Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
ছোটগল্প

ছিন্নবীণা

সিগারেটের ধোঁয়াটার সঙ্গেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন প্রফেসর সুমন বসু। কিছুতেই ঘুম আসছিল না আজ তাঁর। প্রায় এক ঘণ্টা তিনি ছাদে পায়চারি করছেন।

ছবি: প্রত্যয়ভাস্বর জানা

ছবি: প্রত্যয়ভাস্বর জানা

বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:১০
Share: Save:

সিগারেটের ধোঁয়াটার সঙ্গেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন প্রফেসর সুমন বসু। কিছুতেই ঘুম আসছিল না আজ তাঁর। প্রায় এক ঘণ্টা তিনি ছাদে পায়চারি করছেন। আসলে প্রফেসর বসু এখনও ভাবতেই পারছেন না, কোনও অধ্যাপক কোনও ছাত্রী সম্পর্কে এমন মন্তব্য করতে পারে।

লজ্জায় ঘেন্নায় বসুর দু’চোখ ছলছল করে উঠল আবার। সিগারেটে শেষ ক’টা টান মেরে টুকরোটা ছুড়ে ফেলে দিলেন ছাদের কোনায়। তার পর উদাসীনভাবে চেয়ে রইলেন জঙ্গলটার দিকে। জ্যোৎস্না যেন চাদর পেতেছে জঙ্গলের উপর। চারিদিকে কোনও শব্দ নেই। ঘুমন্ত। কেবল বসু আর তাঁর বাল্যবন্ধু চাঁদটা এখনও জেগে আছে। বসু চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, তাঁকে এ ছাড়া আর কেউ হয়তো তেমন বোঝে না। চাঁদকে নিয়েই কত গল্প, কবিতা লেখা হয়েছে। সুমনেরও নিজের বলতে এই লেখালেখি ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই। আজ প্রফেসর অজয় মল্লিক যখন বললেন, ‘‘মালটা টোপ যখন গিলেছে বসুবাবু তখন আর দেরি কিসের? এ বার খেয়েই ফেলুন। যাই বলুন খাসা জিনিস কিন্তু।’’ কথাটা শোনার পরই ইচ্ছে করেছিল মল্লিককে টেনে একটা চড় মারতে। ইচ্ছে করলেও তা তিনি করতে পারেননি। হাতের শিরাগুলো শুধু টানটান হয়ে গিয়েছিল। কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন তিনি।

কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের বীণা সেনগুপ্তকে দেখার পর থেকেই কী যে হয়েছে তা তিনি নিজেও জানেন না। কত বার যে রাতের কালো পর্দার আড়ালে বীণার সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কটা নিয়ে গবেষণা করেছেন তার হিসেব নেই। তবুও কোনও কিনারা খুঁজে পাননি তিনি। আসলে পৃথিবীতে এমন অনেক সম্পর্ক থাকে যার কোনও নাম হয় না। হাজার ভেবেও যার কোনও সমাধান পাওয়া যায় না। তবে বীণার সঙ্গে তৈরি হওয়া সম্পর্কটা যে প্রেমের বা যৌনতাকেন্দ্রিক নয় তা বুঝতে ভুল হয় না প্রফেসর বসুর। একটা টান আছে বীণার তারে, যে টানে তিনি বাজতেই থাকেন আর বাজতেই থাকেন। বিয়ে করেননি বসু। দীর্ঘ দিন হল মা-বাবাও চলে গিয়েছেন। একলা সংসার-সমুদ্রে নিজেই নিজের দাঁড় টেনে আসছেন বহু কাল। মাঝে মাঝে বীণা এসে ঘরদোর বই গুছিয়ে দিয়ে যায়, গল্প করে, গান গেয়ে শোনায় এই। এইটুকুই। এতেও তো লোকে কম কথা বলে না! মানুষের চামড়ার মুখ তিনি আটকাবেনই বা কেমন করে। বীণাও লোকের কথা তেমন গায়ে মাখে না। যে যা বলছে বলুক। বীণার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। ও নিজের ছন্দেই বেজে চলে। কিন্তু চাকরি জীবনের গোধূলি বেলায় এসে এই সব কথা শুনতে বসুর মোটেই ভাল লাগে না। অনেক বার বীণাকে তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছেন, পারেননি। যত এড়িয়ে গিয়েছেন ততই যেন বীণার তারে জড়িয়ে গিয়েছেন। বীণা ক্লাসে না এলে আজকাল বসুরও মোটেই ভাল লাগে না। একটা অপঠিত টান জন্মে গিয়েছে মেয়েটার উপর।

আর একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকাতে থাকেন বসু। এক বার ভেবেছিলেন নীচে গিয়ে দু’এক চুমুক খেয়ে আসবেন, কিন্তু তাতে আর মন সায় দিল না। বীণা মানা করার পর থেকে ড্রিঙ্ক করাটা অনেক কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। এই কয়েক মাস সেইভাবে গল্প বা কবিতা কোনওটাই লিখতে পারছেন না। প্রফেসর মল্লিকের কথাটা আবার মনে পড়ে যায় বসুর। শুধু মল্লিক কেন, প্রফেসর ঠাকুরও এক দিন এমন কথাই বলেছিলেন সবার সামনেই। ওই যে চামড়ার মুখ...

সিগারেটটাকে চপ্পল দিয়ে মাড়িয়ে দুমদাম শব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন বসু। তার পর চুপচাপ শুয়ে পড়েন। ঘুম আসে না। মনের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে বীণার মুখটা।

******

আজ আর কলেজে যাননি বসু। সারা রাত ঘুম হয়নি বলে শরীরটাও বিশেষ ভাল ছিল না। সকাল থেকে ঘরে বসেই একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছিলেন। ভেবেছিলেন গল্পটা শেষ করে একটু বাজারের দিকে যাবেন। কিন্তু সেটা আর হল না। গল্প লেখার মাঝপথেই কলিং বেলটা বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখলেন, বীণা দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়তো স্যর কলেজ আসেননি দেখেই বীণা নিজেই স্যরের বাড়ি এসেছে খবর নিতে। যদিও ওর আসার আরও একটা কারণ আছে। আগামী পরশু ওর জন্মদিন। ‘আগামী বছর যাব’ বলে গত বছর বীণার প্রস্তাব ফিরিয়ে ছিলেন বসু। এ বার যে তাঁর কোনও বারণই চলবে না সেটা বেশ ভালমতোই জানেন তিনি। ক’দিন আগেই বীণা এসে নেমন্তন্ন করে গিয়েছে। আজ আবার মনে করিয়ে দিতেই তার এখানে আসা। যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও, বীণা আঘাত পাক সেটাও তিনি চান না।

বীণা সোফায় বসে একটা সাহিত্যপত্রিকা নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, ‘‘স্যর, বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল আপনার লেখা গল্প বা কবিতা কিছুই দেখতে পেলাম না কোনও পত্রিকাতে।’’

বসু অর্ধসমাপ্ত গল্পটাতে চোখ বোলাতে বোলাতেই উত্তর দেন, ‘‘তিন-চার মাস তেমনভাবে লেখার সময় হয়নি। কলেজের পরীক্ষা-টরীক্ষা নিয়ে এই কয় মাস যা ঝামেলা যাচ্ছে, তাতে আর লেখার সময় হয়ে উঠছে না।’’ কথাটা যে ভুল তা নয়, তবে এতটাও পরীক্ষা নিয়ে ঝামেলা নেই যে একেবারেই লেখা বন্ধ হওয়ার মতো। আসলে বীণাকে নিয়েই যে যাবতীয় সমস্যা, সেটা তো আর বীণাকে বলা সম্ভব নয়। তাই পরীক্ষার অজুহাত। বসু যখনই কলম ধরেছেন, তখনই বীণার মুখ মনে পড়েছে। তার পর আর কলমও চলছে না, লেখাও হচ্ছে না।

আজ পড়ন্ত বিকেলের আলোতে বীণাকে বেশ মিষ্টি লাগছে। বীণা আহামরি সুন্দরী নয় ঠিকই, কিন্তু একটা তৃপ্তিকর লাবণ্য মুখে লেগেই থাকে। আইলাইনার দিয়ে আঁকা টানা-টানা চোখ। টিকালো নাক। চুলের সামনে লক্‌স। সবই বেশ মানিয়ে গিয়েছে ওকে। এখন বিকেলের হালকা হলুদ আলোটা জানালা দিয়ে বীণার মুখে পড়ে একটা মনকেমন করা অতীত এঁকে দিয়েছে বসুর চোখে।

‘‘চা খাবে বীণা?’’ বসু জিজ্ঞেস করলেন। বীণা তাড়াতাড়ি পত্রিকাটা টেবিলের উপর রেখে বলে, ‘‘স্যর আপনি বসুন। আমিই তৈরি করে নিয়ে আসছি।’’ বীণা উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলে বসু বীণার দিকে তাকিয়ে থাকেন উদাসীন ভাবে। ওর চলার ভঙ্গিমাতেও কী যেন একটা হারানো শান্তি খুঁজে পান তিনি।

বীণা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বসুর জীবনের অনেকগুলো তার বেসুরো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অনেক তারেই আবার নতুন সুর এসেছে। বীণাকে দেখে মাঝে মাঝেই নিজের কলেজবেলায় ডুবে যান তিনি। সেই কলেজের ছাদে আড্ডা দেওয়া। লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বনশ্রীর সঙ্গে গল্প করে যাওয়া। কিংবা তিস্তার জলে পা ডুবিয়ে বনশ্রীর হাতে হাত রেখে চুপচাপ চেয়ে থাকা। সবই আবার বীণাকে দেখেই তো মনে পড়তে শুরু করেছে। এখন আর হারানো দিন মনে পড়লে কষ্ট হয় না তেমন। একটা মিষ্টি যন্ত্রণা হয়। জীবনের ডোরাকাটা পথে চলতে চলতে সব কোথায় হারিয়ে গিয়েছে কোন বিকেলের বাঁকে। একটা সময় রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের একটা লাইন বসুকে খুব নাড়া দিত, ‘এমনও দুঃখ আছে যা ভুলে যাওয়ার চেয়ে বড় দুঃখ আর কিছু নাই।’ আজ কথাটা গভীর ভাবে অনুভব করতে পারেন তিনি।

বীণা দুটো কাপে চা নিয়ে এসে বলে, ‘‘স্যর, আপনার জন্যই কম চিনি দিয়ে বানালাম।’’ বসু কিছুই বললেন না, শুধু মুচকি হাসেন। বীণার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে বসুর জীবনে অনেক নিয়মকানুনের বেড়াজাল এসেছে। আগে যা খুশি করতেন। যা খুশি খেতেন। এখন আর সেটা পারেন না। আসলে জীবনটাতে যে এখনও কিছু দেওয়া-নেওয়ার আছে, সেটা বীণা আসার পরেই তিনি বুঝতে পেরেছেন। আজ খুব ইচ্ছে করছিল বীণাকে নিয়ে এক বার রবীন্দ্র সদন ঘুরে আসার। কিন্তু বীণার বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে ভেবেই কিছু বলতে পারলেন না। তিনি জানেন বীণা না বলবে না। তবুও তিনি চান না বীণাকে অন্তত তার জন্য কোথাও কথা শুনতে হোক। এই তো ক’দিন আগেই ক্লাসে এক বার বীণার টপ অল্প সরে গিয়ে ব্রা দেখা যাচ্ছিল। সেই নিয়ে পিছনে বসে থাকা অমল আর কিঙ্কর ফিকফিক করে হেসেছিল মাত্র। সহ্য হয়নি বসুর। দু’জনকেই চড় মারতে মারতে ক্লাস থেকে বাইরে করে দিয়েছিলেন। ছাত্ররাও অবাক হয়েছিল সে দিন বসুর এমন আচরণ দেখে। যিনি কোনও দিন বিশেষ বকুনি দেন না, তিনি চড় মেরে ক্লাস থেকে বাইরে বার করেও যে দিতে পারেন সেটা কেউ ভাবতেই পারেনি!

চায়ের কাপ দুটো ধুয়ে রান্নাঘরে রেখে এসে বীণা বলে, ‘‘স্যর এ বার আমি উঠলাম। আপনি পরশু না গেলে এটাই আমারও আপনার বাড়িতে শেষ আসা কিন্তু।’’

বীণা বেরিয়ে গেলে বসু গল্পটা রেখে একটা সিগারেট ধরিয়ে চোখ বন্ধ করে শরীরটা ফেলে দেন সোফায়। এখন আবার উত্তুরে হাওয়ায় ডুবে ডুবে বিষাক্ত মধু পানের সময়। এমন সময় ছেঁড়া-ফাটা স্মৃতি বুকের ভিতর ঘূর্ণিঝড় তোলে। তিস্তার স্মৃতিগুলো চোখে তিরতির করে কাঁপতে থাকে।

******

আজ বীণার জন্মদিন। বিকেলে ও নিজেই বসুকে নিতে এসেছিল। ধুতি পাঞ্জাবি পরে বসুকে কবি-সাহিত্যিক বলে মনে হচ্ছে। মানিয়েছে বেশ। গতকাল সন্ধেয় নিজে বাজার গিয়ে কুকুর বিক্রেতার কাছ থেকে বীণার জন্য একটা বুলডগের বাচ্চা কিনে এনেছেন। কয়েক মাস আগে বীণার জার্মান শেফার্ডটা অজানা রোগে মারা গিয়েছে। সেই নিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত বীণার মুখে হাসি ছিল না। বিকেলে স্যরের বাড়ি এসে কুকুরটাকে দেখার পরে বীণা যে কতটা খুশি হয়েছিল তা হয়তো বসুর ধারণার বাইরে। কলেজ জীবনে ওঁর নিজেরও একটা কুকুর ছিল। সেটা অবশ্য রোগে মরেনি। বয়েসের ভারেই মরেছিল। আজকে যখন বসুর বাড়িতে এসে কুকুরটাকে দেখেই ছুট্টে গিয়ে বীণা কোলে নিয়েছিল তখনই বসু জানিয়ে দিয়েছেন, কুকুরটা বীণার জন্মদিনের উপহার। বীণাও নিজের খুশি ধরে রাখতে পারেনি। কুকুর কোলে নিয়ে আদর করতে শুরু করে দিয়েছিল।

বীণার সঙ্গে ট্যাক্সিতে যেতে যেতে অকারণেই বসুর মনটা বারবার গুমরে উঠছিল ভিতরে ভিতরে। গাড়িটা বীণাদের বাড়ির গেটের সামনেই এসে দাঁড়াল। বসু পার্টির বাহার দেখেই বুঝে গেলেন বীণা ঠিক কতটা ধনী বাড়ির মেয়ে। কত লোক ঢুকছে বেরোচ্ছে, কারও সে দিকে খেয়াল নেই। এক হাতে কুকুরছানাটা কোলে নিয়ে, আর এক হাতে প্রায় টানতে টানতেই বসুকে বাড়ির ভিতরে ঢোকাল বীণা। তার পর একটা বেতের চেয়ারে বসতে বলেই ছুট্টে কোথায় উধাও হয়ে গেল।

প্রায় পনেরো মিনিট একলা বসে থেকে বীণাদের ঘরটা ঘুরে দেখার জন্য যখন তিনি উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরলেন, তখনই চোখে পড়ল বইয়ের তাকটার উপর। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন তিনি, তাঁর লেখা প্রতিটা কবিতা-গল্পের বই যত্নের সঙ্গে রাখা আছে। কোনও কবি বা লেখকের কাছে এর চেয়ে বড় পুরস্কার বা বড় খুশি আর কিসেই বা হতে পারে। বাইরের হইচই বসুর কানেও আসছে না আর। তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে থাকেন নিজের হাতে গড়া শিশুগুলোকে। এমন সময় ঘরে ঢুকল বীণা, ‘‘স্যর আমার মা। আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই ধরে নিয়ে এলাম।’’ হঠাৎ বীণার গলা শুনে পিছন ফিরে তাকালেন বসু। ‘‘আপনারা গল্প করুন আমি দেখি বাবা কোথায় আছে,’’ কথাটা বলেই বীণা আবার ছুটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায় বাবার খোঁজে।

বীণার মাকে দেখার পরই বসুর চোখ-মুখ বদলে গেল। এ তিনি কাকে দেখছেন! নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না নিজের। কোনও কথাই আর মুখ দিয়ে বার হল না। চারদিকটা যেন কেমন অন্ধকার হয়ে গেল এক নিমেষে। ধপাস করে একটা চেয়ারের উপর বসে পড়লেন বসু। বীণার মা নিষ্পলক ভাবে দেখছেন মেয়ের স্যরকে। ঠোঁট দুটো শুধু কাঁপল কয়েক বার।

রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে চারপাশের নীরবতা ভঙ্গ করে বসুই প্রথম কথা বললেন, ‘‘ভাল আছ বনশ্রী? পথ ভুলে যাওয়া দিবাস্বপ্নেও কোনও দিন দেখিনি আবার তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তুমি ঠিকই বলতে, পৃথিবীটা খুব একটা বড় নয়।’’ বনশ্রী কী উত্তর দেবেন! তখন যে তাঁর দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে নামছে একুশ বছর ধরে জমিয়ে রাখা জলের ধারা। তিনি চোখে দেখেননি এত দিন মানুষটাকে, কিন্তু মেয়ের বইয়ের আলমারি জুড়ে তো মানুষটা রয়েছে। রয়েছে কালো হরফে। ছাপানো পাতায়। কোনও দিন কাউকে কিছু বলেননি তিনি। দু’চোখ বন্ধ করে বসু আবার বললেন, ‘‘বীণা তোমার মতোই চঞ্চল হয়েছে। ওর ভিতরে কোথায় যেন তোমার একটা ছবি খুঁজে পেতাম। কিন্তু তোমার মেয়ে হতে পারে সেটা অবশ্য কোনও দিন ভাবিনি।’’

শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে বনশ্রী বললেন, ‘‘আমিই কী ভেবেছিলাম আমার মেয়ে কলেজে গিয়ে তার জন্ম-ইতিহাসের শেকড় খুঁজে পাবে। আসলে সাফল্যের সিঁড়ি যতই বড় হোক না কেন, সম্পর্কের শেকড় পরিচিত মাটির গন্ধ পেলে ঠিক পা ধরে টেনে নামাবেই ফেলে যাওয়া মাটির কাছে,’’ কথাটা বলেই চোখের জল মুছতে-মুছতে বেরিয়ে যান বনশ্রী দেবী।

একলা রাজার দেশে বসে প্রফেসর বসু চোখ বন্ধ করে খুঁজতে থাকেন বীণার জন্মের ইতিহাস। সেই ঝড়বৃষ্টির পাতা-ঝরা রাতটা। কেন বীণা তাঁকে এত টানত অদৃশ্য আকর্ষণে? কেন বীণাকে দেখার পর তিনি বদলে যাচ্ছিলেন? এই সব হাজার প্রশ্নের উত্তর মিলে যাচ্ছে এ বার একটা একটা করে। এক দিন বর্ষার রাতে বনশ্রীর ঘুমন্ত শরীরটা ফেলে রেখে যে সুমন বসু কলকাতার কলরবে ছুটেছিলেন সাফল্যের সিঁড়ির সন্ধানে, সিঁড়ি তো তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু সম্পর্কের শরীরী রাস্তায় সিঁড়ির চেয়ে শেকড়ের টান অনেক বেশি। তাই ইচ্ছে না থাকলেও ফিরে আসতেই হয় ধুলোমাখা ফেলে যাওয়া পথে।

একুশ বছর আগের সেই ঝড়বৃষ্টি ভাসিয়ে দিচ্ছে যখন বসুর চোখ দু’টোকে, ঠিক তখনি আবার ঘরে ঢুকে বীণা সুর ছিঁড়ে দেওয়া সুরে বলে, ‘‘স্যর, ইনি আমার বাবা। ডাক্তার বিজয় সেনগুপ্ত।’’ মেয়ের স্যরকে দেখে তিনি নমস্কার করলেন।

বাক্যহারা বসুর মুখ থেকে অস্ফুট শব্দে তখন কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে আসে, ‘‘বাবা! হ্যাঁ তোমারই তো বাবা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE