বেড়ানো মানে শুধুই নতুন জায়গা দেখা, না কি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া? কোলাহল, কাজ এই সব কিছু থেকে দূরে কোথাও গিয়ে নিরালা, নিভৃত স্থানে সময় কাটাতে চান? তা হলে চলুন গোপীবল্লভপুর। সেখান থেকে ঘুরে নিন অরণ্যের গহীনে তপোবন। এই পথের বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্য, শুধু ব্যস্ত শহর থেকে বেরিয়ে পড়লেই হল।
কলকাতা থেকে কাছেপিঠে ঘোরার তালিকায় নাম থাকে ঝাড়গ্রামের। ঝাড়গ্রাম শহরটিও সুন্দর। সেখানেও রাজবাড়ি আছে। ঘুরে নেওয়া যায় কনকদুর্গা মন্দির, ডুলুং নদী। আর আছে শালের ঘন বন। তবে ঝাড়গ্রাম হয়ে গোপীবল্লভপুরের দিকে গাড়ি ছোটালেও পথের সৌন্দর্য মুগ্ধ করবেই।
গোপীবল্লভপুরে দেখা হয়ে যাবে সুবর্ণরেখার সঙ্গে। সাহিত্যের পাতায় তার নাম এসেছে বারে বারে। লোকে বলেন, এই নদীর বালুচরে মিশে থাকে সোনার কণা। তা থেকেই নাম সুবর্ণরেখা। বালি-জল ছেঁকে বহু পরিশ্রমে নাকি সংগৃহীত হয় স্বর্ণকণা। তবে সোনার নদীর রূপ কিন্তু এই পুজোয় বেশ উপভোগ্য হতে পারে। বর্ষার জলে পুষ্ট নদীটি এই বছর টানা বৃষ্টিতে কানায় কানায় পূর্ণ। নদীর এক্কেবারে গায়ে থাকার জন্য তৈরি হয়েছে হোম স্টে।
সুবর্ণরেখায় সূর্যাস্ত। ছবি: সংগৃহীত।
এ বার আসা যাক বেড়ানোর কথায়। চারচাকায় ভ্রমণ মানেই তো ঘুরতে ঘুরতে, থামতে থামতে যাওয়া। পথের ধারে খাওয়া। বেরিয়ে পড়ুন কলকাতা থেকে কোলাঘাট, রতুলিয়া, খড়্গপুর হয়ে।কলাইকুন্ডা পার হলেই শুরু হয় লোধাশুলির জঙ্গল। শাল, শিমুল, পলাশের ঘন অরণ্য। পিচরাস্তা গিয়েছে তারই মাঝখান দিয়ে। লোধাশুলি পার করে ফেকো মোড় হয়ে রাস্তা বেঁকেছে। সেখান থেকে গোপীবল্লভপুর। সুবর্ণরেখার রূপ উপভোগ করতে চলে আসতে পারেন কুঠিঘাটে। এখানে রয়েছে পিকনিক স্পট। নদীর দারুণ ভিউ পাওয়া যায়।
একটি রাত এখানে থাকলে আশপাশ ভাল ভাবে ঘোরা যায়। ১২টার মধ্যে পৌঁছলে মধ্যাহ্নভোজ সেরে, খানিক বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন তপোবন এবং রামেশ্বর মন্দির দেখতে। তপোবন ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। তবে এখানেও দেখতে পাবেন বাল্মীকি আশ্রম, সীতা নালা এবং এই সব স্থান ঘিরে থাকা অরণ্য। গোপীবল্লভপুর শহর থেকে দূরত্ব ২২-২৫ কিলোমিটার। পিচরাস্তা গিয়েছে বনের ভিতরে। তপোবনের পথ নির্দেশিকা পেয়ে যাবেন রাস্তার ধারের বোর্ডে।
এখন দুকূল ছাপানো জল সুবর্ণরেখায়। ছবি: সংগৃহীত।
লোকমুখে প্রচলিত, এই স্থানেই না কি দস্যু রত্নাকর 'মরা' থেকে রাম নাম জপে, পাপস্খলন করে বাল্মীকি হয়েছিলেন। ধ্যান করার সময় তাঁর গায়ে উইয়ের ঢিবি হয়ে গিয়েছিল। লোকমুখে শোনা যায়, এখানেই লব-কুশ বড় হয়েছিলেন।
সত্যি-মিথ্য বিচার না করেই বরং এই স্থান ঘুরে নিতে পারেন। খুবই নিরিবিলি পরিবেশ। রয়েছে উইয়ের ঢিবি। সীতার মন্দির। অনির্বাণ প্রজ্জ্বলিত ধুনি। এখানকার পুরোহিতেরা কাঠকুঠোর জোগান দিয়ে তা নিরন্তর জ্বালিয়ে রাখেন। এখানে রয়েছে হনুমানের মন্দির।
ঘুরে নিতে পারেন গাছগাছালি ঘেরা তপোবন। ছবি: সংগৃহীত।
এই চত্বর ধরে খানিক এগোলেই দেখা মিলবে সীতা নালা। বর্ষার পরে এতে ভালই জল থাকে। অরণ্যে নুন দেওয়া মাটি চেটে খেতে নাকি হরিণও আসে, স্থানীয়েরা কেউ কেউ বলেন।
তপোবন ঘুরে চলে আসুন রামেশ্বর শিব মন্দিরে। দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। পুরনো এই মন্দিরটি নবকলেবরে সেজে উঠেছে। প্রাচীনত্বের চিহ্ন বহন করছে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্তম্ভগুলি। গাছগাছালি ঘেরা শান্ত মন্দির চত্বর। আশপাশে দেখা যায় সিঁদুর লেপা একাধিক ছোট ছোট মহিষের মূর্তি। মন্দির চত্বর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামলে মিলবে রামেশ্বর সরোবর। ঘুরে নিতে পারেন গোপীবল্লভপুর ইকোপার্ক। সুবর্ণরেখার একেবারে কাছেই এটি।
রামেশ্বর মন্দির। রয়ে গিয়েছে পুরনো মন্দিরের ক্ষয়ে যাওয়া স্তম্ভ। ছবি: সংগৃহীত।
ঘুরে নেওয়া যায় অনেক জায়গাই, যেমন ঝিল্লি পাখিরালয়। সুবিশাল হ্রদকে কেন্দ্র করে জায়গাটি তৈরি। শীতের দিনে পরিযায়ী পাখি আসে। বছরভর গাছগাছালি ভরা এই স্থানে নানা রকম পাখির দেখা মেলে। যেমন, ছোট সরাল, গ্যাডওয়াল, নদার্ন পিনটেল। হ্রদে বোটিংয়ের ব্যবস্থা আছে। রয়েছে থাকার বন্দোবস্তও। এখান থেকে ঘুরে নিতে পারেন হাতিবাড়ির জঙ্গলও। এই জায়গাটিও খুব সুন্দর। ঘুরে নিতে পারেন রাজা দশরথ মাহাতোর বাড়ি। যদিও তা ভগ্নদশাপ্রাপ্ত।
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে গোপীবল্লভপুর আসার সহজ রাস্তা হল কোলাঘাট, রতুলিয়া, খড়্গপুর, কলাইকুন্ডা, ফেকো মোড় হয়ে গোপীবল্লভপুর। তবে ঝাড়গ্রাম হয়েও আসতে পারেন। সে ক্ষেত্রে লোধাশুলি থেকে ঝাড়গ্রামের দিকে যেহে হবে। কলকাতা থেকে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক (মুম্বই-কলকাতা মহাসড়ক) দিয়ে ঝাড়গ্রামে পৌঁছতে পারেন। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে সড়কপথে গোপীবল্লভপুর ৪২ কিলোমিটার, গোপীবল্লভপুর থেকে সড়কপথে ২২ কিলোমিটার পথ ধরে এগোলেই তপোবন । ট্রেনে গেলে ঝাড়গ্রামে নেমে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে নিতে হবে।
কোখায় থাকবেন?
কুঠিঘাট বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা গেলেই পিকনিক স্পট। সুবর্ণরেখার ধারেই থাকার একটি জায়গা হয়েছে। এ ছাড়াও গোপীবল্লভপুরে থাকার হোটেল পেয়ে যাবেন। যদিও সংখ্যাও কম। ঝিল্লিতেও থাকার জায়গা রয়েছে।