লক্ষ্মী পুজোর পরের দিন হাওড়া থেকে দুরন্ত এক্সপ্রেসের কর্মীদের আতিথেয়তায় চমৎকৃত হয়ে মুম্বই পৌঁছে দিন চারেকেই দেশের বাণিজ্য শহরটা দেখা হয়ে গেল। তার পর? জনা আটেকের পারিবারিক টিম নিয়ে তাই চলেছি কোঙ্কন রেলপথে মাণ্ডবি এক্সপ্রেসের সওয়ারি হয়ে গোয়া। ডান দিকে আরব সাগরকে সঙ্গী করে বাঁ দিকে আকাশ ছুঁই ছুঁই পশ্চিমঘাট ফুঁড়ে অরণ্য চিরে কোঙ্কন রেল কর্তৃপক্ষ যে পথটি তৈরি করেছে , এক কথায় তা অনবদ্য।
২৬ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে এই রেলপথের সূচনা হয়েছিল। পাহাড়-পর্বত, সমুদ্রের সঙ্গে রেললাইনের ধারে ধারে পাহাড়ের গায়ে অজস্র ঝোড়া, ঝর্ণা, জলপ্রপাত, অরণ্য গাছগাছালি ও প্রাণিসম্পদে সমৃদ্ধ এই কোঙ্কন তটভূমি ফুঁড়ে চলেছে এই রেলপথ। আমরাও চলেছি অবাক বিস্ময়ে মাণ্ডবী এক্সপ্রেসে— অসংখ্য ছোট বড় পাহাড় ডিঙিয়ে, পাহাড়ি সুড়ঙ্গ পথ ফুঁড়ে, সমুদ্রের নীল আর আরণ্যক সবুজের মধুরিমা মেখে। মুহুর্মুহু আসছে পাহাড় চিরে সুড়ঙ্গ রেলপথ বা টানেল—অতিক্রম করলাম সবচেয়ে দীর্ঘ টানেল প্রায় ৯ কিলোমিটার। এ যেন ড্রিল মেশিন দিয়ে সুন্দর, সূক্ষ্ম, সুচারু রূপে কোনও কারিগরের হাতে পাহাড় ফুটো করে তৈরি হয়েছে এই সুড়ঙ্গ রেলপথ। মুম্বই অথবা কলকাতা থেকে গোয়া যাওয়ার বিভিন্ন পথ আছে—কিন্তু এই পথটি আমরা বেছে নিয়েছিলাম।
মুম্বই ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস রেলস্টেশন থেকে এই ট্রেন ছেড়েছিল সকাল ৭-১৫’টায়। নামব প্রায় রাত আটটায়। সারা দিনের এই ১২-১৩ ঘণ্টা সময় কী করে যে কেটে গেল তা টেরই পাওয়া গেল না। অদ্ভুত রোমাঞ্চ আর মজায় ভরা এ সফর ‘বোম্বে টু গোয়া’। এসে গেল রেলপথে গোয়া রাজ্যের প্রবেশ দ্বার ‘থিভিম’ স্টেশন। এখান থেকে আমাদের অগ্রিম বুকিং করা রিসর্ট ক্যান্ডোলিম বিচে— প্রায় এক ঘণ্টার সড়ক পথ।
সমুদ্রের ধারেই রিসর্ট। তাই সকাল হতেই আর তর সইল না—দৌড়লাম সমুদ্রের দিকে—তার ছোঁয়া পেতে। রাত থেকেই জোরে হাওয়া চলছিল। সমুদ্রের কাছে গিয়ে টের পেলাম জোরে হাওয়া বা ঝড় উঠলে কী রূপ হয় সাগরের। দূর থেকে বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পায়ের কাছে। সমুদ্রের এই রূপ দেখে একটু ভয় যেমন হচ্ছে তেমনই উত্তেজনা, রোমাঞ্চও হচ্ছে বইকি।
আরব সাগরের তীর ছুঁয়ে থাকা ছোট রাস্তা গোয়া পর্যটকদের কাছে সব সময় আকর্ষণীয়। এক দিকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা অন্য দিকে প্রায় ১০০ কিমি দীর্ঘ সমুদ্ররেখা।
গুণীজনদের কাছ থেকে শোনা বা জানা— হিন্দু পুরাণে কথিত আছে ভগবান বিষ্ণুর সৃষ্টি গোয়া। প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন রাজবংশ রাজত্ব করেছে এখানে। সবশেষে পর্তুগিজদের হাত থেকে গোয়া অধিগ্রহণের পর ১৯৮৭ সালে ভারতের নবীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
হিন্দু, খ্রিস্টান ছাড়াও অন্যান্য জাতির বাস এখানে থাকলেও বর্তমানে সমগ্র রাজ্যে যেন পর্তুগিজ সমাজের ছায়া এখনও প্রকট। রাজ্যের প্রধান অর্থকরী উপাদান—পর্যটন। তাই সারা বছর দেশ বিদেশের পর্যটকদের সমাগম হয় এখানে। তাই এখানে এসে তাঁদের থাকা-খাওয়ার কোনও সমস্যা হয় না কারণ প্রতিটি শহরে, প্রতিটি সি-বিচে ছোট বড় নানা আকার আকৃতির হোটেল এবং রেসটুরেন্ট যেন মেলা বসেছে।
পর্যটকদের সুবিধার জন্য খরস্রোতা মাণ্ডবী নদীকে মাঝখানে রেখে গোয়াকে নর্থ এবং সাউথ এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
এখানে প্রধান দ্রষ্টব্য সমুদ্র সৈকত বা বালুকাবেলাগুলি। গোটা রাজ্য জুড়ে অসংখ্য সি-বিচ। এই সমস্ত সি-বিচগুলি ভারতীয় তো বটেই বিদেশিদের কাছেও অত্যন্ত জনপ্রিয়। সে জন্যই প্রায় সর্বত্রই তাঁদের দেখা মেলে।
নর্থ গোয়াতে ভ্যাগাটেরি, বাগা, ক্যালাসগুটে, ক্যান্ডেলিন, বিচোলিম, অ্যাসজুনা মিরাকার প্রভৃতি বিচগুতে ঘোরার পর যাওয়া যায় সমুদ্র তীরবর্তী আগুয়াদা ফোর্ট বা দুর্গ যা গোয়াকে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ১৬৬২ সালে নির্মাণ করেছিল পর্তুগিজরা। কোকো বিচে গিয়ে ছোট লঞ্চে উঠে বিপদসঙ্কুল মাঝ সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে ডলফিনদের ডিগবাজির কেরামতি শরীরে শিরহণ তুলে দেয়। এখান থেকে বাণিজ্যিক শহর মাপুসায় কিছু সময় কেনাকাটার জন্য অবশ্যই ব্যয় করতে হয়।
সাউথ গোয়াতে প্রধান দ্রষ্টব্য হেরিটেজ সাইটের একমাত্র পথ ‘ব্যাসিলিকা অফ বমনিসাস চার্চ’। এর বিপরীতে দুটি প্রাচীন গির্জা ওল্ড ক্যাথিড্রাল এবং কনভেন্ট অফ সেন্ট ফ্র্যান্সিস অফ অ্যাসেমি। মূলত বিশ্বের ক্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। সাউথ গোয়াতেই আছে কোলাবা বিচ—কিং অফ বিচেস। রাজধানী পানাজি আর আছে ডোনা পাওলা বে। মাণ্ডবী আর জুয়ারি নদী সমুদ্রে এসে মিশে গিয়েছে ঠিক সেই স্থানে টিলার উপরে ডোনা-পাওলার যুগল মর্মর মূর্তি অবস্থিত।
কথিত আছে পতুর্গিজ ভাইসরয় কন্যার সঙ্গে স্থানীয় হেলে-পাওলার অসম প্রেমের সলিল সমাধির স্মৃতিতে ডোনা-পাওলা বে নির্মিত।
বিশাল ভারতের চতুর্দিকে প্রকৃতির অনাবিল দানের ছড়াছড়ি। প্রকৃতির এই দান ভারতেকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে। আমার দেশ ভারতবর্ষ—আমি গর্বিত।
কী ভাবে যাবেন — কলকাতা অথবা মুম্বাই থেকে বিমান পথে এবং রেলপথে অনেক ট্রেনে গোয়া যাওয়া যায়।
কখন যাবেন — বছরের যে কোনও সময়। তবে অক্টোবর-ডিসেম্বরে যেতে পারলে ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy