Advertisement
E-Paper

দূরবিনে চোখ

অগ্রজ সহকর্মীর ফেলে আসা সময়ের গল্পে শঙ্করলাল ভট্টাচার্যশীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তখন রীতিমত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। অথচ আনন্দবাজার বাড়িতে কেউই প্রায় তাঁকে চাক্ষুষ করেননি। যাঁরা বইপড়ার লোক তাঁদের অনেকেই তত দিনে ‘ঘুণপোকা’ ও ‘পারাপার’ পড়ে ফেলেছেন। তা নিয়ে আলোচনা শুনেছেন। চর্চাটা বেগ পেল শীর্ষেন্দু আনন্দ পুরস্কার (১৯৭৩) পাওয়াতে। পার্ক হোটেলে এক দুপুরে ওঁর সেই পুরস্কার প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে খুবই শীর্ণ, লাজুক, প্রায় কিছুই বলতে না-পারা মানুষটাকে দেখে কিছুটা চমৎকৃত হয়েছিলাম।

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তখন রীতিমত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
অথচ আনন্দবাজার বাড়িতে কেউই প্রায় তাঁকে চাক্ষুষ করেননি। যাঁরা বইপড়ার লোক তাঁদের অনেকেই তত দিনে ‘ঘুণপোকা’ ও ‘পারাপার’ পড়ে ফেলেছেন। তা নিয়ে আলোচনা শুনেছেন।
চর্চাটা বেগ পেল শীর্ষেন্দু আনন্দ পুরস্কার (১৯৭৩) পাওয়াতে।
পার্ক হোটেলে এক দুপুরে ওঁর সেই পুরস্কার প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে খুবই শীর্ণ, লাজুক, প্রায় কিছুই বলতে না-পারা মানুষটাকে দেখে কিছুটা চমৎকৃত হয়েছিলাম। ওঁকে পুরস্কার তুলে দিলেন বার্ধক্যেও দিব্যি সুন্দর চেহারার প্রেমেন্দ্র মিত্র। এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে লেখনিযাত্রার এক নিপাট ছবির মতো ছিল সেটা।
এর ক’দিন পর মধ্য কলকাতার এক রেস্তোরাঁয় লেখকরা এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন শীর্ষেন্দুর। ‘কলকাতার কড়চা’য় পড়া গেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেখানে বলেছেন, ‘‘আমাদের প্রজন্মের সব চেয়ে শক্তিমান লেখক শীর্ষেন্দু।’’
সুনীলদার এমন বলাটার তিনটে কারণ ছিল বলে মনে হয় শীর্ষেন্দুর লেখায় মুগ্ধ আমাদের। এক, ওঁর রসালো, শক্তপোক্ত ঔপন্যাসিক ভাষা। দুই, ওঁর গল্প ধরা, ছাড়া, গোটানো (তখন তো আমরা ওঁর গল্পের জোগানের সামান্যই আঁচ পেয়েছি!)। আর তিন, ওঁর লেখায় এক অদ্ভুত দার্শনিক মেজাজ।
শীর্ষেন্দু তখনও আনন্দবাজার-এর চাকরিতে যোগ দেননি। এক দুপুরে দেখলাম আনন্দবাজার-এ গেটের গায়ে কেষ্টর পান-সিগারেটের দোকান থেকে (এখন নেই) ক’টা খুচরো সিগারেট কিনছেন ভদ্রলোক। খুব অন্যায় করছেন এমন একটা ভাব যেন মুখে।

দৃশ্যটা বর্ণনা করেছিলাম শক্তিদাকে (চট্টোপাধ্যায়)। তাতে শক্তি বললেন, ‘‘অ্যাদ্দিন ওঁর গুরুর নির্দেশ ছিল গঙ্গার ও পারে থাকার। এখন নির্দেশ হয়েছে এ পারে আসার। তাই মাঝে মাঝে লেখাপত্তর দিতে আপিসে আসছে।’’

ওঁর জীবনের এই গঙ্গা পারাপারের ব্যাপারটা ওই প্রথম শোনা হল। তার আগে ওঁর জীবনের ভাগাভাগিটা রেডিয়োতে ওঁর পড়া একটা গল্পের স্মৃতিতে করতাম। সে-গল্পে বারবার একটা রেলগাড়ি চলে এসে লাইনের ও পারে দাঁড়ানো মনোহর দৃশ্যগুলোকে ঢেকে দেয়। চাওয়া এবং না-পাওয়ার মধ্যে এই রেলগাড়িটা ওঁর জীবন থেকে কখনও সরেছে কিনা জানি না, শুধু একটা মনে হয়— নিজের কিছু সার্থক রচনার বাইরে আর সব পাওয়াকেই ওঁর সম্ভবত উদ্বৃত্ত, উপরি জ্ঞান হয়। যে-মনোবেদনা শিল্পীর লক্ষণ এবং যা কিনা জীবন ও শিল্পকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে।

রমাপদ চৌধুরী কোনও দিন এরোপ্লেন চড়েননি। শীর্ষেন্দু প্রথম এরোপ্লেনে চড়ে যে বিপণ্ণ পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন, তা নিয়ে একটা কবিতাই লিখে ফেলেছিলেন ‘কখনও কবিতা’ নামের এক সঙ্কলন গ্রন্থে, যেখানে শুধু প্রতিষ্ঠিত গদ্যকারদের কখনও না কখনও লেখা কবিতা স্থান পেয়েছিল। সেখানে শীর্ষেন্দু বিমানে বসলে লজ্জা পাওয়ার কথা বলেছেন।

কিন্তু কোথায় সে-লজ্জা শীর্ষেন্দুর যখন আশ্রমিকের মোটা লাঠি হাতে মুণ্ডিতকেশ লেখক প্রথম বার মার্কিন দেশ পাড়ি দিলেন উড়োজাহাজে! সেই রমাপদ চৌধুরী সম্পাদিত আনন্দবাজার রবিবাসরীয়র পাতায় বেহদ্দ বাঙালের মতোই ফলাও করে লিখলেন সে-অভিজ্ঞতা ‘বাঙালের আমেরিকা দর্শন’ রচনায়।

তত দিনে ‘যাও পাখি’, ‘মানবজমিন’ লেখা হয়ে গেছে শীর্ষেন্দুর, লেখক হিসেবে বিশেষ কিছু প্রমাণ করা বাকি নেই। প্রয়োজন শুধু ভেতরে ভেতরে গুমরে মরা ওই লাজুক, নির্জন, প্রায় প্রান্তিক মানুষটাকে কিছুটা মুক্তি দেওয়া। পাঠের আকারে যার সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় ‘যাও পাখি’ উপন্যাসের নায়কের মাধ্যমে। বছর কয়েক আগে এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, ‘যুবকটি তো আদ্যোপান্ত আপনিই!’ তাতে ঈষৎ হেসে শীর্ষেন্দু বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, ওর মধ্যে আমারই অনেকখানি তোলা।’

এই বাঙালি আর ধার্মিকের মিশেল শীর্ষেন্দুর ভাল আঁচ আমরা পেয়েছিলাম ‘আমেরিকা দর্শন’-এর কয়েক বছর আগেই। ওঁকে তখন আনন্দবাজার-এ লিখতে বলা হয়েছিল শ্রীরামচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ওঁর বনবাস যাত্রার গতিপথ ও বিরামকেন্দ্রগুলি নিয়ে বৃত্তান্ত। অকস্মাৎ ঘরকুনো (নিরামিষ শীর্ষেন্দুর কোনও দিনই কোন সান্ধ্যজীবন নেই। ক্লাব হোটেল রেস্তোরাঁ কা কথা) বাঙাল ধার্মিকটি উঠে পড়ে ট্রেন ধরাধরি, যেখানে-সেখানে রাত থাকাথাকি শুরু করে দিব্যি এক ভারতভ্রমণ সারতে লাগলেন। এই দৌড় নিয়ে আবার রসিকতা করতেও ছাড়লেন না— ‘চলো মুসাফির বাঁধো গঠোরি’। আর শেষে লিখে ফেললেন এক অতি উপাদেয় আধুনিক রামযাত্রা। মনে আছে তখন রমাপদবাবুর ঘরে গেলেই প্রশ্ন করতেন, ‘‘কেমন পড়ছেন শীর্ষেন্দু?’’ যখন বলতাম, ‘‘দারুণ।’’ বলতেন, ‘‘লেখালেখি ছেড়ে দিন, ছোটাছুটি কী করছে!’’

শীর্ষেন্দু আনন্দবাজার-এ যোগ দেওয়ায় কিছু জিনিস বেশ চাক্ষুষ হচ্ছিল। বারবার চা, খিদের মুখে বাদাম ছোলা মুড়ি দিয়ে কাজ সারা। আর অসাধারণ রসবোধ। ডেস্কে জয়েন করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ওঁর এক অপূর্ব সমীহপূর্ণ সখ্য জন্মায় শক্তিদার প্রতি। হাতে কাজ না থাকলেই ‘অ্যাই শক্তি!’ বা ‘আচ্ছা শক্তি!’ বলে একটা সংলাপ চালু করতেন।

আর তুলকালাম রসিকতা শুরু করতেন সুযোগ পেলেই সহকর্মী ও লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে নিয়ে। সিরাজ অতীব ভালমানুষ, কিন্তু উত্তেজনাপ্রবণ। অথচ তাঁকে মিছরির বাক্যবাণে খুব থামিয়ে রাখতেন শীর্ষেন্দু। ওঁদের তর্ক রস জোগাত ডেস্কে।

তবে শীর্ষেন্দুর ভিতরে যে একটা খেলাপাগল চিরযুবা লুকিয়ে আছে তা প্রথম বুঝি যখন এক দিন নিজে থেকেই আমায় বললেন, ‘‘বিলেতে নেওয়া আপনার (প্রথম-প্রথম ‘আপনিই’ বলতেন শীর্ষেন্দুদা) আলির ইন্টারভিউটা আমার দারুণ লেগেছে।’’

কথায় কথায় বুঝলাম উনি মহম্মদ আলি, জো ফ্রেজিয়ার, জর্জ ফোরম্যানের বক্সিংয়ের খুঁটিনাটি খবর রাখেন। ব্যাপারটা আরও খোলসা হল এর কিছু কাল পর ‘আনন্দমেলা’ পূজাবার্ষিকীতে ওঁর উপন্যাস ‘বক্সার রতন’ প্রকাশ পেতে। তাতে দেখলাম ফোরম্যানকে জব্দ করতে আলি কিনশাশার বিখ্যাত লড়াইয়ে যে রোপ-আ-ডোপ টেকনিক উদ্ভাবন করেছিলেন, সেই রীতিতে রতনকে দিয়ে লড়াচ্ছেন। পড়াশুনো না করে এই কাজটা সম্ভব ছিল না। সেটা বলাতে শীর্ষেন্দু বিনয়ের হাসি হেসেছিলেন।

খেলার ক্ষেত্রে অবশ্য শীর্ষেন্দুর পাখির চোখ ক্রিকেট। উনি কি ক্রিকেট খেলেছেন? জানি না। কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে কোনও আনাড়ি কথা বলেন না বা লেখেন না। তবে ওঁর সাপোর্ট করা দল সব সময় জেতে না। যেমনটি হল কিনা নব্বই দশকের অস্ট্রেলিয়ায় ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনালের বিশ্বকাপ ফাইনালে। মুখোমুখি সে দিন ইংল্যান্ড ও ইমরানের পাকিস্তান। আমরা এক দল টিভিতে খেলা দেখছিলাম তৎকালীন আনন্দলোক সম্পাদকের ঘরে। মোটের ওপর আমরা পাকিস্তানের পক্ষে, ইংল্যান্ডের হয়ে বীরের মতো লড়ে যাচ্ছেন একা শীর্ষেন্দু। খেলার বিশ্লেষণ করে বলে যাচ্ছেন কেন ইংল্যান্ডের জেতা বিধেয়।

পর পর চারটে ইংল্যান্ড উইকেট পড়তে বেচারি শীর্ষেন্দু আর নিতে পারলেন না। ইংল্যান্ড হারছে জেনে মুখ ভার করে ঘর ছেড়ে উঠে গেলেন। ইমরানের দলের জয়ের সম্ভাবনায় আনন্দ হলেও প্রিয় মানুষটির কষ্ট আমায় কষ্ট দিচ্ছিল। শক্তি, সুনীল, শীর্ষেন্দু এত কষ্টদুঃখের কথা লিখে গিয়েছেন সারাজীবন ওঁদের পদ্য ও গদ্যে যে সামনাসামনি ওঁদের কষ্ট দেখাটা বড় কষ্টকর।

একেবারে অন্তস্তল থেকেই উনি বিশ্বাস করেন যে ভূত ছিল, আছে, থাকবে। তিন বছর আগে মুম্বইয়ে এক সাহিত্যসভায় মঞ্চে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘আপনি সত্যিই ভূতে বিশ্বাস করেন?’’ দৃঢ় ভাবে উত্তর করলেন, ‘‘এই বম্বেরই এক হোটেলে এক বার উঠে টের পেয়েছি।’’ বলে সেই অভিজ্ঞতাটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করলেন, হলে তখন পিনড্রপ সাইলেন্স।

শীর্ষেন্দুর ভূতের গল্পের শেষ নেই। ওঁর দেখা, ও গল্পের জন্য কল্পনা করা। কিন্তু শেষ করব ওঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও হিউমার মেশানো অন্য এক বয়ানে। দু’বছর আগে ইলাহাবাদে বঙ্গ সম্মেলনের এক অধিবেশনের পর শীতের রোদে হোটেলের লন-এ বসে বলা।

কথা হচ্ছিল ওঁর রামের বনবাস নিয়ে লেখা সম্পর্কে। বললেন, ‘‘জানো তো, এই যে আমরা রামের পাদুকা মাথায় করে বন থেকে ভরতের ফিরে আসা নিয়ে আবেগ দেখাই, আসলে এর উল্টোটাই সত্যি। পাদুকা চেয়ে নিয়ে আসা একটা কল ছিল। রাম তখন যেখানে, সেখান থেকে খালি পায়ে বেরিয়ে আসতে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। এত রুক্ষ জমি আর এত আগুনে গরম। ভরত জানতেন এক বার পাদুকা হারালে দাদার পক্ষে বেঁচে ফেরা অসম্ভব। জুতো পরা আমি কী ভাবে যে এই যুগেও গিয়ে ফিরে আসতে পারলাম সেটাই তো লেখার বিষয় হল।’’

shirshendu mukhopadhyay shankarlal bhattacharya senior colleague author shirshendu abp patrika abp patrika story shirshendu mukhopadhyay birthday 93 birth anniversary
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy