Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
মনোরঞ্জন...

অত গ্ল্যামার নিয়ে ভাবলে সাবানের বিজ্ঞাপন করতাম

বলতেন ছায়াদেবী। সিনেমা মহলে সুচিত্রা সেনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তাঁর একশো বছরে তাঁকে নিয়ে বহু অকথিত কাহিনি বলছেন দেবশ্রী রায়ঝিনুকের সেই মালাটা: চুমকি তুই আমাকে কনক বলে ডাকবি, তোর মুখে ছায়াদি শুনতে ভাল লাগবে না।’’ তখন থেকেই আমার কাছে ও কনক। সে কত কালের কথা। কনক চলে গেছে বছর তেরো হয়ে গেল। তবু ওর নিজের হাতে বুনে দেওয়া সোয়েটার, ওর পরা শাড়ি, আমায় দেওয়া চওড়া পাড়ের জর্জেটের শাড়ি এখনও আমার আলমারিতে যত্ন করে রাখা।

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১০
Share: Save:

ঝিনুকের সেই মালাটা

চুমকি তুই আমাকে কনক বলে ডাকবি, তোর মুখে ছায়াদি শুনতে ভাল লাগবে না।’’

তখন থেকেই আমার কাছে ও কনক। সে কত কালের কথা।

কনক চলে গেছে বছর তেরো হয়ে গেল। তবু ওর নিজের হাতে বুনে দেওয়া সোয়েটার, ওর পরা শাড়ি, আমায় দেওয়া চওড়া পাড়ের জর্জেটের শাড়ি এখনও আমার আলমারিতে যত্ন করে রাখা।

আর আছে খুব সুন্দর দেখতে একটা ঝিনুকের মালা। ওই মালাটা আমায় মাঝে মাঝেই নিয়ে যায় ফেলে আসা কোনও এক দুপুর-আড্ডায়। প্রতিটি ঝিনুকে আজ আমিও যেন মুক্তো হয়ে বেঁচে আছি।

পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে

কনক মানেই ছিল, লাল বা খয়েরি রঙের কপাল জুড়ে থাকা গোল টিপ। মেহেন্দি করা লাল চুলের খোঁপা। নাক থেকে ঠিকরে পড়া নাকছাবির ঝলক আর হাতে বাহারি বটুয়া।

আমার যখন এক বছর বয়স কনকের সঙ্গেই কাজ করে আমার অভিনয়ের জীবনের হাতেখড়ি।

ওর সঙ্গে আমার প্রথম ছবি ‘পাগল ঠাকুর’। আর রাম মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় কনকের শেষ ছবি, ‘তোমার রক্তে আমার সোহাগ’। সেখানেও ছিলাম আমি।

রাম মুখোপাধ্যায় ছিলেন আমার জামাইবাবু। ওঁর পিসিমা ছিলেন কনক। কনকের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক ছিল না ঠিকই, তবে ও ছিল আমার আত্মার আত্মীয়।

আমার দিদি ঝুমাকে কনক প্রায়ই বলত, পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তোকে যেন মেয়ে হিসেবে পাই।

পালিয়ে গেল শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে

কনকের পিসিমার সঙ্গে বিয়ে হয় ভাগলপুরের রাজবাড়ির সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ওখানেই কনকের জীবনের একটা বড় অধ্যায় কেটেছে। পিসিমা ছিলেন অভিনেতা অশোককুমারের দিদিমা।

অশোককুমার ছিলেন কনকের প্রায় সমবয়েসি। ছোট্টবেলায় অশোককুমার, কিশোরকুমারের সঙ্গে খড়ের গাদায় উঠে লাফালাফি খেলত কনক।

ছোট থেকেই নকল করতে ভালবাসত কনক। একটা গল্পের কথা মনে পড়ছে।


হাটে বাজারে

কনক তখন ভাগলপুরের মোক্ষদা গার্লস স্কুলের নিচু ক্লাসের ছাত্রী। ‘কর্ণার্জুন’ নাটক নকল করে সকলকে দেখাতে গিয়ে ছোট্ট কনক সংলাপ বলল, ‘শোন দুঃশাসন পশু তুই, কুল নারীর অপমান করলি, তোর তপ্ত রক্ত করিব রে প্রাণ, সেইদিন তৃপ্ত হবে পান।’ কনকের মুখে প্রাণ আর পানের অদলবদল শুনে সকলে তো হেসে কুটোপাটি।

ভাগলপুরের জন্য থেকে থেকেই মন কেমন করত কনকের। বারবার ভাগলপুরে ছুটে যেত। ভীষণ খেয়ালি ছিল কনক।

কনকের যখন এগারো বছর, তখনই ওর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী ভূদেব চট্টোপাধ্যায়। ভদ্রলোক অধ্যাপক। বয়সে অনেক বড়। পছন্দ হয়নি ওর। পালিয়ে এসেছিল মামার বাড়িতে।

কনককে সিনেমায় আনেন ওর পিসিমার বড় ছেলে শ্রীশ চন্দ্র। কনক তখন বাইশে পড়েছে। সে সময় বাড়ির মেয়ের সিনেমা করা অনেক ঝক্কির। শেষে ঘরের নামটা বদলে ‘টকি’-তে যেতে পারল কনক। অশোককুমারের মামিমাই কনকের নাম রাখেন ছায়াদেবী। ওর প্রথম ছবি ‘পথের শেষে’। অভিনয় করে পার্শ্বচরিত্রে।

দ্বিতীয় ছবি দেবকী বসুর ‘সোনার সংসার’। এবার নায়িকা। তাতে কনক পায় সোনার মেডেল।

সাতটা শাড়ির শ্যুট

ছায়াছবির কনক আমার কাছে আভিজাত্যের চাদরে যত্ন করে মোড়া ডাকসাইটে অভিনেত্রী। এত সাবলীল যে, মনে হয় পর্দায় নয়, বাড়িতেই দেখছি ওকে।

কনক রেগে গেলে ওকে ঠিক ‘সাত পাকে বাঁধা’-র সেই স্পষ্টবক্তা শাশুড়ির মতো লাগত। ‘আরোহী’ ছবিতে সেই দেহাতি গয়লানির চরিত্র, কত স্বাভাবিক ভাবে হুঁকো টেনেছিল ও! ‘সাগিনা মাহাতো’-র গয়লানি যে কেমন করে ছবি বিশ্বাসের অভিজাত বৌ হয়ে উঠত, আজও ভাবলে অবাক হই।

‘আপনজন’-এর একটা দৃশ্যে মনে পড়ছে। স্বরূপ দত্ত আর শমিত ভঞ্জের লড়াই বেধেছে। আর কনক ছুটে যাচ্ছে, ওর শাড়ির আঁচল সরে সরে যাচ্ছে...। খুব সচেতন ভাবেই করা, কিন্তু ওগুলো ঠিক অভিনেতাকে বলে দিয়ে করানো যায় না। যার আসে, তার আসে।

এমন দাপট ছিল ওর যে বড় বড় কো-অ্যাক্টর শুধু ওর অভিনয়ের কারণে ঝামেলায় পড়ে যেতেন। আমি নিজের কানে শুনেছি অশোককুমার বলছেন, ‘অনেক বড় শিল্পীর সঙ্গে অভিনয় করেছি, নার্ভাস হইনি, কিন্তু ছায়ার সঙ্গে অভিনয় করার সময় কেমন যেন ভয় ভয় করে।’

স্বভাবে দুষ্টুমিষ্টি খামখেয়ালিপনাতে ভরা ছিল কনক। যা মনে করত, করে ছাড়ত। বাড়িতে তো বটেই, ফ্লোরেও তাই। তাতে এক-একবার পরিচালকরাও বেশ বেকায়দায় পড়ে যেতেন।

অজয় কর গল্প করেছেন আমায়। তাঁর একটি ছবিতে কনক অভিনয় করবেন। শট বোঝাতে গিয়ে অজয় কর বললেন, ‘ছায়াদি, আপনার বিধবার রোল, কাশী থেকে ফিরছেন। আপনার কিন্তু কোনও মেক আপ থাকবে না।’ কথাটা বোধহয় পছন্দ হয়নি কনকের। তাই অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল।

শট নেওয়ার আগে সেটে কনককে দেখে অজয় কর তো অবাক, ‘এ কী! আপনি কাজল পরেছেন কেন?’ কনক সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করল, ‘কাজল? সে তো সাত দিন আগে পরেছি।’ বলেই চিৎকার, ‘অ্যাই মেক আপম্যান, ক্রিম দিয়ে কাজল তোলো তো।’

ঘষে ঘষে কাজল আর ওঠে না। উঠবে কী করে? কনক যে সুর্মা লাগিয়ে বসে আছে।

আরেক বারের কথা। পুরীতে শ্যুট হচ্ছে, কনককে বলা হয়েছে পর পর সাতটা সিন হবে, আর সাতটা সিনে সাতখানা শাড়ি পরতে হবে। কনক তো ভিতরে ভিতরে গুমরোচ্ছে। তখন গরমকাল। শ্যুট করাই বেশ কষ্টের। তার মধ্যে অত চেঞ্জ। গরম বালিতে পা ফেলে ফেলে বার বার হেঁটে যাওয়া!

কনক ড্রেসারের কাছ থেকে সাতটা শাড়ি চেয়ে নিল। শট রেডি। পরিচালক হঠাৎ কনককে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘ছায়াদি, আপনাকে এত মোটা লাগছে কেন?’ কনক বলল ‘কোথায় মোটা! বাদ দাও তো। পুরীর জলহাওয়া খাচ্ছি, মোটা হচ্ছি। নাও শট নাও।’

পরিচালক শট নিলেন। প্রথম শট শেষ করেই কনক বলল, ‘কী এ বার চেঞ্জ তো?’ বলেই একটা শাড়ি খুলে ফেলল। এ বার দেখা গেল সাত-সাতটা শাড়ি একসঙ্গে পরে বসে আছে ও।

মহানায়িকার বেস্ট ফ্রেন্ড

কনক মানেই দুষ্টু বুদ্ধি আর ছেলেমানুষিতে ভরা। নায়িকার গ্ল্যামার-ট্যামার নিয়ে কোনও দিনই ও ভাবেনি।

সুচিত্রা সেন ছিলেন ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। এতটাই বন্ধু যে মহানায়িকাকে নিজের দেওয়া নামে ডাকত ও। যে নাম সুচিত্রা সেন ছাড়া হাতে গোনা ওর কাছের মানুষরা শুধু জানে। তবে সে-নাম এখন বললে কনকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।

সে যাই হোক, সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রিতে যদি কেউ মেক আপ ভ্যান শেয়ার করতে পারতেন, তো সে ছিল একমাত্র কনক।

মহানায়িকার তো মাপা ডায়েট, সেই অনুযায়ী বাড়ি থেকে খাবার আসত। আর কনককে সেই খাবার দিলে কিছুতে মুখেই তুলত না ও। সোজা বলে দিত ‘ও আমার পেটে সইবে না।’ গ্ল্যামার ধরে রাখাটাখা নিয়ে কনক কোনও দিন মাথাই ঘামায়নি, উল্টে বলত, ‘অত যদি গ্ল্যামার নিয়েই ভাবতে হবে তা হলে অভিনয় করা কেন বাপু? সাবানের বিজ্ঞাপন করলেই তো হয়।’


সুচিত্রা সেন

কনক থাকত সিমলাপাড়ায়। উত্তরে। সেখান থেকে দক্ষিণ কলকাতায় সুচিত্রা সেনের বাড়ি এলে কনক আমাদের বাড়ি একবার না একবার ঠিক ঘুরে যেত। আমাদের বাড়িও দক্ষিণে। সে-প্রসঙ্গেও একটা অদ্ভুত গল্প মনে পড়ল।

মহানায়িকার বাড়িতে অজয় কর এসেছেন। নতুন ছবির জন্য শাড়ি বাছা হচ্ছে। কনকও সেখানে আছে। কাজ-টাজ করে অজয়বাবু যখন চলে যাচ্ছেন, তখন হঠাৎ কনক ওঁর হাত থেকে একটা শাড়ি নিয়ে বলল, ‘আপনার ছবি করার সময় আমার একটা শাড়ি খোয়া গিয়েছিল, দেবেন বলে তো আর দেননি, আজ তাই নিয়ে নিলাম।’ বলেই সোজা হাঁটা দিল।

কোনও কিছুকেই তোয়াক্কা করত না কনক। মুম্বইয়ের অভিনেত্রী রামেশ্বরীর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেওয়াটা বেশ মনে পড়ে। সোজা ওর সামনে গিয়ে বলল, ‘এ হল মাহেশ্বরী।’ শুনে আমি তো থতমত, হে ধরণী দ্বিধা হও। চাপা গলায় বললাম, ‘কী করছ কী! ও তো রামেশ্বরী!’ তাতেও একই স্বরে বলল, ‘ওহ্, ওই একই হল।’

মহানায়ক, ছবি বিশ্বাস, অমিতাভ

মহানায়কও কনকের খুব প্রিয় ছিলেন। উত্তমকুমারও ‘ভাল মা’-এর চরিত্রে ছায়াদেবী ছাড়া আর অন্য কারও কথা ভাবতে পারতেন না।

আর ঘুরেফিরেই কনক ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের কথা বলত। কনক বিশ্বাস করত, ইন্ডাস্ট্রিতে ছবি বিশ্বাসের মতো টোটালিটি কারওর মধ্যে নেই, অথচ উনি ওঁর গুণের কদর কোনও দিন পেলেন না।

জহর রায়কে নিয়েও ও খুব দুঃখ করত। বলত, ‘আজীবন বাংলা ছবিতে ভাঁড় করে রাখা হল মানুষটাকে! মুম্বইতে থাকলে ওঁর গাড়ি-বাড়ি সব হত।’ খুব ভাল বাসত সঞ্জীবকুমারের অভিনয়। আর ’৭৭ সালে যখন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘আলাপ’ রিলিজ করল, তারপর থেকে অমিতাভ বচ্চনকে খুব সম্মান করত কনক।

গান ছিল ওর গোপন সুখ

অভিনয় জগৎ থেকে সরে এলেও কেবল একজন পরিচালকের ডাকেই কনক সাড়া না দিয়ে পারত না, তিনি হলেন তপন সিন্হা।

ইন্ডাস্ট্রির লোকজন, নিজের ছবি, এ সব নিয়ে একদম কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইত না কনক। বলত, ‘তপনবাবু আমার দেখা একমাত্র পরিচালক, যাঁর গা দিয়ে জ্যোতি কোনও দিন বেরোতে দেখিনি, অথচ অভিনেতাদের গড়েপিটে নিতে ওঁর মতো কেউ পারত না।’

তপন সিন্হার ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতে গান গেয়েছিল কনক। খুব ভাল লেগেছিল ওর। ... ‘আহা ছল করে জল আনতে আমি...’। তবে বললেই যে কনক গান গাইত তা কিন্তু নয়। কনকের কাছে গান ছিল ওর গোপন সুখ।

এ দিকে কিন্তু বেনারস ঘরানার শিল্পী ছিল কনক। দামোদর মিশ্রর কাছে বহু দিন তালিম নিয়েছে। ওস্তাদি গলা।

কৃষ্ণচন্দ্র দে-কে কনক ডাকতেন ‘বাবুকাকা’। উনি থাকতেন, সিমলা পাড়ায় কনকের বাড়ির উল্টো দিকে। ‘রাঙা বউ’ ছবিতে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র পরিচালনায় ওর গলায় ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’ আজও আমার ভিতরে বাজে।

সরস্বতীর পুজোর বিসর্জনের দিন নিয়ম করে আর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করত কনক। লরিতে চেপে ওর ‘মানা’-র (মান্না দে) সঙ্গে বাবুকাকার শেখানো গান গাইতে গাইতে পাড়া ঘুরত।

রেওয়াজ করা অত ভাল গলা, কিন্তু তাকেও যে কিছুমাত্র গুরুত্ব দিত, তা’ও না। ও সব কনকের ধাতেই ছিল না।

আকাশবাণী-র একটা ঘটনা মনে পড়ছে। সে দিন বিকেল পাঁচটায় কনকের গান। তখন তো সব লাইভ ব্রডকাস্ট হত। এ দিকে কনক সেই সময় নিউ মার্কেটে ঘড়ি কিনতে ঢুকল। কেন? কেন আবার! তখন ওটাই ওর ভাল লাগছে যে!

নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলে আকাশবাণী ঘোষণা করে দিল, ‘অনিবার্য কারণে আজ পূর্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা সম্ভব হল হচ্ছে না।’ কনক ঠিক তার কিছুক্ষণ পরে আকাশবাণী পৌঁছল। জেরার মুখে বলল, ‘কী হয়েছে-টা কী? খেয়াল গাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে। তাই তো? ঠিক আছে, ঠুংরি তো গাওয়া যাবে। ঠুংরি গাই?’ এই হল কনক! চূড়ান্ত আনপ্রেডিকটেব্ল।

এ দিকে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় থেকে শচীন দেব বর্মন সকলেই কিন্তু ওকে দিয়ে গান গাইয়েছেন।

গাঙ্গুবাঈ হাঙ্গেলকরকে এত ভালবাসত কনক, বলত, ওঁর বাড়ির চাকর হয়েও যদি জীবন কাটাতে পারি ধন্য হয়ে যাব। অথচ সেই মানুষটাই হঠাৎ কেমন খেপে গিয়ে নিজের গানের সব রেকর্ড ভাইপো, ভাইঝির কাছে পাঠিয়ে দিল। কেন? উত্তরে বলল, ওসব নিয়ে আমি কী করব?

কত্থক, ঘোড়ায় চড়া, সাঁতার

কনকের কাছ থেকে আমি অভিনয় তো বটেই, নাচেরও কত যে টিপস্ নিয়েছি! শম্ভু মহারাজ আর বেলা অর্ণবের কাছে কত্থকের তালিম নিয়েছিল কনক। কী না পারত! ঘোড়ায় চড়তে জানত, ছবির জন্য সাঁতার কাটা শিখেছিল। ‘মেয়েলিপনা’ ছিল কনকের দু’চক্ষের বিষ। সকলের সামনেই দিব্যি বটুয়া থেকে খৈনির কৌটো বার করে খৈনি খেত।

কনকের সঙ্গে যেমন ঠাট্টা ইয়ার্কিও করতাম, তেমনি ওকে খুব মেনেও চলতাম। খুব ভয়ভয়ে থাকতাম, এই বুঝি আমার অভিনয় নিয়ে কিছু বলে ও। অথচ কোনও দিনই কিছু বলেনি। উল্টে বলত, ‘আমি দুজনকে চিনি। সুচিত্রা সেন আর দেবশ্রী রায়।’

বেশ কিছু দিন না গেলেই ফোন আসত। ‘কী রে দারুণ জিলিপি ভাজছে এখন। বল কী করব? আর আমার কালাকাঁদ আনতে যেন ভুলিস না।’ যেতাম চলে। আর সিমলাপাড়ার বিখ্যাত সব মিষ্টির দোকান পেরিয়ে পৃথিবীর সেরা মিষ্টির স্বাদটা ওর বাড়িতে গিয়েই পেতাম।

আমার একলা রাতের অন্ধকারে

শরীরের বয়সকে কোনওদিনই পাত্তা দেয়নি কনক। কিন্তু শেষের দিকে দেখতাম, মনের বয়সটা বাড়িয়ে ফেলেছে যেন।

নিজের চারপাশে একটা পাঁচিল তুলে দিয়েছিল। সাংবাদিক শুনলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিত। একদিন তো পুরস্কার পাওয়া সব মেডেল বিক্রি করে দিতে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে আটকানো হল।

কেন এ সব করছিলে? উত্তরে বলল, ‘পুরস্কার তো কিনতে পাওয়া যায়। কী হবে ও সব রেখে?’

শেষ দিকে আমাকেই যা আসতে বলত। যেতাম। মাঝে মাঝে দেখতাম চুপ করে বসে আছে। কী জানি কেন! কিন্তু কোনও দিন ঘুণাক্ষরেও একলা থাকার কথা, হতাশা, দুঃখ, আক্ষেপ প্রকাশ করতে দেখিনি। কেবল দিল্লিতে ভাইপো, ভাইঝির কাছে যেতে চাইত। আমাকে কেবল বলত, ‘জীবনে যাই আসুক মেনে নিবি। কখনও হার মানবি না।’ কনক মনখারাপের কথা শুনতে চাইত না। এমনকী অসুস্থ হওয়ার পরেও মৃত্যুর কথা কখনওই বলেনি কনক। বরং কেউ দুঃখের কথা বললে ভয়ঙ্কর রেগে যেত। বলত, ‘আদিখ্যেতা। দুঃখ কার না আছে জীবনে!’ কনকের ছিয়াশি বসন্তের জীবনের অনেকগুলো পর্ব দেখতে দেখতে আমিও জেনেছি, ‘লাইফ কুড বি ওয়ান্ডারফুল, ইফ পিপ্ল উড লিভ ইউ অ্যালোন।’ জীবনটা সুন্দর হবে, যদি মানুষ আপনাকে একা থাকতে দেয়। বিবাহিত না হয়েও সুন্দর সংসার করা যায়, অভিনেত্রী হয়েও ইন্ডাস্ট্রির থেকে ইচ্ছে হলেও দূরে চলে যাওয়া যায়, একা থেকেই নিজের সঙ্গে নিজের দেখা মেলে।

কনক, আমার একলা রাতের অন্ধকারে খুঁজে ফিরি তোমায়...

অনুলিখন: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE