Advertisement
E-Paper

ছায়াহিন্দোল

এই রাগটি ছিল সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর তৈরি। যাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খান, উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি। তাঁর অত্যাশ্চর্য জীবন-পরিক্রমার কথা গাঁথলেন দৌহিত্র শ্রীজাত‘আদাবান্তে নিবেদন এই শ্রী শ্রী বিজয়ার শতকোটি অভিবাদন জানিবেন। ঈদ মুবারক। আপনার গুণে আমি মুগ্ধ এত, পরিচয় দেবার কোনও প্রয়োজন করে না। আপনি আমার হৃদয়ে গাঁথা। আপনি ভারতের রত্ন। স্বনামধন্য মহাপুরুষ, আপনার দীর্ঘ জীবন মায়ের চরণে প্রার্থনা করি। আপনি দয়া করে আসবেন জেনে অধিক সন্তুষ্ট হলেম। দেড়মাস পর যদি আপনি দয়া করে আসেন, তবে বাধিত হব।—আপনার আলাউদ্দিন’

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
সঙ্গীতাচার্য

সঙ্গীতাচার্য

‘আদাবান্তে নিবেদন এই শ্রী শ্রী বিজয়ার শতকোটি অভিবাদন জানিবেন। ঈদ মুবারক। আপনার গুণে আমি মুগ্ধ এত, পরিচয় দেবার কোনও প্রয়োজন করে না। আপনি আমার হৃদয়ে গাঁথা। আপনি ভারতের রত্ন। স্বনামধন্য মহাপুরুষ, আপনার দীর্ঘ জীবন মায়ের চরণে প্রার্থনা করি। আপনি দয়া করে আসবেন জেনে অধিক সন্তুষ্ট হলেম। দেড়মাস পর যদি আপনি দয়া করে আসেন, তবে বাধিত হব।—আপনার আলাউদ্দিন’

মাইহার থেকে সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীকে এই চিঠি লিখেছিলেন প্রবাদপ্রতিম উস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খান।

এর চেয়ে বড় শংসাপত্র কোনও প্রতিষ্ঠানও কাউকে দিতে পারে না। চিঠির প্রাপক তত দিনে সঙ্গীতাচার্যের খেতাব পেয়ে গিয়েছেন, লোকে তাঁকে এক ডাকে চেনে।

কিন্তু সেই যুবক তারাপদকে বোধ হয় কেউ চেনে না, যে ফরিদপুরের শান্ত এক গ্রাম থেকে এসে পড়েছিল বিরাট এই শহরটায়, আর গানের নেশার অপরাধেই তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল কোনও এক বাড়ির রোয়াকে।

অবাক করা কথা হলেও, এমনই সব বিস্ময়কর তথ্যে ঠাসা তারাপদ চক্রবর্তীর গোটা জীবনটাই, যার জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায়। ১৯০৯ সাল, পয়লা এপ্রিল। আর পাঁচটা বালকের মতো ডানপিটে ছিলেন তিনিও, কিন্তু গানবাজনার পরিবেশে পড়লে সেই ছেলেই হয়ে যেত ধ্যানমগ্ন।

বাবা কুলচন্দ্র চক্রবর্তী, মা দুর্গারানি দেবী ও কাকা ন্যায়রত্ন রামচন্দ্র চক্রবর্তী। বাবা আর কাকা, দুজনেই ছিলেন রীতিমতো গানের মানুষ। খুরজা ঘরানার বিখ্যাত উস্তাদ জহুর খানের কাছে দীর্ঘদিন তালিম নিয়েছিলেন তাঁরা। সেই সূত্রে গান বেড়ে উঠছিল বালক তারাপদ’র কণ্ঠেও।

তা ছাড়া টোলে সংস্কৃত শিক্ষার পাশাপাশি লোকায়ত গানের একটা আবহও তাঁর মনে প্রভাব ফেলেছিল বইকী। তাই দৈনন্দিন চলাফেরার মধ্যে গানকেই নিজের সঙ্গী করে নিয়েছিলেন তারাপদ।

দুপুরে হয়তো দিঘিতে ছিপ ফেলে বসে আছেন, গুনগুন করে ভাঁজছেন কোনও একটা রাগের চলন। এ দৃশ্যে কোটালিপাড়ার বাসিন্দারা অভ্যস্তই ছিলেন। তার পাশাপাশি বাবার কাছে নিয়মমাফিক রাগসঙ্গীতের তালিম নেওয়া তো ছিলই। তবে তখন কেউ বোধহয় এত দূর ভাবতে পারেননি যে, এই ছেলেই ভারতজোড়া নাম কিনবে কয়েক বছর পর।

যেমন ভাবতে পারেননি তারাপদ’র ভাবী শ্বশুরবাড়ির বেশ কিছু লোকজন।

সে-কালে কম বয়সে বিয়ের চল। কিন্তু যে-বাড়ির মেয়ের সঙ্গে বিবাহ স্থির করার চেষ্টা হল, সে-বাড়ির লোকজন বেঁকে বসলেন। তাঁরা ছিলেন যথেষ্ট সচ্ছল, এ দিকে কুলচন্দ্রের দিন আনা দিন খাওয়া। সম্পদ বলতে কেবল সঙ্গীত। কিন্তু তেমন সম্পদের দাম আর ক’জনই বা বোঝে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের বক্তব্য, ঘুরে বেড়ানো ছাড়া এ ছেলে আর কিছুই করে না। ভবিষ্যতেও যে কিছু করে উঠবে, এমনটা মনে হচ্ছে না। অতএব ধরে বেঁধে নিজেদের মেয়েকে তাঁরা জলে ফেলে দিতে পারবেন না।

বিয়েটা হয়তো হতই না, যদি না উল্টো কথা বলতেন খোদ পাত্রীর বাবা। তিনি সে বয়সেই কিশোর তারাপদর চোখে উদাসীন এক প্রত্যয় দেখে ফেলেছিলেন, যা বাকিদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। তাই শেষমেশ মালাবদল হয়েছিল তারাপদ আর প্রভাবতী’র। আর তার পরপরই উপার্জনের তাগিদে তারাপদ পাড়ি দিলেন কলকাতা। হয়তো তিনি জানতেনও না, এই মহানগরীতেই বাঁধা হবে তাঁর নতুন জীবনের তার।

•••

রোয়াকে রাত কাটানোর প্রসঙ্গ ছিল এই লেখার গোড়ায়। গল্পটা এইরকম, কলকাতায় এসে তারাপদ আশ্রয় নিয়েছিলেন দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

নামেই আশ্রয়, তাঁরা এই হঠাৎ আগন্তুকের উপস্থিতি বিষয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারাপদ অবশ্য বরাবরই একরোখা, বেশ প্রবল তাঁর আত্মমর্যাদা বোধ। কারও দয়া বা দান গ্রহণ করা তাঁর ধাতে নেই। তাই শহর কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় দিনভর রোজগারের ফিকিরে ঘুরতেন তিনি। বাড়ি বাড়ি চাল বিক্রি করেছেন, শাড়ি বিক্রি করেছেন, এমনকী মুটেগিরিও করেছেন।

সেই সামান্য রোজগারের একাংশ পাঠাতে হত দেশের বাড়িতে, বাকিটা নিজের হাতখরচ। কোনও কাজকেই খাটো মনে করতেন না তিনি, বরং মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকাটা তাঁর কাছে অনেক বেশি দামি বলেই মনে হয়েছিল। এই মূল্যবোধের দামও তাঁকে দিতে হয়েছিল অনেক বার, সে সব কথায় পরে আসা যাবে।

সারাদিন তো পথে পথে কাটতই, রাতগুলো কাটতে শুরু করল জলসায়। কোটালিপাড়ায় থাকাকালীন এমন বড় পরিসরে গানবাজনা শোনার সুযোগ মেলেনি, এদিকে কলকাতা তখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মহাতীর্থ। আজ এখানে মেহফিল, তো কাল ওখানে।

আর সে সব জায়গায় শিল্পী কারা?

এক দিকে উস্তাদ আবদুল করিম খান ও উস্তাদ ফৈয়াজ খান, তো অন্য দিকে পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর আর মুস্তাক হুসেন।

রাতের কলকাতাকে প্রাণ থেকে ভালবেসে ফেললেন যুবক তারাপদ। যে শহরে এমন গানবাজনা শোনা যায়, সে শহর ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

শহর ছেড়ে যেতে হল না ঠিকই, কিন্তু ভিটে ছাড়তে হল।

যাঁদের বাড়িতে ছিলেন, তাঁরা সাফ জানিয়ে দিলেন, রোজ রোজ রাতবিরেতে বাড়ি ফেরা চলবে না। এমনটা চলতে থাকলে অন্যত্র ব্যবস্থা দেখতে হবে।

অন্তর্নিহিত নির্দেশটা খুব সোজা — হয় মাথার ওপর ছাদ, নয় গানবাজনা। তারাপদর কাছে উত্তরটা আরও স্পষ্ট ছিল। সেই রাতেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে পথে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

একেবারে আক্ষরিক অর্থেই।

রাত কাটানোর জন্যে বেছে নিলেন হ্যারিসন রোডের একটি বাড়ির রোয়াক। সেখানেও কি কম বিপত্তি? দু’দিন থেকেছেন কি থাকেননি, এক কনস্টেবল এসে লাঠি দেখালেন।

ব্রিটিশ শাসিত কলকাতা, রোয়াকে শুয়ে থাকা চলবে না। তারাপদরও জেদ, এখানেও যদি জায়গা না হয়, কলকাতায় থেকে গানবাজনা শুনবেন কী করে?

‘‘কী করা হয়?’’ বিরক্ত মুখে প্রশ্ন করলেন বয়স্ক সেই কনস্টেবল।

‘‘গান গাই’’, সটান জবাব দিলেন তারাপদ। ছেলেটির চেহারার সঙ্গে জবাবকে কিছুতেই মেলাতে পারলেন না প্রশ্নকর্তা।

তবু তিনি বললেন, ‘‘কীরকম গাস, নমুনা শুনি?’’

মধ্য রাত পেরিয়ে যাওয়া শুনশান হ্যারিসন রোডের সেই রোয়াকে বসেই চোখ বন্ধ করে গান ধরলেন তারাপদ— ‘পিয়া কে মিলনে কী আশ’।

তত দিনে যোগিয়া’র এই ঠুমরি উস্তাদ করিম খান সাহেবের গলায় ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। সদ্যই এক আসরে খান সাহেবকে শুনেছিলেন তারাপদ, ওই একবার শুনেই গানটি হুবহু গলায় তুলে নিয়েছেন তিনি।

কোনও এক দৈব সংযোগে সেই রাতের সেই কনস্টেবল ছিলেন গানের সমঝদার।

ঠুমরি শেষ হবার পর তারাপদকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি। আর বলেছিলেন, এক শর্তে এই রোয়াকে তাঁকে থাকতে দেওয়া হবে। যদি রোজ রাতে এইরকম গান শুনতে পাওয়া যায়।

ওই বয়স্ক কনস্টেবলই তারাপদ’র নগরজীবনের প্রথম শ্রোতা।

ছোট থেকেই তারাপদ ছিলেন শ্রুতিধর। বিশেষ করে সুরের ক্ষেত্রে। একবার যা শুনতেন, ভুলতেন না। আর সেই ক্ষমতাই এর পর তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিল সে সময়ের খ্যাতনামা গাইয়ে সাতকড়ি মালাকারের জানলার বাইরে।

কলকাতার নানা রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে একদিন হঠাৎ তারাপদ’র কানে এল পুরনো বন্দিশ।

কে গাইছেন এমনভাবে?

খুঁজে খুঁজে পেলেন সেই জানলা, যার ওদিকে বসে ছাত্রদের গান শেখাচ্ছেন সাতকড়ি মালাকার।

তারাপদরও খুব ইচ্ছে, ভেতরে গিয়ে বসে সকলের সঙ্গে গান শেখার, কিন্তু সেই সামর্থ্য বা সাহস, কোনওটাই তাঁর নেই।

অতএব রোজ একই সময়ে জানলার বাইরে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করলেন তিনি। আর বরাবরের মতোই, একের পর এক রাগ আর বন্দিশের চলন উঠে আসতে লাগল তাঁর গলায়।

বেশি দিন এমনটা চলল না।

ধরা পড়লেন হাতেনাতে। সাতকড়ি মশায় রেগে আগুন। ছোকরা কিনা জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর বিদ্যা চুরি করছে?

‘‘শুনি কী শিখেছিস?’’ হুকুম করলেন তিনি। তারাপদ লাজুক মুখে দু’খানা বন্দিশ গেয়ে শোনাতেই সাতকড়িবাবুর মন গলে গেল। এমন একজনকেই তো তিনি খুঁজছিলেন এত দিন! তারাপদর ঠাঁই পাকা হল জানলার এদিকেই।

•••

‘‘তোমাকে তালিম দেওয়া মানে খোদার উপর খোদকারি করা। ভগবানই তোমাকে সব আঙ্গিক তালিম দিয়ে পাঠিয়েছেন, তার বাইরে কিছুই নেই। ভারতবর্ষ ঘুরে আমি কিছু অমূল্য বন্দিশ জোগাড় করেছি, সেগুলি তোমাকে সার্থক ভাবে দিয়ে যেতে পারলেই আমার শান্তি’’— তারাপদ চক্রবর্তী বিষয়ে এই বক্তব্য তাঁর পরবর্তী ও শেষ গুরু পণ্ডিত গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী’র।

সাতকড়ি মালাকারের কাছে বেশ কিছু দিন তালিম নেবার পর তারাপদ সান্নিধ্য পান খ্যাতনামা গিরিজাবাবুর, যিনি বিষ্ণুপুর ঘরানার গাইয়ে হয়েও ভারতের বহু ঘরানার গায়কি ও দাওপ্যাঁচ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তারাপদকে একবার শুনেই তিনি বুঝেছিলেন, এ ছেলের মধ্যে গান ছাড়া আর কিছু নেই। আর সে গানও বেশ ভালরকম বিষ্ণুপুরের গায়কি ঘেঁষা। এ তৈরি হয়েই এসেছে, একটু গড়েপিটে নিলেই কেল্লা ফতে।

হয়েওছিল তাই।

মধ্যযৌবন থেকেই কলকাতা ও আশেপাশের আসরগুলোয় নিয়মিত ডাক পড়তে লাগল তারাপদ’র। তাবড় ওস্তাদদের ভিড়ে বাঙালি গাইয়ে হয়ে নাম কেনা তখন বড় সহজ ছিল না।

গোড়ার দিকে গানে উস্তাদ করিম খান সাহেবের ছায়া থাকলেও, খুব দ্রুত তারাপদ চক্রবর্তী’র নিজস্বতা শ্রোতাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল।

বেশ টিকোলো নাক ছিল তাঁর, তাই ডাকনাম ছিল নাকু। তখন বাঙালি শ্রোতাদের কাছে নাকুবাবুর গান এক আলাদা পিছুটান। শুদ্ধকল্যাণ থেকে পুরিয়ায় আসর মাতিয়ে ফেলছেন তিনি। শহরের বাইরেও পৌঁছচ্ছে তাঁর খ্যাতি।

এর মধ্যে দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জের বাওয়ালি মণ্ডল রোডে বাসা ভাড়া নিয়েছেন। দেশ থেকে ভাই হরিপদ আর স্ত্রীকে এনে রেখেছেন কলকাতায়। অনুষ্ঠানের পাশাপাশি একটু একটু করে বাড়িতেই তালিম দিচ্ছেন ছেলেমেয়েদের।

একে একে প্রভাবতী’র গর্ভে জন্মাচ্ছেন পুত্র মানস, কন্যা শ্রীলা, কল্পনা ও সুশ্রী। আসরে তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকছে ভাইপো বিমলেন্দু।

আর কিছু দিন পর খুদে মানস ও শ্রীলা দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করছে জনসমক্ষে। তারাপদ বিস্তৃত হচ্ছেন ক্রমশ... তৈরি হচ্ছেন সঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বে পরিণত হবার জন্য।

অজস্র বাংলা গান লেখার পাশাপাশি তারাপদ সৃষ্টি করছেন নতুন রাগ –‘ছায়াহিন্দোল’। সে রাগ এত জনপ্রিয় হচ্ছে যে সব ক’টি আসরে শ্রোতাদের অনুরোধে গাইতেই হচ্ছে।

যে মানুষটা শহরের রোয়াকে রাত কাটিয়েছেন, কেবল গানের জোরে একখানা তিনতলা বাড়ি বানাচ্ছেন তিনি লেক গার্ডেন্সে, আদরের সঙ্গে শাসন করছেন গানবাজনার কলকাতাকে। আর বিশালকায় সেই বাড়ির নামও রাখছেন ‘ছায়াহিন্দোল’।

বড় মেয়ে শ্রীলা এ বছর ৭০-এ পা দিলেন। কিন্তু ছোটবেলার স্মৃতি আজও স্পষ্ট তাঁর মনে।— ‘‘চোখ বুজলে এখনও তানপুরার আওয়াজ শুনতে পাই। সারাদিন আমাদের বাড়িটা গানের গন্ধে ম ম করত। বাবা কখনও আমাদের আলাদা করে ডেকে তালিম দিতেন না, আমরাই ক্লাসে এসে বসতাম। আজও কান পাতলে বাবার গলার সা অবিকল শুনতে পাই।’’

ওদিকে পণ্ডিত মানস চক্রবর্তী’র এক সাক্ষাৎকারে পাচ্ছি— ‘‘বাবা বিশেষ কোনও ঘরানার ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকেননি। রাগরূপ এবং বাণীর প্রামাণ্যতা বজায় রেখে, ব্যক্তিগত উপলব্ধি এবং সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে নিজের গানে যোগ করেছেন বিশেষ মাত্রা। গভীরতার পাশাপাশি খেয়াল গানকে একটা পূর্ণতা দিয়েছেন বাবা, যা তাঁর আগে এভাবে ছিল না।’’

কথাটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্যি।

একটা সময় পর্যন্ত খেয়াল গাওয়া হত ছোট বা মাঝারি ঘেরে। অনেকখানি সময় নিয়ে বড় পরিসরে বিস্তার, সেই চল কিন্তু তারাপদবাবুর অবদান। সে সময় আর কেউ এ ভাবে বড় খেয়াল গাইতেন না। যে কারণে অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সে তারাপদ’র গান শোনার পর খোদ পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার গান আমাদের জন্য। সবার জন্য নয়।’’

আবার মানসবাবুর স্মৃতিচারণায় পাচ্ছি, ১৯৫০-এ দার্জিলিং-এর এক কনফারেন্সে গাইতে গিয়ে উস্তাদ বড়ে সুলাম আলি খানের সঙ্গে দেখা তারাপদবাবুর। দু’জনেই পরস্পরের অনুরাগী। আরেকটি অনুরাগও অবিশ্যি ছিল। তারাপদবাবু যেমন ধূমপান ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারতেন না, তেমনই মদ্যপান ছিল বড়ে গুলাম-এর প্রিয় নেশা।

তারাপদবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘এত মদ্যপান করেন কেন? বিনা মদ্যপানেই তো আপনার গলায় এমন সুর বসে রয়েছে।’’

উত্তরে বড়ে গুলাম হেসে বলেছিলেন, ‘আপনি বুঝবেন না তারাপদবাবু। বিনা সুরায় সুরের ভেতর ঢুকে পড়া খুব কঠিন কাজ। ওটা আপনার মতো সচ্চা কলাকারের পক্ষেই সম্ভব।’’

১৯৭২, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির ফেলো নির্বাচিত হওয়ার পরে বেগম আখতারের সঙ্গে, পিছনে গিরীশ কারনাড (ডান দিকে)

এত মানুষের উদার কুর্নিশ যিনি পেয়েছেন, তিনি কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির আওতার বাইরেই থেকে গেলেন চিরকাল। নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে পারলেন না, মর্জির বাইরে গিয়ে মনোরঞ্জন করতে পারলেন না, পারলেন কেবল একরোখা শিরদাঁড়াটা টানটান রেখে গান গেয়ে যেতে। তাই শেষমেশ একটা কড়া চিঠি লিখতেই হল তাঁকে, মৃত্যুর ঠিক আগের বছরেই। — ‘‘অন্যায়ের সমর্থন আমি কোনও দিন করেছি বলে আমার মনে পড়ে না, এবং সত্যের জন্য আমাকে অনেক যায়গা থেকেই সরে আসতে হয়েছে। আজ পর্যন্ত পশ্চিম বাঙলার কোন বাঙালী উচ্চাঙ্গ কণ্ঠ সঙ্গীত শিল্পীকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়নি, কেন জানিনা। আজ থেকে বহুপূর্বে যা পেলে গ্রহণযোগ্য হতো তা এই জীবন সায়াহ্নে পেয়ে আমি এতটুকু উৎসাহ বা আনন্দ পাচ্ছি না বরঞ্চ ক্ষোভ হচ্ছে, এই কথা ভেবে যে আমাকে এ সময়ে পদ্মশ্রী দেওয়ার অর্থ আমাকে এবং সেই সঙ্গে সমস্ত সঙ্গীত জগতকে অপমান করা। তাই ভারত সরকার প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় সম্মানসূচক এই পদ্মশ্রী উপাধি আমার পক্ষে গ্রহণের অযোগ্য এবং অসম্মানজনক মনে হল এবং আমি সানন্দে প্রত্যাখ্যান করলাম।’’

৭৪ সালের ৪ জানুয়ারি এই চিঠি লিখেছিলেন তারাপদবাবু। আর এই চিঠিই আজও তাঁর সম্মানকে অন্য চিলেকোঠায় বাঁচিয়ে রেখেছে। স্বয়ং বাবা আলাউদ্দিন যাঁকে ‘ভারতের রত্ন’ বলে সম্বোধন করেন, তাঁর পক্ষেই সম্ভব এভাবে হেলায় পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া।

•••

আর পাঁচ মিনিট।

কথাটা মুখে বললেন না তিনি, বলার শক্তি নেই আর। হাত তুলে পাঁচ আঙুল দেখালেন। এই পৃথিবীতে পাঁচ মিনিট আছেন আর।

সেটা ১৯৭৫ সাল। দিনটা পয়লা সেপ্টেম্বর।

ক’দিন ধরেই বেশ ভুগছিলেন ৬৬ বছরের শীর্ণকায় মানুষটি। খুব ইচ্ছে ছিল বড় মেয়ের হাতের লুচি বেগুনভাজা খাবেন। বড় কন্যাটি তখন ৭ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা, এক ডাকে ছুটে এসেছেন বাপের বাড়িতে। দু’দিন আগেই তাঁর হাতের রান্না তৃপ্তি করে খেয়েছেন বাবা। তখনও ভাল দেখাচ্ছিল। কিন্তু আজ যেন একটু বেশিই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

একমাত্র ছেলে ডাক্তার ডাকতে যাবেন, এমন সময় হাতের ইশারায় তাঁকে আটকে দিলেন শয্যাশায়ী বাবা। শেষ পাঁচ মিনিটে পরিবারের সকলকে কাছ থেকে দেখে যেতে চান তিনি।

সকলে তাঁর বিছানার চারপাশে উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে। আরেকবার হাত তুললেন তিনি। এবার তিনখানা আঙুল। আর তিন মিনিট।

এ কেমন অলৌকিক কাউন্টডাউন?

ছেলে বারণ শুনলেন না, খবর দিলেন ডাক্তারকে। ডাক্তার এলেনও। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ইশারায় তিন মিনিট দেখানোর কাঁটায় কাঁটায় তিন মিনিট পরই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন বাবা। চিরতরে চলে গিয়েছেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী।

আজকের প্রজন্ম তাঁকে মনে রেখেছে কিনা, সে প্রশ্ন অবান্তর। না রাখলে ব্যর্থতাটা তাদেরই। তবে ছায়াহিন্দোল নামের বাড়ির বারান্দাটায় আজও যখন হাওয়া দেয়, তখন ধুলোর বদলে সুর উড়ে আসে। তারাপদর, মানসের, শ্রীলার... আপসহীন এক গাছ আর তার ডালপালাদের ছায়া পড়ে থাকে সেখানে। রোয়াক থেকে তিনতলার বিরাট ছাদের যে সফর, ভূপালি থেকে যোগিয়ায় জেগে থাকে যে রাত, তার শেষে কিছুই আর চাওয়ার ছিল না উদাসীন এই শিল্পীর। কেবল বড় মেয়ের সন্তানকে দেখে যেতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন তৃতীয় প্রজন্মের কানে একবার ‘সা’ বলে যেতে।

পারেননি, কিন্তু আমি আজও চোখ বুজলে তাঁর একরোখা সেই ‘সা’ শুনতে পাই। তিনি চলে যাওয়ার সাড়ে তিনমাস পর ৭৫-এর ডিসেম্বরেই জন্ম হয় আমার। সেই শিকড়ই আঁকড়ে রেখেছি আজও। ভিড়ের কলকাতা পার হতে হতে আজও আমাকে টান মারে রাতজাগা এক তানপুরা, যার চারটে তারে আমাদের সকলের জীবন বেঁধে নিচ্ছেন সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী।

কে জানে, আজ কী রাগ শোনাবেন...

(চিঠির বানান অপরিবর্তিত)

ছবি সৌজন্য: শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy