বারাণসীর অলিগলি পিছনে ফেলে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। গন্তব্য বারাণসী থেকে প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরে চন্দ্রপ্রভা অভয়ারণ্য। বারাণসীর মন্দির-ঘাট বারকয়েক ঘুরেছি। তাই এ বার অন্য কিছু দেখতে চাইছিলাম। তখনই গুগল ঘেঁটে চন্দ্রপ্রভা অভয়ারণ্য আর তার ভিতরে রাজদারী জলপ্রপাতের কথা জানতে পারি।
অভয়ারণ্যে প্রবেশের মুখে গাড়ির পারমিট আর জনপ্রতি টিকিট করার পরে গাড়ি এগিয়ে চলল জঙ্গলের পথ ধরে। রাস্তার দু’ধারে বিশাল বিশাল গাছ। আঠেরোশো শতাব্দীর মাঝের দিকে এই জঙ্গল ছিল বারাণসীর শাসকদের শিকারস্থল। প্রায় ৭৮ বর্গ কিলোমিটারের এই জঙ্গলকে ১৯৫৭ সালের মে মাসে অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, এশিয়াটিক সিংহের বংশবৃদ্ধি করা। সেই কারণে অভয়ারণ্যে ছাড়া হয় তিনটি সিংহ। প্রথম দিকে সিংহের সংখ্যা ভাল বৃদ্ধি পেলেও, হঠাৎ করেই সিংহের সংখ্যা কমতে থাকে। পরবর্তী কালে তারা হারিয়ে যায়। মহুয়া, সেগুন, সোনালু, তেন্ডু বিশাল বিশাল বৃক্ষে ঘেরা এই অভয়ারণ্য বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বাসস্থল। দেখা মেলে, কৃষ্ণসার হরিণ, চিতল হরিণ, সম্বর, নীলগাই, বুনো শুয়োর, সজারু আরও অনেক প্রাণীর। কখনও কখনও অজগরেরও দেখা মেলে। প্রায় দেড়শো প্রজাতির পাখি আছে এখানে। যার মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির সারস আর বাজ খুব উল্লেখ্যযোগ্য।
জঙ্গলের পথ ধরে কিছুক্ষণ চলার পরে গাড়ি থামিয়ে চালক বললেন, এ বার হেঁটে যেতে হবে। গাড়ি থেকে নামতেই জলরাশির গর্জনের আওয়াজ কানে আসতে লাগল। যতই এগিয়ে চলেছি, সেই গর্জন প্রবল থেকে প্রবলতর হতে লাগল। অবশেষে দেখা মিলল রাজদারী জলপ্রপাতের। চন্দ্রপ্রভা হ্রদের জলে পুষ্ট চন্দ্রপ্রভা নদীর এই জলপ্রপাত। বিপুল জলরাশি ধাপে ধাপে নেমে এসে ঝাঁপ দিচ্ছে প্রায় পঁয়ষট্টি মিটার গভীর নদীখাতে। জলপ্রপাতের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বন দফতর যে ভাবে পরিকল্পনামাফিক জায়গাটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। কখনও সামনের রেলিংয়ের ধারে গিয়ে বা কখনও সিঁড়িপথ বেয়ে বেশ কিছুটা উপরে উঠে এসে প্রায় সোজাসুজি দেখতে পাওয়া যায় বিশাল চওড়া জলপ্রপাতের গতিপথ। জলপ্রপাত যেখান থেকে নেমে আসছে সে দিকে এগোলাম। পাথুরে পথ ধরে কিছুটা এগোতেই পৌঁছে গেলাম জলপ্রপাতের মাথায়। বিশাল জলরাশির অবিশ্রান্ত প্রবাহ হু হু করে নীচে নেমে যাচ্ছে আর বয়ে চলেছে দু’দিকে সবুজ নদীখাতের মধ্য দিয়ে। ছড়িয়ে পড়ছে জলের ফেনা ও বাষ্প।
ওখান থেকে নদীর পাড় ধরে কিছুটা এগিয়ে বসে পড়লাম পাথরের উপরে। ঠান্ডা বাতাস আর বয়ে যাওয়া নদীর কলকল শব্দ সব ক্লান্তি দূর করে দিল। রাজদারী জলপ্রপাত দেখে ফেরার সময় দেখে নিলাম ওই নদীরই আর একটা জলপ্রপাত দেবদারী, যা রাজদারী থেকে প্রায় ৫০০ মিটার নীচে অবস্থিত। জলপ্রপাত দেখে বারাণসী ফেরার পথে দেখে নিতে পারেন শতাব্দীপ্রাচীন বিখ্যাত চুনারগড়।