নামের একজন সিকিউরিটি গার্ড বীরেনদার কাছে ‘পাস’ চেয়ে বসল। সেদিন মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল ওঁর, থরথর করে কাঁপছিলেন, ফর্সা চেহারায় শিরাগুলো দপদপ করছিল।

কেবলই চিৎকার করে বলছিলেন, “জন্ম দিয়েছি রেডিয়োকে আমি! জন্ম দিয়েছি! আমিই জন্ম দিয়েছি! আমার কাছে পাস চাইছ? পাস?” মনে হচ্ছিল এ শুধু চিৎকার করে ক্ষোভ উগরে দেওয়া নয়, এর গভীরে কি লুকিয়ে আছে কান্নাও? দৃশ্যটা আজও কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারি না।

আকাশবাণী-তে বীরেনদা একটা ঘোরানো চেয়ারে বসতেন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ আমায় সেই চেয়ারটাই ব্যবহার করতে বলেছিল। শুনে আঁতকে উঠেছিলাম। অসম্ভব! এ আমি কিছুতেই পারব না। কোনও ভাবেই রাজি হইনি। তখন অন্য চেয়ার এসেছিল। আর কী আশ্চর্য দেখুন, কালে কালে কিংবদন্তি ওই মানুষটির স্মৃতি জড়ানো সেই চেয়ারটির ঠাঁই হল আকাশবাণী-র অন্ধকার স্টোররুমে!

অবসরের পরেও বীরেনদাকে দেখেছি আকাশবাণী-তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কাজ নেই....এ ঘর...ও ঘর করছেন। বড় মায়া ছিল যে বাড়িটির প্রতি! বীরেনদাকে ও ভাবে ঘুরতে দেখে আমার কেবলই মনে হত, এ কি সেই জলসাঘর-এর বিশ্বম্ভর রায়? ক্রমক্ষীয়মাণ জামিদারি জমানার শেষ প্রতিভূ! নিজের সাম্রাজ্যকে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। হারানো দিনগুলো ফিরে পেতে চাইছেন।

নিজেদের পরিবার নিয়ে খুব গর্ব ছিল বীরেনদার। জন্মেছিলেন ১৯০৫-এর ৪ অগস্ট। কলকাতার আহিরীটোলায়। বলতেন, “আমরা ছিলুম সুন্দর চেহারার পরিবার। আমাদের চেহারা যেমন চমৎকার ছিল, রংও ছিল টকটকে ফর্সা। বাবা সুন্দর মুখ পছন্দ করতেন।

আমার বন্ধুদের মধ্যে ভাল চেহারা যাদের, তাদের ডেকে নিয়ে কথা বলতেন। যাদের চেহারা অন্যরকম, তাদের দিকে ফিরেও চাইতেন না।”

ঠাকুমা যোগমায়া দেবীর কাছেই বীরেনদার সংস্কৃত শিক্ষা। সেখান থেকেই বোধহয় ‘চণ্ডীপাঠ’-এ মন গিয়েছিল বীরেনদার। স্মৃতি এতই প্রখর ছিল যে আট বছর বয়সে চণ্ডীপাঠ করে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন।

ঠাকুমাই শেক্সপিয়ার আর গিরিশচন্দ্রর নাটক পড়ে পড়ে শোনাতেন ছোট্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে। ১৯২৮ সালে স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। তারই ফাঁকে ফাঁকে চলেছিল কম্বুলিয়াটোলায় ‘চিত্রা সংসদ’ ও সাহিত্যিসাধক নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত প্রতিষ্ঠিত ‘অর্ধেন্দু নাট্য পাঠাগার’-এ গানবাজনা ও অভিনয় চর্চা।

১৯২৮-এ ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের সদর দফতরে যোগ দিয়েছিলেন বীরেনদা, কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকত ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসের বেতার কেন্দ্রে। চাকরি তো করতেন, কিন্তু যেই না দুপুর গড়াল, টিফিনের সময় বা বিকেলে ছুটির পরে, বাবু পৌঁছে যেতেন রেডিয়োর বন্ধু-আড্ডায়।

সেখানে তখন জমাটি আসর। যার মধ্যমণি ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। সেই আসরও মাত করতেন বীরেনদা নিজের কথা দিয়ে। খুব সুন্দর কথা বলতেন তো! এই আসর থেকে ধীরে ধীরে বেতার নাটকে সুযোগ পেয়ে গেলেন বীরেনদা। প্রথমবারেই তাঁর পরিচালনায় নাটকে অভিনয় করলেন বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক, পশুপতি চট্টোপাধ্যায়। ১৯২৮-এর ২৬ অগস্ট বেতারে সম্প্রচার হল ‘চিকিৎসা সংকট’ (রচনা পরশুরাম)। সেই সময় ঘটল এক যুগান্তকারী ঘটনা। স্টেশন ডিরেক্টর তখন নৃপেন মজুমদার। তাঁর ডাকেই ১৯২৮-এ বীরেনদা রেডিয়োয় সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেন। তার পর থেকে কী না করেছেন রেডিয়োর জন্য।

নলিনীকান্ত সরকারের কাছে পাওয়া একটি ঘটনা বলি। তিনি বলছেন, “বর্ষাকাল। বৃষ্টির জন্য বাড়ি থেকে বেতারের কেউই বেরোতে পারেনি। সন্ধ্যা নাগাদ বৃষ্টির তোড় আরও বাড়ল। রেডিয়োটা চালালাম। বীরেন্দ্র ভদ্রের কণ্ঠে ঘোষণা। বললেন, ‘এ বার একটু পিয়ানো শুনুন’। বুঝতে পারলাম, প্রথম আর্টিস্ট আসেননি। পিয়ানো বাজিয়ে অভাব পূরণ করলেন বীরেন্দ্র ভদ্র। দ্বিতীয় আর্টিস্টও অনুপস্থিত। বীরেন্দ্র ভদ্র ঘোষণা করলেন এ বার রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাহুল্য এ বার গায়কও বীরেন্দ্র ভদ্র।”

আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে। নৃপেন মজুমদার মশাই জামাইষষ্ঠীর দিনে অভিনয় করার জন্য এক ভদ্রলোককে একটি প্রহসন লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। ‘আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি’ করে প্রায় দিন পনেরো পেরিয়ে গেল। নাটক আর লেখা হয় না। এ দিকে জামাইষষ্ঠী এসে পড়ল বলে। শেষমেশ ঠিক আগের দিন, বীরেনদা প্রহসনটি লিখতে বসেন। মাত্র একদিনে একটি বই শুধু লিখে ফেলেননি তিনি, যেদিন সন্ধ্যায় নাটকটি অভিনীত হবে সেদিন চার-পাঁচটি গান লিখে, নিজে সুর দিয়ে কুশীলবদের শিখিয়েও দিয়েছিলেন। নাটকটির নাম ছিল ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’। যার প্রশংসা আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে।

১৯২৯ সাল। রেডিয়োর প্রথা ভেঙে একেবারে অন্য রাস্তায় হাঁটলেন বীরেনদা। মহিলাদের জন্য ‘মহিলা মজলিস’ আরম্ভ করেছিলেন ‘মেঘদূত’ ছদ্মনামে। পরে যদিও তিনি ‘শ্রীবিষ্ণুশর্মা’ ছদ্মনামে অনুষ্ঠান প্রচার করেন। বীরেনদা এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। শ্রোতাদের চিঠিপত্র পড়ে শোনাতেন। পিয়ানো বাজাতেন। মহিলাদের মতামত চাওয়া হলেও বলে দেওয়া হত, মহিলারা যেন ব্যক্তিগত কথা জানিয়ে পত্র না লেখেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে এই অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক ওঠে। মহিলাদের কী করা উচিত, বলা উচিত তা বিষ্ণুশর্মা কেন ঠিক করে দেবেন? বহু লোক সে সময় রেডিয়ো স্টেশনে এসে বিষ্ণুশর্মাকে দেখতে চাইতেন। কিন্তু বিষ্ণুশর্মারূপী বীরেন্দ্র ভদ্র আগ্রহী শ্রোতাদের কাছে অধরাই ছিলেন।

রেডিয়ো ছাড়া তো তখন অন্য কোনও বিনোদন মানুষের ছিল না। আর রেডিয়োয় তখন থিয়েটারের ভূত চেপেছিল যেন। বীরেনদাও সেই পথে হেঁটেছিলেন। কিন্তু বীরেনদাকে এক্কেবারে নতুন করে সব কিছু করতে হয়েছিল। তাঁর সামনে তো কোনও কাঠামো ছিল না। কাজ করতে করতে বীরেনদাকে খুঁজে বার করতে হয়েছিল রেডিয়ো নাটকের নিজস্ব ভাষা। কেমন করে পাতা ওল্টাতে হবে, যাতে পাতা ওল্টানোর আওয়াজ না শোনা যায়। সংলাপ বলার সময় চোরা দম কেমন করে নিতে হয়। শুধু কণ্ঠস্বর দিয়ে রাগ, দুঃখ, ভালবাসা সমস্তই প্রকাশ করতে হয় কেমন করে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে কেমন করে মাইক্রোফোন থেকে দূরে গিয়ে সংলাপ বলতে হয়, সব বীরেনদা আমাদের শিখিয়েছেন। শিক্ষা দেওয়াতে ওঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। কখনও ধমকাতেন, কখনও ভালবাসতেন, কেউ ওঁর মুখের ওপর কথা বলার সাহস দেখাতে পারত না।

১৯৩১-এর ৮ মে বেতারে অভিনীত হল ডি এল রায়ের ‘সাজাহান’ নাটক। সে এক মনে রাখার মতো ঘটনা! বীরেন্দ্রকৃষ্ণ (আওরঙজেব),অহীন্দ্র চৌধুরী (সাজাহান), দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (দারা), নিভাননী (জাহানারা), মিস বীণাপাণি (পিয়ারী)। সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনীত গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শচীন সেনগুপ্ত প্রমুখ দিকপাল নাট্যকারদের বহু নাটক বীরেন্দ্রকৃষ্ণর প্রযোজনায় বেতারস্থ হয়েছে। অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, সরযূবালা দেবীকে দিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অভিনয় করালেও ওঁর মুখেই শুনেছি শিশির কুমার ভাদুড়ী বেতারে নাটক করতে চাননি।

উনি বলেছিলেন, শিশির ভাদুড়ী মাইক্রোফোনের সামনে এসে কেবলই এদিক-ওদিক হাত পা নেড়ে অভিনয় করতে চাইতেন। পরে নাকি বলেছিলেন, ধূর রেডিয়োয় আমি গিয়ে কী করব? সব কেমন বন্ধ, বন্ধ! আমার কিছুই করার নেই!

রেডিয়োতে তাঁর হাত দিয়ে তৈরি হয় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (দ্বিজেন্দ্রলাল), ‘প্রলয়’(শচীন সেনগুপ্ত), ‘প্রফুল্ল’(গিরিশচন্দ্র ঘোষ)-র মতো নাটক। সব কাজেই এত নিখুঁত সম্পাদনার কাজ করতেন, এখনও ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে। তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন রেকর্ডিং প্রথা চালু হয়নি। বাঁধা সময়ের মধ্যে অভিনয় শেষ করতে হত। পুরোটাই লাইভ।

কাগজ দেখে অভিনয় করে চলেছি। আর বেশ বুঝতে পারছি, আজ আর সময়ের তালে চলা হচ্ছে না। অথচ কী করব, নাটক তো থামানোর উপায় নেই। হঠাৎ দেখি, চুপি চুপি বীরেনদা এসে দাঁড়ালেন। একহাতে আমার মুখ চেপে ধরলেন, অন্য হাতে স্ক্রিপ্টের দু পাতা উল্টে আঙুল দিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে দিলেন। আমি সেইমত অভিনয় করলাম। অভিনয় শেষ হল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কলাকুশলীদের নামও বলা হয়ে গেল! কী অদ্ভুত ক্ষমতা! নাটক চলাকালীন তিনি বুঝেছিলেন সম্পাদনা দরকার। তাই এ কাজ করলেন। দু’পাতা বাদ দিলেন। কিন্তু যোগসূত্র ছিন্ন হল না।

বীরেনদার অসম্ভব রকমের এই সব ক্ষমতার জন্য বহু গুণিজন তাঁকে বেশ মান্যি করতেন। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের কথা বলি। একবার তিনি অল্প টাকা দেওয়ার জন্য স্থির করেছিলেন রেডিয়োতে আর অভিনয় করবেন না। তখন বীরেনদা ওঁকে ডেকে ধমকে বললেন, “তুমি কি রেডিয়োতে টাকা রোজগার করতে এসেছ?” ওই এক কথাতেই কাজ হল। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় আর কোনও উচ্চবাচ্চ্য করেননি। রেডিয়োর প্রতি বীরেনদার অমন টান দেখে তিনি আবার রেডিয়োয় চলে আসেন।

বীরেনদার কথায় এটুকু বোঝা যেত যে উনি ওঁর রেডিয়োর শ্রোতাদের কোনও ভাবেই মুহূর্তের জন্যও হাতছাড়া করতে চাইতেন না। স্টেজের আদলে টানটান ডায়লগের ওপর বরাবর জোর দিয়েছিলেন তিনি।

উনি বলতেন, ছেলের দুধ গুলতে গুলতে, অফিসের জন্য রেডি হতে হতে, রান্নায় নুন দিতে দিতে লোকে রেডিয়ো শোনে, ধীর গতির কোনও প্রযোজনা, থেমে থেমে পজ্ নিয়ে উপস্থাপনা রেডিয়োতে চলবে না। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের নাটক নিয়ে যখন রেডিয়োতে কাজ করেছি, তখন সত্যজিৎ রায় কিন্তু আমায় শিখিয়েছিলেন, রেডিয়োতে অ্যাক্টিং-এ পজ্ কতটা জরুরি। বীরেনদা কিন্তু সেটা মানতেন না। বলতেন, অত পজ্ দিলে দর্শক চলে যাবে! ও ভাবে হয় না।

১৯৩৭ সালে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে পরিচালক হিসেবে বীরেনদা কাজ শুরু করলেন। তাঁর প্রথম পরিচালিত নাটক ‘অভিষেক’ রঙমহলে। এর পর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যাযের দুটি নাটক ‘ডিটেকটিভ’ ও ‘বন্ধু’ পর পর পরিচালনা করেন রঙমহলে। বেতারে অভিনয় করলেও মঞ্চে বীরেনদাকে অভিনয় করতে দেখিনি। পরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্ত নাকি বহু বার বীরেনদাকে অভিনয়ের জন্য অনুরোধ করেছেন। প্রতিবারই বীরেনদা এড়িয়ে গিয়েছেন। মজা করে বলতেন, আমি সকলকে রং মাখাব, কিন্তু নিজে মাখব না।

৭ অগস্ট। ১৯৪১। রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন। রেডিয়োয় সে বার অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটালেন বীরেনদা। পুরো শোকযাত্রা শ্রোতাদের ধারাবিবরণী দিয়ে শোনালেন তিনি। তারই কিছু অংশ এখানে না বলে পারছি না। বীরেনদা বলছেন, “ঠাকুরবাড়িতে বেশিক্ষণ শবদেহ রাখার রীতি নেই, বিশেষত মধ্যাহ্নে যিনি প্রয়াণ করেছেন বিকেলের মধ্যে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করতেই হবে। সংবাদ সংগ্রহ করতে করতে আমরাও নিমতলা শ্মশানে এসে হাজির। ও পারে দূরের ওই নীলাকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারে এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হল এক মহপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল অস্তাচলে...।”

একই ভাবে উত্তমকুমারের মৃত্যুরও শোকযাত্রার ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন তিনি। শ্রোতার চোখের জলের বাঁধ ভেঙে পড়েছিল সেই ধারাভাষ্যে।

বীরেনদার এই ধারাবিবরণীর কথা যখন উঠলই, স্টেপলটন সাহেবের জমানার কথায় ফিরে যাই। তিনি তখন রেডিয়োর বড় কর্তা। বীরেন্দ্রকৃষ্ণর ক্ষমতার ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। তো একবার তিনি বললেন, দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের ধারাবিবরণী দিতে হবে। তো কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। কিন্তু এই ধারাবিবরণী দিতে গিয়ে প্রথমে বেশ বিপদে পড়েছিলেন বীরেনদা। তাকেও কী ভাবে বুদ্ধি করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে ছিলেন সে এক গল্প। শোনা যাক, বীরেনদার মুখেই। তিনি বলছেন, “সাজসরঞ্জাম যন্ত্রপাতি নিয়ে আমাকে গঙ্গার ঘাটে যেখানে বসিয়ে দেওয়া হল, সেখান দিয়ে একটা ঠাকুরও যায় না। মাইক ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে ঠাকুর দেখে আসব। আবার ফিরে মাইকে এসে বলব এমন তো হয় না! শেষকালে ভাবলাম, লোকে তো শুনছে, দেখছে না কিছু। আরম্ভ করে দিলাম, ওই ঠাকুর আসছে...চমৎকার ডাকের সাজ...এমনি সব বলে বানিয়ে প্রতিমা বানিয়ে বিসর্জনের বর্ণনা করতে লাগলাম।”

চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া, উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে ঝট করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অমন মানুষ আমি বীরেনদা ছাড়া আর কাউকে দেখেছি কি না সন্দেহ। ওঁকে কেবল বলে দিতে হত, কী বিষয় বলতে হবে। হয়তো বললাম আজ শরীর চর্চা নিয়ে বলতে হবে। মুহূর্তে মাইকের সামনে বলতে শুরু করে দিতেন।

আকাশবাণী-র নিজস্ব একটা কাগজ ছিল। নাম ‘বেতারজগৎ’। ‘বেতারজগৎ’ ছিল বীরেনদার প্রাণ। একবার সরকারের পক্ষ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল সেই কাগজ। তাতেও বীরেনদাকে দমাতে পারেনি। জি পি ও-র সামনে ভরা শীতে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বীরেনদা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘বেতারজগৎ’ বিক্রি করতেন।

বীরেনদার বহুগুণের মধ্যে একটা গুণ ছিল, সময়টাকে নিজের লেখায় সহজে বলে দিতে পারতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে নানারকম অসন্তোষ, ধর্মঘট অচল করে দিচ্ছে কলকাতা। সেই অস্থির দুঃসময়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ‘বিরূপাক্ষ’ ছদ্মনামে সেই সময়কালকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। ব্যঙ্গরসের দৃষ্টিতে।

সে সময় ভোগ্যপণ্য অগ্নিমূল্য। বীরেনদা লিখেছিলেন, “কর্তার মেজ বোনের মেয়ে ভুঁদিটার বিয়ে। তাঁর কলকাতার বাড়িতে মামার বিস্তর ঝঞ্ঝাট। লোকলৌকিকতা কমাবার কথা বললে কেউ আমল দেয় না। তাই বলে চারটে মাসিকে বলা হবে না? মেজপিসিমার ননদরা সব কাজে আমাদের বলে, তাদের না বললে চলে? বড়দির ছোট জা ভুঁদির তিন তিনটে সায়া সেলাই করে দিয়েছে, তাকে বলব না? ছোট ঠাকুমার ভাসুরজিকে না বললে বরণডালা তৈরি করবে কে? ন’মাসির দেওর-ঝিদের না বললে চলে? বড় মামার দুই শালিকে বাদ দিলে আর কী এমন খরচটা কমবে!...আর সত্যি কথা ভুঁদির তো পাঁচবার বিয়ে হচ্ছে না!”

বিরূপাক্ষ আসলে ছাপোষা ন্যায়নীতিগ্রস্ত প্রবীণ বাঙালির কথা। এই সম্প্রদায়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। হাস্যরসের আড়ালে বিরূপাক্ষের কথায় তাঁরা তাঁদের নিজেদের মনের কথা খুঁজে পেয়েছিলেন।

এত ভাল ব্যঙ্গরস লিখতেন, এত ধরনের বিষয়ে, অথচ নিজের লেখা সম্পর্কে মমতা বলে কিছুই বীরেনদার ছিল না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণর অজস্র রচনা বেতারে পড়া হত বলেই কার্যত সে সব হাওয়া হয়ে গেছে। সে সব আগলে রাখার না ছিল বীরেনদার কোনও বাড়তি আগ্রহ, না ছিল অন্য কারও। পুরনো রেকর্ড করা টেপের ওপরেই নতুন অনুষ্ঠান রেকর্ড করা হয়েছে।

ফলে বীরেনদার কত কাজ যে মুছে গেছে, কত লেখা যে হারিয়ে গিয়েছে, তার কোনও হিসেবই নেই। বীরেনদা জানতেন সব। আর ঠাট্টা করে বলতেন, “সংসারের যতটা মজা দেখেছি, তার চেয়ে সংসার আমাকে নিয়ে মজা করেছে বেশি।” এক উদাসী মনের অভিমানও কি ধরা থাকত এমন কথায়? সংসারকে তো উনি কম দিয়ে যাননি। সংসার তাকে দেখল কই!

সংসারটা কি সত্যিই ছল? বীরেনদা হয়তো তাই বলতে চেয়েছিলেন।

প্রতিটি মানুষের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। যেমন মায়ের গায়ের গন্ধ,। সেই গন্ধ কাছে এলে মনে হয়, এটা আমার পরম আশ্রয়ের জায়গা। আকাশবাণী স্টুডিয়োতে মাঝে মাঝে একটা গন্ধ পেতাম, সেই গন্ধটা এলেই বুঝতে পারতাম কাছাকাছি তিনি আছেন।

সেই গন্ধটা আজও আমার পিছু ছাড়েনি।

এই তো সেই গন্ধ হাওয়ায় তাঁকে দেখতে পাচ্ছি... ধুতি-পাঞ্জাবি, চপ্পল পায়ে, গলায় জড়ানো উত্তরীয়, ফর্সা গায়ের রং। তীক্ষ্ন নাসিকা। ব্যাক ব্রাশ চুল। কাঁচা-পাকা মেদবিহীন লম্বা চেহারার মানুষটা। তিনি ট্রাম থেকে নেমে আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাথ দিয়ে সোজা আকাশবাণীর দিকে এগিয়ে চলেছেন।

নাম নয়, চেহারা নয়, আস্ত একটা কণ্ঠ, দিগন্ত ছোঁওয়া আকাশ...

রূপং দেহি, ধনং দেহি, যশো দেহি

শক্তির কাছে সুন্দরের প্রার্থনা!

৭ নম্বর রামধন মিত্র লেন

হাতিবাগান পাড়ার শ্যামপুকুর স্ট্রিট। টাউন স্কুলের পাশে সেই গলি ধরে একটু এগোলোই রামধন মিত্র লেন। সে-রাস্তায় আখাম্বা লম্বা হলদে রঙের সাত নম্বর বাড়িটি নিজেই আস্ত একটা ইতিহাস! পাথরের ফলকে লেখা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর নাম। আর মহিষাসুরমর্দিনী তথা বাংলা সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের কথা। তিনি আমৃত্যু ছিলেন এই বাড়ির বাসিন্দা।

হলদে বাড়ির বিরাট ফটকের কাঠের দরজা পার হলেই উঠোন ঘেরা ঠাকুরদালান। শ্যাওলা ধরা বিষণ্ণ ঠাকুরদালানে কী চণ্ডীপাঠ করেছিলেন বাঙালির চিরকালের বীরেন ভদ্র? ডান হাতে ঠাকুরদালান রেখে বাঁ-হাতের কাঠের সিঁড়ির কয়েক ধাপ পেরিয়েই এক সবুজ দরজার তালাবন্ধ ঘর।

কে আসেননি ওই ঘরে? বিংশ শতকের নাট্য জগতের নট-নটীর কতজনই তো এই ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন। আজ আর কেউ সে ঘর খুলতে চান না! রাস্তার দিকের খড়খড়ির একটি খোলা জানলা অবশ্য চিনিয়ে দেয় ওই ঘরের আলো-আঁধারির রহস্য। চোখে পড়ে দেওয়ালের দিকের একটি সরু খাট। চেয়ার আর আলমারি। আসবাব বলতে ওইটুকুই। কিন্তু বইগুলো সব গেল কোথায়? যত দিন মানসিক আর শারীরিক সামর্থ্য ছিল প্রাণে ধরে বইগুলো কাউকে তো দিতেন না বীরেন ভদ্র। বইই তো ছিল তাঁর আত্মার আত্মীয়। “অগুনতি বই! কে পড়বে? কোথায় রাখব? কারও সময় নেই। কিছু দিয়ে দিয়েছি আমরা, কিছু কোথায় চলে গেছে,” বললেন বীরেন্দ্র ভদ্রের কন্যা সুজাতা ভদ্র।

সেই বাড়িটা। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

ঘর পেরিয়ে কাঠের সিঁড়ি। সেই সিঁড়িতে কোথাও রবীন্দ্রনাথ, তো কোথাও লাল জবা গলায় কালীঠাকুরের ছবি। সিঁড়ি ধরে সোজা তিনতলার ডান হাতের ঘর। সিঁড়ির শব্দ যেন মনে করিয়ে দেয় ধুতি-পাঞ্জাবি গায়ে, চপ্পল পায়ের এক ছায়াকে! এই যেন আকাশবাণী থেকে নিজের ঘরে ফিরলেন তিনি।

ঘরজোড়া বিশাল খাট। সুজাতা বলছেন, “বাবার বিয়ের খাট।” এই খাটে বসেই কি আবৃত্তি করেছেন ‘দেবতার গ্রাস’? ঘরে অনেকগুলো জানলা যা দিয়ে আকাশ ঢুকেছে। ঘরের কোণে ছড়িয়ে আছে ভাদ্রের হলদে রঙের পুজো-রোদ্দুর। ঘর থেকে দেখা যায় ছোট্ট ছাদ। ঠাকুমা যোগমায়া দেবী কোনও এক অলস দুপুরে তাঁর স্নেহের বুশিকে (ডাকনাম) শোনাচ্ছেন শেক্সপিয়ার, গিরিশ ঘোষের নাটক...। “চশমা, কলম সবই তো নিয়ে গেছে মিডিয়ার লোক। আমাদের তো কিছুই নেই!” হতাশ সুজাতা ভদ্র।

হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, “বছরের শুধু এই সময়েই মনে পড়ে? সারা বছর তো কেউ ফিরেও তাকায় না। যত্তো সব!”

কণ্ঠ ভেসে আসে মুখ, দেখা যায় না...

ছবি: সৌজন্যে পরিমল গোস্বামী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE