কাটরা পৌঁছে হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে অনলাইনে টিকিট কেটে ছুটলাম বৈষ্ণো দেবী দর্শনে। হোটেল থেকে চক পৌঁছতে সময় লাগল মিনিট চারেক। রাস্তার দু’ধারে দোকানপাট খোলা থাকলেও লোক নেই। অথচ অন্য সময়ে এখানে জনারণ্য, হাঁটার জায়গাটুকু মিলত না। চক থেকে অটোয় নামলাম ভবনের গেটে। সেখান থেকে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা শুরু হয়েছে। খানিকটা এগিয়ে যে দোকান থেকে লাঠি কিনলাম, ঠিক তার পাশ দিয়ে নেমে গিয়েছে বানগঙ্গা যাওয়ার সিঁড়ি। ১৬ কিলোমিটার হেঁটে ওঠা, রাস্তার দু’ধারে অগুনতি দোকান, রেস্তরাঁ, মাসাজ পার্লার। কিন্তু অধিকাংশই বন্ধ। আবার কোনও দোকানের ভাঙা ছাদ দেখে খবর নিয়ে জানতে পারলাম, এ বছর পর্যটকের অভাবে ৮০ শতাংশ দোকান বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে।
অসাধারণ সুন্দর বাঁধানো পাহাড়ি রাস্তা, তাতে অসংখ্য বসার জায়গা ফাঁকা পড়ে রয়েছে। মনে পড়ল, গত বার যখন বৈষ্ণো দেবী এসেছিলাম, বসার জায়গা ভর্তি থাকায় রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। পানীয় জলের বন্দোবস্ত রয়েছে প্রতি ১০০ মিটার অন্তর, গরম জলও পাওয়া যায়। হাঁটতে-হাঁটতে ততক্ষণে সন্ধে, উপর থেকে তাকিয়ে দেখি নীচের কাটরা শহর আলোয় সেজে উঠেছে। সাদা-লালচে আলোয় যেন হাজার-হাজার মণিমাণিক্য ছড়িয়ে রয়েছে। দেড় ঘণ্টা হাঁটার পরে পৌঁছলাম আধ কুঁয়ারি। এখান থেকে ব্যাটারিচালিত গাড়ি মন্দিরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
হঠাৎ উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, মায়ের মন্দিরের মাথায় ঝলমল করছে গুরুপূর্ণিমার চাঁদ। চট করে ছবি তুলে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এখান থেকে পায়ে হাঁটা ও ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার রাস্তা সম্পূর্ণ আলাদা। যে ক’জন স্থানীয় মানুষ ছিলেন, তাঁরাও আলাদা হয়ে গেলেন। গা ছমছমে নির্জন রাস্তা ধরে আমি একাই চললাম মাতারানির দর্শন করতে। ঠিক পৌনে ন’টায় পৌঁছলাম মন্দিরের দরজায়। তার আগে প্রসাদ কাউন্টার থেকে কিনে নিয়েছিলাম এক ব্যাগ প্রসাদ, যাতে ছিল নারকেল, লাল চেলি, মুড়ি, নকুলদানার প্যাকেট। জুতো খুলে প্যাঁচানো করিডোর দিয়ে পৌঁছে গেলাম ভিতরের গুহায়।
লক্ষ্মী, সরস্বতী আর মহাকালীর পিণ্ডরূপ হল বৈষ্ণো দেবী। মন্দিরের ভিতরে যেখানে অন্যান্য সময়ে এক মুহূর্ত দাঁড়ানোর উপায় থাকে না, সেখানে এ বার আমি একা! দশ মিনিট মায়ের সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল, পর্যটকহীন রাস্তায় খাবারের অভাবে বাঁদরগুলির কষ্ট। তাই মায়ের কাছে আমার প্রার্থনা ছিল, ওই অসহায় জীবদের খাবার জুগিয়ে দেওয়ার জন্য।
দর্শনের পরে ঘোড়া নিয়ে সরু অন্ধকার পাথুরে রাস্তা ধরে চললাম ভৈরোনাথের উদ্দেশে। গত বার যখন এসেছিলাম, এখানে তখন ঘোড়াওয়ালা দর হাঁকিয়েছিল ৪০০০ টাকা। এ বার ১৪০০ টাকায় রাজি হয়ে গেল কাটরা শহর অবধি পৌঁছে দিতে। কথায় বলে, মাতারানির দর্শন সম্পূর্ণ হয় ভৈরোনাথকে দর্শন করার পরেই। কোনও মূর্তি নেই সেখানে, একটি গহ্বরে কয়েকটি ত্রিশূল পোঁতা। দর্শন করে এ বার নামার পালা।
রাত এগারোটা বাজে তখন, ঘোড়ায় চড়ে নামছি। হঠাৎ দেখি, একটি ছেলে চলেছে আমার সঙ্গে। সে বাংলায় বলল, ‘‘আমিও দর্শন করে ফিরছি, চলুন ভয় নেই।’’ রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ এলাম আধ কুঁয়ারি। ঘোড়া থেকে নেমে চা খেতে গিয়ে দেখি, ছেলেটি আর সঙ্গে নেই। শুনেছি, মাতারানি অনেক রূপ ধরে সাহায্য করতে আসেন ভক্তকে, এ-ও কি তেমনই?