Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

নিঃশব্দ গানের গ্রামে

দুপুরের খাওয়া শেষে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ক্যামেরার ব্যাগ সঙ্গী। হাতে গুণে সব সমেত ২৫-২৬টা ঘর। আর পাঁচটা পাহাড়ি গ্রামের মতোই শান্ত। গ্রামের মেয়ে-বৌয়েরা এখনও বেজায় ব্যস্ত নানা কাজে। পোষা মুরগিগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট ছানাদের নিয়ে, খুঁটে খাচ্ছে খাবার। দুষ্টু পায়ে ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছে ছানাগুলো। পায়ে চলা পথ বেয়ে জনাকয়েক তরুণী মাথায় ঘাসের বোঝা নিয়ে উঠছে। পরিশ্রমে ওদের গালগুলো বুনো স্ট্রবেরির থেকেও লাল।

অঞ্জন সরকার
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৪ ১৭:২৫
Share: Save:

দুপুরের খাওয়া শেষে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ক্যামেরার ব্যাগ সঙ্গী। হাতে গুণে সব সমেত ২৫-২৬টা ঘর। আর পাঁচটা পাহাড়ি গ্রামের মতোই শান্ত। গ্রামের মেয়ে-বৌয়েরা এখনও বেজায় ব্যস্ত নানা কাজে। পোষা মুরগিগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট ছানাদের নিয়ে, খুঁটে খাচ্ছে খাবার। দুষ্টু পায়ে ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছে ছানাগুলো। পায়ে চলা পথ বেয়ে জনাকয়েক তরুণী মাথায় ঘাসের বোঝা নিয়ে উঠছে। পরিশ্রমে ওদের গালগুলো বুনো স্ট্রবেরির থেকেও লাল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাসিটা উপহার দিয়ে যেতে ভোলে না। ওদের ছাড়িয়ে এগোই। গ্রামের স্কুলবাড়িটার সামনের মাঠে এসে দাঁড়াই। কয়েকটা মিষ্টি পাহাড়ি ছেলেমেয়ে ‘বাই বাই আঙ্কল’ বলে হাত নেড়ে গেল। তাদের মধ্যে সবথেকে বড় যে মেয়েটি, সে আবার প্রশ্ন করে বসে ‘আপ আকেলা হ্যায় আঙ্কল?’ আমিও হাসি দিয়ে ঘাড় নাড়াই সম্মতি জানিয়ে।

কালিম্পং থেকে রওনা দিয়ে ডেলো-কে বাঁ হাতে ফেলে রেখে আলগারার রাস্তা ধরে আমার গাড়ি। পেছনে থেকে যায় এক বৌদ্ধ মনেস্ট্রি, ভগবান পদ্মনাভের মূর্তি আর ‘হনুমান টপ’। ঘন সিঙ্কোনা অরণ্যের মাঝখান দিয়ে চলতে চলতে এক জায়গায় নরম হয় সে অরণ্য, শুরু হয় পাইনের জঙ্গল। জঙ্গলের অতি পরিচিত গন্ধ এক লহমায় মন ভাল করে দেয়। দাঁড়িয়ে আছি ইচ্ছেগাঁওতে। ইচ্ছের সৌন্দর্য তার নিস্তব্ধতায়, তার নীরবতাকে ভেঙে দেওয়া পাখির ডাকে...তার পাইনবনের নিঃশব্দ গানে...বাতাসের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা তার চঞ্চলতায়...তার মানুষজনের হৃদয় ছোঁয়া উষ্ণতায়!

বিকেল পাঁচটা বাজছে। নরম বিকেলের রোদ মেখে গ্রামের বাচ্চাগুলো দুষ্টুমিতে মেতেছে। ছোট্টবেলাকার সময়গুলো ধরে রাখি ক্যামেরায়। আরে আরে, মা-মুরগিটা তার ছোট্ট ছানাদের কেমন ঢেকেছে দ্যাখো দুটি ডানার ছায়ায়! বাচ্চাগুলো পরম নিশ্চিন্তে। আমার ঘরের বারান্দাটা কাঠের, ঘরটাও। একটা চেয়ার নিয়ে বসেছি। একটু আগেই গরম এক কাপ লেবু-চা দিয়ে গেছে। অল্প অল্প করে চুমুক দিচ্ছি আর তাকিয়ে আছি সামনের ঝাঁকড়া-মাথা গাছটাকে টপকে দূ-র আকাশের দিকে! সেখানে যে সূর্য ডুবছে! কোলে রয়েছে ক্যামেরাটা। দিন শেষের সূর্য কার ভালবাসায় এত মরমী হয়ে ওঠে, কে জানে! কী তার রূপ! নীলচে একটা কাজল-কালো মেঘ ঢাকল তাকে। সাধ্যি কি আটকায়! আবারও সে একটু একটু করে বাইরে আসছে। আকাশের বুকে যেন শ্যামকল্যাণের সুর বসেছে। সামনের গাছের একটা শুকনো ডালে বসা নীলচে রঙা মিনিভেট পাখিটা ডাকছে। ওইটুকু পাখির গলায় এত সুর কী করে যে আসে! এ দিকে ডুবতে থাকা সূর্যের সে কী আকুতি! সময় শেষের ব্যস্ততায় আকাশের গায়ে দ্রুত তুলি বোলাচ্ছে সমানে। শুধু আকাশই নয়, সেই তুলির ছোঁয়া পাচ্ছে আকাশের গায়ে গা-এলিয়ে থাকা পাহাড়গুলোও। একের পর এক রঙের সুর লাগছে আকাশের বুকে...নিঃশব্দ সে সুর। ইচ্ছের এই সূর্যাস্ত এমন একটা মুহূর্ত, যেখানে দু’চোখ ভরে নিঃশব্দ রাগের আরোহণ ও অবরোহণ দেখা যায়...প্রাণ ভরায়!

রাত নেমেছে ইচ্ছের ঘরে। ছোট ছোট আলোর ফুলকি দেখা যাচ্ছে দূর পাহাড়ের মাথায়। অন্য কোনও গ্রাম বা লোকালয়। কী চুপচাপ চারপাশটা! আর কী আশ্চর্য, এই চুপচাপ ভাবটাকে আরও রোমান্টিক করে তুলছে দূর অন্ধকারের ভেতর কোনও এক গাছের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা একটা ‘ব্রেন ফিভার’ পাখির ডাক! অনেকটা থেমে থেমে ডাকছে সে এখন। কাল সকালে জঙ্গলের পথ ধরে যাব সিলেরিগাঁও। সে তো আর এক সুন্দরী! পাইন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে...জঙ্গলের গন্ধ নিতে নিতে...দেখতে না-পাওয়া পাখির ডাক আর জঙ্গলের নিঃশব্দ গান শুনতে শুনতে...ইচ্ছেকে যেন আরও নিবিড় করে পেলাম, মনের ইচ্ছেডানায় ভর করে, ইচ্ছেগাঁওতে!

এক নজরে ইচ্ছেগাঁও

ভাল সময়: অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি। মার্চ-এপ্রিলেও আসা যায়, তবে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখার সুযোগ কম।

তাপমাত্রা: শীতে ৫-৬ ডিগ্রি আর গ্রীষ্মে ২৫-২৬ ডিগ্রির মধ্যে।

কাছের বিমানবন্দর: বাগডোগরা

কাছের রেলস্টেশন: এনজেপি

কাছের বাস টার্মিনাস: শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস

কী ভাবে যাবেন: এনজেপি থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে অথবা শিলিগুড়ি পানি ট্যাঙ্কি থেকে সিন্ডিকেটের শেয়ার জিপে কালিম্পং, সেখান থেকে গাড়িতে ইচ্ছেগাঁও।

থাকার জায়গা: ‘হোম স্টে’ পদ্ধতিতে থাকার ব্যবস্থা।

যোগাযোগ করতে পারেন:

১) উইকএন্ডডেস্টিনেশনস.ইনফো

২) ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ.ইচ্ছেগাঁওমেরিগোল্ডহোমস্টে.কম

৩) মুখিয়াহোমস্টে@জিমেল.কম

৪)খাবাসহোমস্টে (ডিললিকপিজি2@জিমেল.কম)

প্রকৃতির কোলে নিঃশব্দ গানের গ্রাম...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

icchegaon anjan sarkar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE