Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

জীবনে ও শিল্পে সতত স্বতন্ত্র ও স্বাধীন

রামকিঙ্কর সম্বন্ধে অনেক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, স্মৃতিচারণা, একটি নাটক ও একটি অসমাপ্ত উপন্যাস লেখা হলেও কোনও প্রামাণিক জীবনী লেখার উদ্যোগ এখনও হয়নি এবং আমাদের দেশে স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনী লেখার রেওয়াজ থাকলেও জীবনী রচনার পরিশ্রমী প্রয়াসের ব্যতিক্রমী ও শেষ দৃষ্টান্ত বোধহয় প্রশান্তকুমার পাল।

মনসিজ মজুমদার
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

আধুনিক ভারতীয় কলা-ইতিহাসে ব্যক্তিত্বে, প্রতিভায়, কলা-সাধনায় রামকিঙ্করের তুল্য দ্বিতীয় কোনও শিল্পীকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এ কথা তাঁর বন্ধু, সতীর্থ, সহকর্মী, প্রত্যক্ষ পরিচিতদের কাছে যতই সত্য হোক, উত্তরকালের কাছে তার সাক্ষ্য-প্রমাণ পৌঁছে দেওয়া যাবে না কেবলমাত্র তাঁর শিল্পকৃতির মাধ্যমে। ‘কবির কবিত্ব বুঝিয়া লাভ আছে... কবিকে বুঝিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভ’ বা ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ’— এমন সব উচ্চারণ ইদানীন্তন কাব্যতত্ত্বে বাতিল হলেও পৃথিবী জুড়ে মহৎ স্রষ্টাদের জীবনী লেখা বন্ধ হয়নি। রামকিঙ্কর সম্বন্ধে অনেক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, স্মৃতিচারণা, একটি নাটক ও একটি অসমাপ্ত উপন্যাস লেখা হলেও কোনও প্রামাণিক জীবনী লেখার উদ্যোগ এখনও হয়নি এবং আমাদের দেশে স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনী লেখার রেওয়াজ থাকলেও জীবনী রচনার পরিশ্রমী প্রয়াসের ব্যতিক্রমী ও শেষ দৃষ্টান্ত বোধহয় প্রশান্তকুমার পাল।

তাই প্রকাশ দাস যে প্রভূত পরিশ্রম করে রামকিঙ্কর সম্বন্ধে নানা তথ্য সমেত বহু এবং বহুবিধ রচনার এমন একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, তার মূল্য কলাপ্রেমিকদের কাছে তো বটেই, সাধারণ পাঠকের কাছেও অপরিসীম। এমন বই ভবিষ্যতের কলারসিক, গবেষক, জীবনী-লেখক, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, সকলের কাজে লাগবে।

পাঁচটি অংশে বিধৃত গ্রন্থের প্রথমেই আছে রামকিঙ্করের নিজের রচনা— নিজের সম্বন্ধে, নিজের কাজ সম্বন্ধে ও সাধারণ ভাবে শিল্পকলা সম্পর্কে। পরের অংশে মুদ্রিত বারোটি সাক্ষাৎকারেও নানা প্রশ্নের উত্তরে কিছু পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও আরও বিশদ ভাবে শিল্পী এ সব আলোচনা করেছেন, তাঁর জীবন, কলা চর্চা, শান্তিনিকেতনের পরিবেশ, তাঁর কাজে রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের আগ্রহ ও প্রেরণা, প্রকৃতি ও প্রকৃতি-লিপ্ত জীবনের সঙ্গে তাঁর নিবিড়় যোগ— যেখান থেকে পেয়েছেন তিনি কেবল ছবির বিষয় নয়, রূপ, রঙ, রীতি, রেখা এমনকী বিমূর্তনার ধারণা। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে যে-সব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ একাধিক বার উঠেছে, তার মধ্যে তাঁর শিল্পকলায় পশ্চিমি আধুনিকতাবাদের প্রভাব, বিশেষ করে কিউবিজম উল্লেখযোগ্য। ইম্প্রেশনিজম, কিউবিজম, এক্সপ্রেশনিজম ও বিমূর্তবাদ সম্পর্কে তিনি যা বলেছিলেন, তা তাত্ত্বিকের ব্যাখ্যা নয়, কিন্তু খুবই প্রণিধানযোগ্য। কারণ, সেগুলি তাঁর ব্যক্তিগত চর্চা ও ভাবনার ফসল। এই প্রসঙ্গে আরও প্রণিধানযোগ্য তাঁর মন্তব্য— ‘শিল্পীর কাছে ভারতীয় বলে কিছু নেই’... ‘শিল্পকলা... জাতীয় সীমানায় সীমায়িত নয়, শিল্প হল আন্তর্জাতিক।’ শিল্পীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যে আধুনিকতাবাদী শিল্পের মূল মন্ত্র, তা নিহিত ছিল তাঁর স্বজ্ঞায়। তাই জীবনে ও শিল্পে তিনি ছিলেন সতত স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। ‘শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি আমি।’ বিয়ে করেননি স্রষ্টার এই স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা অটুট না থাকার আশঙ্কায়।

তৃতীয় অংশে আছে স্মৃতিচারণা। রামকিঙ্করের জীবন, ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার নানা দিকের বিকাশ যে-সব কাছের মানুষ দেখেছেন, তাঁদের কেউ আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মী বা ছাত্র এবং তাঁর ‘জীবনসঙ্গিনী’ রাধারাণী। রামকিঙ্করকে নিয়ে মিথ তৈরি হয়েছে— বাউল, বোহেমিয়ান, সমাজ, সংসার, ঐতিহ্য— কিছুরই পরোয়া না-করা এক শিল্পী যিনি মনে পড়িয়ে দেন উনিশ শতকের পশ্চিমি কোনও কোনও শিল্পীকে যাঁদের জীবন নিয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস লেখা হয়েছে। এই সব স্মৃতিচারণায় এই মিথের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন পাওয়া যাবে না। দেখি নাই ফিরে-র লেখক সমরেশ বসু লিখেছেন ভ্যান গগ বা পল গগ্যাঁর সঙ্গে রামকিঙ্করের কোনও সাদৃশ্য নেই। আবার তিনি যে সংসারে এক সন্ন্যাসী ছিলেন, সে ছবিও উঠে আসে প্রভাস সেন, হৃষীকেশ চন্দ, বিশ্বজিৎ রায়, অসিত দাশগুপ্তের স্মৃতিচারণায়। সরলচিত্ত, সত্যবাদী, নির্ভীক, নিরাসক্ত, নির্লোভ, নিরহঙ্কার, নির্মোহ অথচ জীবনপ্রেমী, সন্ন্যাসী হয়েও অসামাজিক নন— এমন এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি প্রায় প্রতি লেখাতেই।

সকলেই উল্লেখ করেছেন তাঁর উদাত্ত গলায় গান, প্রাণখোলা হাসি, স্নিগ্ধ চোখের দৃষ্টি, শিল্পসৃষ্টির উন্মাদনা ও কঠোর পরিশ্রম, অদম্য প্রাণপ্রাচুর্য, খ্যাতি-অর্থে অনাগ্রহ, বন্ধু ও ছাত্রবাৎসল্য, অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে সপ্রেম মেলামেশা, পশুপাখির প্রতি সহজাত ভালবাসা। বন্ধু বিনোদবিহারী লিখেছেন: ‘আহত কুকুরের পায়ে (তাঁকে) ব্যান্ডেজ বাঁধতে দেখেছি।’ তাঁর মদ্যপান ও রাধারাণী সম্পর্কেও যে-সব সংবাদ প্রত্যক্ষদর্শীরা উল্লেখ করেছেন, তাতে তাঁর প্রতিকৃতিতে কোনও কালিমা লাগেনি। প্রকাশ দাস বহু কষ্ট স্বীকার করে বৃদ্ধা রাধারাণীর যে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাতে প্রয়াত সঙ্গীর উদ্দেশে উচ্চারিত এই সরলা গ্রাম্য নারীর উক্তিতে পরিমাপ করা যায় সেই সম্পর্ক কত গভীর ছিল।

উনিশটি নির্বাচিত প্রবন্ধে মূলত রামকিঙ্করের জীবন, বহুমুখী প্রতিভা ও শিল্পকৃতির আলোচনা করেছেন তাঁর সমকালীন বন্ধু ছাত্র সহযোগীরা। এঁদের লেখায় নানা তথ্যের সমাবেশ ও বিষয়ের চমৎকার বিস্তারে রামকিঙ্করের কলাসাধনার বিচিত্র বিকাশের কথা যেমন আছে, তেমনই তাঁর ছবি ও ভাস্কর্যে আধুনিকতাবাদী স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তার বিশ্লেষণের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে কলা চর্চা ও কলা শিক্ষার মুক্ত পরিবেশের কথাও আছে। রামকিঙ্কর শান্তিনিকেতনে আসার অনেক আগেই পশ্চিমি আধুনিকতাবাদের সঙ্গে পরিচয় হয় শিল্পী, ছাত্র-শিক্ষকদের, স্টেলা ক্রামরিশের বক্তৃতামালা শুনে। ভারতে ডাডাইজমের নাম একমাত্র শান্তিনিকেতনের ছাত্র-শিক্ষক ছাড়া আর কেউ জানত না— লিখেছেন বিনোদবিহারী। কিন্তু শান্তিনিকেতনের শিল্পী-শিক্ষক সমাজে আধুনিকতাবাদী ভাস্কর্য গড়ে আর ছবি এঁকে আলোড়ন তুলেছিলেন রামকিঙ্করই প্রথম। সকলেই বলেছেন তাঁর কোনও নকলনবিশি ছিল না, ‘তাঁর ছবিতে ভাঙন, সরলীকরণ, ইত্যাদি থাকলেও ইজমের খাতিরে প্রাণহীনতা ছিল না’ (ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মন); ‘এই প্রভাব ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল’ (কে জি সুব্রহ্মণ্যন)। কিন্তু কেউ-ই খোঁজ করেননি রামকিঙ্করের জীবনে, অভিজ্ঞতায়, সামাজিক অবস্থানে কী এমন ছিল, যার ফলে তাঁর নান্দনিক সংবেদনা লালিত হয়েছিল এমন জোরালো স্বাতন্ত্র্যে ও স্বাধীনতায়।

রামকিঙ্করের ক্লাসিক্যাল সংগীতে ও নাট্য চর্চায় অনুরাগ প্রসঙ্গে অনেকে উল্লেখ করেছেন। নির্বাচিত প্রবন্ধমালায় অমিতাভ চৌধুরী, শুচিব্রত দেব ও সুখেন গঙ্গোপাধ্যায় নাট্য চর্চায় তাঁর বিপুল আগ্রহ, উদ্যম ও উদ্ভাবনী প্রতিভার কথা লিখেছেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। অধিকাংশ রচনায় আছে লেখকের সঙ্গে রামকিঙ্করের পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতার দৃষ্টিকোণ। যাঁদের লেখায় তা নেই এমন দুজন বিশিষ্ট কলালেখক মৃণাল ঘোষ ও আর শিবকুমার যথাক্রমে রামকিঙ্করের তেলরঙ ও জলরঙের কাজ নিয়ে খুবই মনোজ্ঞ ও তন্নিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। মৃণাল ঘোষ নন্দলালের তেলরঙ-বিরূপতার যাথার্থ্য প্রমাণের যে প্রয়াস করেছেন, তাতে মনে হয়, নন্দলাল তেলরঙের ব্যবহার দেখেছিলেন কেবল পশ্চিমি অ্যাকাডেমিক চিত্রকলায়।

সমকালীন শিল্পীদের মন্তব্য বইটির অন্যতম আকর্ষণ। মানুষ ও শিল্পী রামকিঙ্করের খুবই তথ্যনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছেন অনেকে, যাঁদের মধ্যে পরিতোষ সেন, সোমনাথ হোর, গণেশ পাইন এবং মকবুল ফিদা হুসেন উল্লেখযোগ্য। রামকিঙ্করের কয়েকটি চিঠিও সংযোজিত হয়েছে, যা জীবনী রচনার জন্য মূল্যবান। বইতে সবচেয়ে জরুরি ও পরিশ্রমের কাজ রামকিঙ্করের সৃষ্টিপঞ্জি, নির্মাণ করেছেন আর শিবকুমার, জনক ঝংকার নার্জারি ও সম্পাদক।

রামকিঙ্করের সব শিল্পকর্মের হদিশ খুবই দুর্লভ, শিল্পী নিজেও যে নিজের সৃষ্টি সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন তা সকলেই উল্লেখ করেছেন। ভাস্কর্য, তেলরঙ, জলরঙ, প্রিন্ট সব মিলিয়ে মাত্র ৪৫৬টি কাজ এখানে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এই তালিকাও যে সর্বাংশে নির্ভরযোগ্য নয়, তা বহু কাজের ঠিকানার জায়গায় জিজ্ঞাসাচিহ্নই বলে দেয়। ভবিষ্যৎ গবেষকদের সাহায্য করবে এই বইয়ের আর দু’টি সম্পদ— রামকিঙ্করের জীবনপঞ্জি এবং শিল্পী-সম্পর্কিত রচনা ও গ্রন্থ-তালিকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE