দেবোত্তর সম্পত্তি, কিন্তু দেবতার মান-মর্যাদা এখন ঠেকেছে প্রায় তলানিতে। বহুকাল আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে দরিদ্র-নারায়ণ সেবাও। অথচ, দলিলে লেখা রয়েছে এই সেবা হবে নিয়মিত। দিন বদলিয়েছে। কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যের দেবোত্তর সম্পত্তিগুলো হয়ে উঠেছে মূল সেবায়েতদের গলার কাঁটা, দখলদারদের স্বর্গরাজ্য।
বৃহত্তর কলকাতায় নাকি দেবতার নামে অর্থাৎ দেবোত্তর ট্রাস্টের বাড়ি আছে অন্তত আড়াই লক্ষ। গত কয়েক দশকে এর কিছু হাতবদলও হয়েছে। গিরিশ পার্কের অদূরে জোড়াসাঁকো অঞ্চলের পেল্লাই চারতলা বাড়ি। গোটাটাই দেবোত্তর সম্পত্তি। বাড়িটি তৈরি হয়েছিল প্রায় ১৩০ বছর আগে। প্রায় ১০০ বছর আগে, ১৯১৮-তে বাড়িটি দেবোত্তর করেন হরিদাসী দাসী। দলিলে লেখা অঙ্গীকার অনুয়ায়ী দু’বেলা ‘দারিদ্র্য নারায়ণ সেবা’ অর্থাৎ গরিবদের খাওয়ানো হয়েছে ভারতের স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত। তার পর অনিয়মিত হতে হতে ১৯৫১ থেকে তা পুরোপুরি বন্ধ। এক কালে ওই পরিবারে অষ্টধাতুর বালগোপাল অর্থাৎ মধুসূদন জিউয়ের পুজোকে কেন্দ্র করে উদ্দীপনা ছিল। এখন সেই বিগ্রহ পুজোর লোক সহজে মেলে না।
কেন এই হাল? মূল সেবায়েত ৭৪ বছরের শিবানী রক্ষিত জানান, ‘‘এত বড় বাড়ি। রক্ষণাবেক্ষণের টাকা নেই। মোট ১২ পরিবারের সকলের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চলছে। টাকা আসবে কোথা থেকে?’’ শিবানীদেবী এবং তাঁর পাঁচ পুত্র এই সম্পত্তির সেবায়েত। ওঁদের অভিযোগ, ভাড়া-বাবদ একটি টাকাও আসে না। এক কালে বিগ্রহের পূজারি ছিলেন, তিনি বাড়ির অনেকটা দখল করে নিয়েছেন। দখলকারীদের মধ্যে আছেন বাড়ির এক কালের পরিচারিকাও।
এক কালে সম্পন্ন ব্যক্তিদের অনেকে নিজেদের সম্পত্তি দেবতার উদ্দেশে লিখে দিতেন? কিন্তু কারা, কেন করতেন? এক দেবোত্তর ট্রাস্টের সেবায়েত বলেন, ‘‘কখনও দেবতার প্রতি ভক্তি বা আবেগের বশে, কখনও বিপথগামী সন্তানকে বঞ্ছিত করার অভিপ্রায়ে, কখনও নিঃসন্তান গৃহমালিক, কখনও দেনাগ্রস্ত মালিক তাঁদের সম্পত্তি দেবতার উদ্দেশে দান করতেন।’’ এক সময়ে জন্মাষ্টমী, রাধাঅষ্টমী, ফাগদোল ও জৌষ্ঠ্য মাসের ফুলদোলে উল্লাস-সমাবেশ হত এই সব দেবতাকে ঘিরে। এখন সে সবই ইতিহাস।
খোদ কলকাতায় নামী বাড়িগুলোর মধ্যে মার্বেল প্যালেসও দেবোত্তর। মল্লিক পরিবার অবশ্য এখনও গৃহদেবতাকে ভক্তি সহকারে পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন। হুগলির শ্রীরামপুরে সাবেক ভুরসুত রাজার পেল্লাই প্রাসাদ আর সম্পত্তিও দেবোত্তর। প্রায় ৭ বিঘা জমির উপর প্রাসাদ আর তা লাগোয়া প্রায় ৫০০ বিঘা জমির অনেকটাই বেহাত হয়ে গিয়েছে। আনুমানিক ৫০০ বছরের প্রাচীন রাজবংশী ঠাকুরাণির মন্দির এবং অষ্টাদশ শতকে তৈরি রাধাকান্ত জিউয়ের মন্দিরে নিয়মিত পুজো চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন সেবায়েত রায়-পরিবারের শরিকরা।
দেবোত্তর সম্পত্তির দায়িত্বপ্রাপ্তদের তামিলনাডু-অন্ধ্রপ্রদেশে বলে ‘ধর্মকর্তা’। সাবেক তাঞ্জোর, মালাবারে তাঁরা পরিচিত ছিলেন ‘পঞ্চায়েতদার’ বলে। পশ্চিমবঙ্গে ওঁদের বলা হয় সেবায়েত। রাজ্যের গৃহমালিক সমিতির সম্পাদক সুকুমার রক্ষিত বলেন, ‘‘কেবল বাড়ি বা জমি নয়, অনেক পরিবার তাদের মূল্যবান অলঙ্কারগুলোও দেবোত্তর করে গিয়েছেন। সব মিলিয়ে এ রাজ্যে দেবোত্তর সম্পত্তির মূল্য বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা।’’ তাঁর মতে, কোন কোন দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তর হয়েছে, তার তালিকা মিলবে না। এই সব হস্তান্তর আইন মোতাবেক হয়েছে কি না, তা নিয়েও রয়েছে ধন্দ। এ সব দেখার কেউ নেই।
এক সময়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে চিল্কিগড়ের রাজবাড়ির অধীনে ছিল এক হাজার একরের বেশি জমি। রাজবাড়ি এবং লাগোয়া অনেকটা জমি দেবোত্তর করে দেওয়া হয়েছিল। সেবায়েত বীর্যেশ ধবলদেব বলেন, ‘‘দক্ষিণ জামবনির দিকে প্রায় সাড়ে ৪০০ একর জমিতে চাষ হত। সে সব জমি এখন প্রায় বেহাত। রেকর্ডস অব রাইটসে আমাদের সাড়ে তিনশ একর জমি থাকার কথা। কিন্তু সে সব কাগজেকলমেই।’’ কোন দেবতা কী ভাবে পূজিত হচ্ছেন? বীর্যেশবাবু বলেন, ‘‘কণকদূর্গা মন্দির তো রীতিমত পরিচিত! আর, মূল রাজবাড়ির কালাচাঁদ, জগন্নাথ, রাধাকৃষ্ণ এবং কিছু শিলা— এ সব পুজোর আয়োজন করতে হয় নিয়মিত। খুবই সমস্যায় পড়তে হয়।’’
জেলায় জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে সমস্যায় জীর্ণ এ রকম অজস্র দেবোত্তর সম্পত্তি। সেবায়েতদের অনেকে ইহলোক ছেড়ে চলে গিয়েছেন। অনেকে বয়সের ভারে জীর্ণ। কী হবে এগুলোর— তা নিয়ে ভাবিত ওঁদের উত্তরাধীকাররা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy