Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
ঋত্বিক ঘটক

বুক যেন ক্ষয়ে যেত

তখন সিক্স বা সেভেনে পড়ি। আমার চারপাশটা ছিল ভারী সাধারণ। খুব যে একটা সিনেমা-সাহিত্য-শাস্ত্রীয় সংগীতে ঘেরা পরিবেশে বড় হয়ে উঠছি— তা একেবারেই নয়। এমনই একটা সময় প্রথম ঋত্বিকের ছবি দেখা। ‘মেঘে ঢাকা তারা’। হল-এ দেখেছিলাম না টিভিতে, মনে নেই। মনে রয়ে গেছে শিল্পীর মারাত্মক প্রভাবটুকু। পরে বুঝেছি, একটা ছবি দেখলে, ভাবুক মানুষকে তা বোধ হয় দুটো স্তরে স্পর্শ করে।

অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

তখন সিক্স বা সেভেনে পড়ি। আমার চারপাশটা ছিল ভারী সাধারণ। খুব যে একটা সিনেমা-সাহিত্য-শাস্ত্রীয় সংগীতে ঘেরা পরিবেশে বড় হয়ে উঠছি— তা একেবারেই নয়। এমনই একটা সময় প্রথম ঋত্বিকের ছবি দেখা। ‘মেঘে ঢাকা তারা’। হল-এ দেখেছিলাম না টিভিতে, মনে নেই। মনে রয়ে গেছে শিল্পীর মারাত্মক প্রভাবটুকু। পরে বুঝেছি, একটা ছবি দেখলে, ভাবুক মানুষকে তা বোধ হয় দুটো স্তরে স্পর্শ করে। এক তো দেখে ভাল লাগে। আর দুই, ওই ওপর-ওপর দেখাটাকে ছাপিয়ে, ছবিটা তার মনের অনেক ভেতরমহলে ঢুকে পড়ে। তার অবচেতন, তার অস্তিত্বেরই একটা অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে নীতাদের গল্পের মিল তো ছিলই। আমার বাবা-জ্যাঠা পূর্ববঙ্গ থেকেই এসেছিলেন। জমি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা উত্তরাধিকারে পেয়েছি আমি। বেড়ে উঠেছি টালিগঞ্জ, বরানগর— এই দুটো জায়গার মধ্যে। ওই অঞ্চলে কলোনি ছিল অনেক। মনে হত পূর্ববঙ্গেই আছি। তার ওপর ওই ছোট বয়স থেকে আলো আমার খুব ভাল লাগত। আর শুনতে অবাক লাগবে, আমাকে টানত গাছের নানা রকম চেহারা। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছিল আমার মনের জিনিসে ভরা। আলো-ছায়ার খেলা মিলিয়ে, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের যাওয়ার সময় লং শটে গাছের ছবি তুলে চমৎকার সব দৃশ্যকল্প ব্যবহার করেছিলেন ঋত্বিক। তেমনই অসাধারণ শব্দের ব্যবহার। এ টি কাননের গলায় হংসধ্বনি রাগের একটা অপূর্ব খেয়াল ছিল। অনিল চট্টোপাধ্যায় প্রায়ই গাইতেন সেটা: ‘জয় মাতা...’। আমার কান ছুঁয়ে প্রাণের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল সেই সংগীত। নীতা গেয়েছিল ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’। কখনও সে কথা বলছে, তার সংলাপের মধ্যে মধ্যে মিশে যাচ্ছে প্যাঁচার ডাক। আর একটা দৃশ্যে ওয়াইড অ্যাঙ্গল শট-এ, নীতার বাবার চরিত্রাভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য ‘আই অ্যাকিউজ’ বলেন। এক সময় ঋত্বিক দেখালেন নীতা তার প্রেমিককে নিজের বোনের সঙ্গে দেখেছে। চরম মনের আঘাত নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে সে। ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে তীব্র হয়ে উঠল সপাং সপাং চাবুকের আওয়াজ। সিনেমার অ-আ-ক-খ কিছুই জানি না আমি সে দিন। কিন্তু পাগলের মতো ভালবেসে ফেলেছিলাম সেই সব শব্দের জাদু।

পরে ভিডিয়ো ক্যাসেট জোগাড় করে আবার দেখি সিনেমাটা। এক বার দু’বার করে সাত-আট বারেরও বেশি। তত দিনে আমিও কিছুটা বদলেছি। হিন্দুস্থানি ক্লাসিকাল মিউজিক শুনছি খুব। ফিল্ম-ছাত্রের মতো সিনেমা দেখা শুরু করেছি। বার্গম্যান-তারকভস্কি দেখে ফেলেছি। এই পোক্ত চোখে ঋত্বিক দেখা দিলেন সিনেমা-ঐশ্বর্যের গুপ্তভাণ্ডার হয়ে। সিনেমায় তিনি কী মুনশিয়ানায় মানব-সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে কাজ করেছেন, আর একটু বিশদ ভাবে বুঝতে পারলাম। আমার চেনা লোকেদের মধ্যেই এক নীতা ছিল। সেই মেয়েটিও বিয়ে করেনি, সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তাকে কাছ থেকে দেখার সুবাদে আমার নীতার সঙ্গে আত্মীয়তা আরও বেড়ে গেল। মনে হত যেন নিজের দিদি। তবে ঋত্বিককে সামনাসামনি দেখার সুযোগ না পেলেও, আমি সুপ্রিয়াদিকে দেখেছি। তাঁর সঙ্গে মিশেছি। উনি তো নিজেই নীতা। এমন আত্মত্যাগী মানুষ কি দেখা যায়? তাঁর কাছে শুনেছি ঋত্বিকের কত কথা। কেমন করে শটের পর শট নিতেন মানুষটা। সুপ্রিয়াদিকে ডাকতেন, ‘অ্যাই ছেমড়ি এ দিকে আয়।’ ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’— বিখ্যাত এই সংলাপটা বলার সময় কেমন করে ক্যামেরা ঘুরিয়েছিলেন। আমার এক ক্যামেরাম্যান থাকেন মুম্বইতে। তাঁর ভারী সাধ সুপ্রিয়াদির সঙ্গে আলাপ করার। তার কারণ, ‘ঘটক কা নীতা হ্যায় উয়ো।’

সিনেমা মাধ্যমটার এক ঈশ্বর হলেন ঋত্বিক। যেমন শক্তিশালী ভিশুয়াল নির্মাণ, তেমনই অতুলনীয় সাউন্ডট্র্যাক নির্বাচন। ওই ‘পাওয়ার অব ইমেজ’ ভোলে কার সাধ্য! অথচ কত কষ্ট করে, কত কম বাজেটের মধ্যে ছবি তৈরি করতেন বলে শুনেছি! এত সব বাধা কাটিয়েও, অনবদ্য লেন্স ব্যবহার করে সিনেমার যে ভাষা তিনি তৈরি করেছিলেন, তা আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল একেবারে। তখন তো ইংরেজি সিনেমা বেশি দেখতে পেতাম না। যতগুলো বাংলা ছবি দেখেছি, আর কোত্থাও এমন কিছু দেখিনি। ‘অযান্ত্রিক’ ছবিটা তো একটা গাড়ি নিয়ে। একটা জড়বস্তু মাত্র। ঋত্বিক তাতেও প্রাণসঞ্চার করে অবাক করে দিলেন। গাড়ির দুঃখ-কষ্ট-বেদনার কথা উঠে এল স্ক্রিনে। ‘সুবর্ণরেখা’ বা ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় তিনি বারবার অতিনাটকীয়তা ব্যবহার করেছেন। আর সেই সব মুহূর্তে ভরে দিয়েছেন উথালপাথাল আবেগ। গোটা দৃশ্য অন্য স্তরে পৌঁছে গেছে। ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে এক জায়গায় ছিল, কাজের লোক বলছে— এখানে প্রজাপতি পাওয়া যায়, এখানে কী সুন্দর সূর্য ওঠে— এই রকম কিছু। সেই প্রেক্ষিতে অভী ভট্টাচার্য বলছেন, বাচ্চাদের মিথ্যে বলতে নেই। কী আশ্চর্য, যে মেয়েটি মারা গিয়েছিল, বিশ বছর পরে তার নাতি ফিরে এসে প্রশ্ন করছে, এখানে কি প্রজাপতি পাওয়া যায়? এখানে কি সূর্য ওঠে? অভী তার উত্তর দিতে পারছেন না। জীবনের মধ্যে থাকা এই নাটকগুলো কত জটিল! কিন্তু ঋত্বিক এমন অনায়াসে তাদের সাজাতেন যে দর্শক কেঁপে যেত। এমন হাহাকার উঠত, মনে হত বুকটা ক্ষয়ে গেছে। অজান্তে চোখ দিয়ে জল গড়াত। এ সব কারণেই তো ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’র মতো ছবিগুলো আমাদের রক্ত-মাংস-মজ্জায় মিশে রয়েছে।

আমস্টারডামে এক বার ভ্যান গখের ছবির গ্যালারিতে গিয়েছিলাম। ওঁর ক্যানভাসে গ্রামের মানুষ ছিল, নিপীড়িত চাষির কষ্ট ছিল। দেখে আমার মনে হল, ঋত্বিকও তো তা-ই করেছিলেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিপাট দরিদ্র বাঙালির কথা এমন ভাবে কেউ কখনও বলতে পেরেছে? ওই প্রচণ্ড অভাববোধকেও তিনি পরিপূর্ণ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। সত্যজিৎবাবু বোধহয় কখনও বলেছিলেন, ঋত্বিক আমাদের মধ্যে ‘সবথেকে বাঙালি’ পরিচালক। ঠিকই তো! ওঁর সিনেমায় তো জলজ্যান্ত পাশের বাড়ির চরিত্ররাই থাকে। সিনেমা দেখছি বলে মনেই হয় না। মনে হয় পাশেই ঘটনাগুলো ঘটছে। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব!

একমাত্র সত্যিকারের শিল্পীরই তো এই আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে। ঋত্বিক ঘটকই আমার রোলমডেল। মানুষকে সিট থেকে তুলে সিনেমায় বসিয়ে দিতে পারতেন তিনি। যে মানুষ এই আবেগ-থরথর বাংলা সিনেমাগুলো বানিয়েছে, সেই মানুষই মুম্বই গিয়ে ‘মধুমতী’ লিখেছে। সেটা আবার আদ্যোপান্ত বাণিজ্যিক ছবি। প্রতিভার বিস্তার কতটা হলে তা করা যায়! ওঁর যত ছবি দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, ওঁর ব্যক্তিত্ব ছিল অসম্ভব ঋজু। নিজের বিশ্বাসটা স্পষ্ট ভাবে বলতে জানতেন। সেই অকপট ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই মিশেছে অমন বোহেমিয়ানিজ্ম। অমন দমকা হাওয়ার মতো আবেগ। সাধে কি ওঁর সৃষ্টিগুলি ও রকম তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়? আত্মিক যোগাযোগ তৈরি করে? আজকের পৃথিবীতে তো আদর্শের বড় অভাব। তাই বারে বারে একটাই কথা মনে হয়, ঋত্বিক যদি পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে আসতেন এক বার। আহা!

aroychowdhury@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE