Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পাখিদের পাঠশালায়
Mangalajodi

ওড়িশার মংলাজোরিতে পরিযায়ী পাখিদের হাতছানি

শীতের আমেজ পড়তেই হাজার হাজার ভিনদেশি অতিথি পাখিরা এসে ভিড় জমায়।

অস্তরাগের আলো: তখন ঘাটে এসে ভিড়েছে নৌকা...

অস্তরাগের আলো: তখন ঘাটে এসে ভিড়েছে নৌকা...

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

পাখপাখালির দেদার মৌরসিপাট্টা মংলাজোরিতে। নল খাগড়া-হোগলা-শর বনবাদাড় ও খাঁড়ি নিয়েই ওড়িশার চিলিকা হ্রদের উত্তর-পশ্চিমে পাখিদের উপনিবেশ মংলাজোরি পক্ষিপ্রেমীদের কাছে পরিচিত নাম।

শীতের আমেজ পড়তেই হাজার হাজার ভিনদেশি অতিথি পাখিরা এসে ভিড় জমায়। ক্যাসপিয়ান সাগর, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া, লাদাখ, রাশিয়া, সাইবেরিয়া, মোঙ্গোলিয়া, আফগানিস্থান, হিমালয় থেকে মংলাজোরির পরিবেশে হাজির হয় যাযাবর পাখিরা। বংশবৃদ্ধির প্রয়োজন তো রয়েছেই, পাশাপাশি নির্মম আবহাওয়া, খাবারের খোঁজে তারা চলে আসে আপাত নিরাপদ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে।

রত্নাকর থেকে বাল্মীকিতে উত্তরণের এক অবাক করা গল্প পাখিদের আঁতুড়ঘর মংলাজোরি। একটা সময়ে গ্রামের চোরাশিকারিরা যথেচ্ছ পাখি হত্যা করত। আজ তারাই রূপান্তরিত হয়েছে পাখি সংরক্ষক ও পাখি প্রদর্শকের ভূমিকায়। স্থানীয় এক ব্যক্তি এলাকাবাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন পাখি শিকার না করে, বরং পাখিদের আতিথেয়তা ও ভরণপোষণে মনোনিবেশ করতে। ক্রমশ গ্রামবাসীরা উন্নীত হয়েছেন পক্ষিপ্রেমীতে। মৎস্যজীবিকার সঙ্গে এখন এটিও তাঁদের শখের পেশা।

মংলাজোরি ইকো টুরিজ়মের আওতায় গ্রাম-লাগোয়া প্রায় ১০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ জলাভূমি। দূরে অনুচ্চ পাহাড়, টিলা। অটো ভাড়া করে গ্রামের ভিতর দিয়ে জলাভূমির কাছে পৌঁছলাম। জলাভূমির মাঝ বরাবর মেঠো পথ উজিয়ে নজরমিনার ও বোটিং পয়েন্ট। জলাভূমির দুই পাড়ে সার দিয়ে ধীবরদের ডিঙি বাঁধা। জাল বোনা, গলুই ছেঁচে জল মুক্ত করা, সদ্য তোলা মাছ আড়তদারকে পাইকারি দরে বিক্রিবাটা— এ সবই এ তল্লাটের রোজনামচা। টিকিট কেটে পানসির ছইয়ের মধ্যে সিঁধিয়ে পা ঝুলিয়ে বসি। নল-হোগলা ঝোপের পাশ কাটিয়ে লগি টেনে পানসি এগিয়ে নিয়ে চলেন মাঝি। তিনি পাখি প্রদর্শক, আমাদের একটি সাধারণ দূরবীন এগিয়ে দেন। বিদেশি বইয়ের পাতা উল্টে নানান পাখির অবয়ব, ডানার রকমফের, ঠোঁটের বাহার, পালকের রং চেনাচ্ছিলেন। খাঁড়িপথে ভাসার পর থেকেই নজরে পড়ছে হরেক দেশি-বিদেশি পাখির গতিবিধি। চোখের সামনে যেন টেলিভিশনের পর্দায় অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট অথবা ডিসকভারি চ্যানেল খুলে রাখা। পাখিদের জমাটি আড্ডা কোথাও ঝাঁকে ঝাঁকে, কোথাও আবার ছড়িয়েছিটিয়ে। কিচিরমিচির ডাকে ছয়লাপ মংলাজোরি।

ক্রমশ চেনা হতে থাকে হুইস্কার্ড টার্ন, কটন টিল, লিটল গ্রেব, ব্ল্যাক টেইলড গডউইট, আইবিস, অসপ্রে... কত কী! এত বিস্তর বিদেশি পাখির নির্মল রাজ্যপাট চোখের নাগালে দেখতে পাওয়া, তাদের অপ্রতিম চঞ্চলতাকে নিবিড় ভাবে পরখ করা শহুরে পর্যটকদের কাছে সৌভাগ্য।

পক্ষীবিশারদ নই। সেই অর্থে অ্যামেচার বার্ড ওয়াচার বা বার্ড ফোটোগ্রাফারও নই। কেবল অপলক নিরীক্ষণ করে যাই এই জলবাসরে হরেক প্রজাতি পক্ষীকুলের নিরন্তর ওড়াউড়ি, ডানা ঝাপটিয়ে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার কায়দা, আকাশে অনর্গল পাক খেতে থাকা, ভেজা ঝোপঝাড়ে খুঁটে খুঁটে খাওয়া জলচর খাদ্য। কখনও চকিতে জল থেকে ছোঁ মেরে ঠোঁটের ডগায় তুলে নিচ্ছে ছোট মাছ। তাদের উড়ন্ত পাখনা থেকে কী অপূর্ব ভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে জলের ছিটে। ভারী মনোরম সে দৃশ্য। এ দিকে আবার দেশীয় কিছু পাখি যেমন শামুকখোল, মাছরাঙা, কালো বক, জলমোরগ, সারস, পানকৌড়ি, ব্রাহ্মণী হাঁস, বালি হাঁস, জলকুকুট, গাংচিল সঙ্গত দিচ্ছে অতিথি পরিযায়ীদের। পাখিদের চমৎকার জমজমাট পাঠশালা। প্রকৃতির নির্জনতার মর্যাদা রেখে নিজেদের মধ্যে কথা বলি ফিসফিস করে।

শুধুই কী আর পাখি দেখা? ক্যামেরার লেন্সের সঙ্গে মনের কুঠুরিতেও টুকে রাখি মংলাজোরির প্রতিটি মুহূর্তকথা। দৃষ্টির নাগালে থাকা পাখিদের সঙ্গে মনে মনে কত যে সাধ-আহ্লাদের গল্প জুড়ি। ওরাও যে রমণীয় করে রেখেছে আমার এই ঘণ্টা তিনেকের নিপাট জলভ্রমণ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mangalajodi Migratory Birds Odisha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE