Advertisement
E-Paper

জীবনে আর বড় সঙ্কট রইল না, এখন আলোর দিকে তাকিয়ে

এখন আমি বিধানসভা নির্বাচনে ব্যারাকপুরের প্রার্থী হয়ে এখন প্রচারে। বাবা জানতেও পারল না, তার ছেলে এখন সরাসরি রাজনীতির ময়দানে লড়াইয়ে।

রাজ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২১ ০৬:৫৮
রাজ চক্রবর্তী।

রাজ চক্রবর্তী।

১৭ মার্চ, ২০২০। প্রথম কোভিড ঢুকল বাংলায়। শুরু হল ভয়, আতঙ্ক, পরপর মৃত্যু। সব বর্ষপূর্তি সুখের হয় না। তবু গত এক বছরের ছন্দপতন ফিরে দেখল আনন্দবাজার ডিজিটাল।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই চোখ গেল দূরের ওই হাসপাতালের দিকে। আমার ঘর থেকে খুব স্পষ্ট দেখা যায় হাসপাতালটা। দেশলাই বাক্সের মতো ছোট্ট ছোট্ট ঘর। রাতে ঘরগুলোয় আলো জ্বলে। ওখানেই বাবা শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিল। আর আমি, বাবার ছেলে, আমার অসুস্থ বাবাকে ওই কাচের জানলা দিয়েই দেখতাম।

এমনি তো আর দেখতে যেতে পারলাম না! শেষবার দেখাও হল না আমাদের। আমার ঘরের এই জানলাই ছিল তখন একমাত্র সম্বল। করোনায় আক্রান্ত ঘরবন্দি আমি ওখান থেকেই ভেবে নিয়েছিলাম, হাসপাতালের কোনও এক ঘরে আমার বাবা আছে। ২০২১-এর ১৭ মার্চ বাবার কথাই মনে হচ্ছে শুধু। ২০২০-র ১৭ মার্চ থেকেই করোনা ঢুকেছিল আমার বাংলায়। অনেকের মতোই যা আমার পরিবারেও ভাঙচুর করে দিয়ে গেল।

বাবা অসুস্থ হয়েছিলেন। হাসপাতালে দিয়েছিলাম। সেখান থেকে করোনা হয়ে গেল। তার পরে আমারও করোনা হল। আমি ঘরে বন্দি। বাড়িতে শুভ সন্তানসম্ভবা। মা-ও অসুস্থ। এক ছাদের তলার মানুষগুলো সব আলাদা হয়ে গেল। কেউ কারও স্পর্শে নেই আমরা। ২০২০ যে কী নিষ্ঠুর খেলা খেলেছিল আমার সঙ্গে! শুভ-র সঙ্গে! চারদিকে কোভিডের সংক্রমণ। শুভ যদি ওই অবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? রোজ সেই ভাবনা তাড়া করত আমায়। মা-ও অসুস্থ। বেশি কিছু হলে কাকে বলব? আমার সঙ্গে আমার বাড়িতেও কোভিড হানা দিয়েছে। কেউ আসতেও পারবে না। প্রকৃতি আর সময় মানুষকে যে এত অসহায় করে দিতে পারে, সেই দিনগুলোয় বুঝেছিলাম।

মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে সুদিনের দিকে তাকিয়ে রাজ।

মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে সুদিনের দিকে তাকিয়ে রাজ।

এর মধ্যেই বাবা চলে গেল। বাবা অপেক্ষা করেছিল আমার সন্তানকে দেখার। মৃত্যুর অপেক্ষা তো করেনি। কিন্তু মৃত্যু সব প্রস্তুতি নিয়ে হাজির হল বাবার কাছে। হাসপাতালে থাকতে থাকতে কী ভাবত বাবা? জানা হয়নি আমার। গণেশ চতুর্থীর দিন শুনেছিলাম বাবা ভাল আছে। ভাবলাম, যাক...। সব পাল্টে দিল ২৮ অগস্টের সকাল। শুনলাম, বাবা নেই। ছুটে যেতেও পারলাম না কেউ। কোভিডে আক্রান্ত ছেলে বাবাকে শেষবার দেখবে না? এ কেমন মারণরোগ?

কাচের জানলাও সে দিন ঝাপসা হয়ে গেল।

বাবা চলে যাওয়ার পরে মা-কে সামলানো আরেক অধ্যায়। মা অসুস্থ হলেও আমি বা শুভ কেউ মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আর সাহস পেতাম না। বাবার তো ওই করেই করোনা হল। অথচ চিকিৎসক যে বাড়ি চলে আসতে দেবেন, সে সময় তা-ও হয় না! শুভ ওই সময়টায় যেমন নিজেকে সামলেছিল, তেমনই মায়ের পাশেও ছিল। কী ভয়ঙ্কর একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের পরিবারটা চলছিল। রোজগার নেই। ২০২০-র মার্চে আমার ‘ধর্মযুদ্ধ’ মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। ভেবেছিলাম এপ্রিলে হবে। সেটাও হল না। সে ছবি এখনও দর্শকদের দেখাতে পারিনি। অন্য আরেকটা ছবি ‘হাবজি গাবজি’-র কাজ শেষ। ছবি মুক্তির পথে। সে-ও হয়ে উঠল না।

 ইউভান, ফুরিয়ে যাওয়ার মধ্যেই গড়ে তোলার ইঙ্গিত।

ইউভান, ফুরিয়ে যাওয়ার মধ্যেই গড়ে তোলার ইঙ্গিত।

কোনও কাজ নেই। লকডাউনের প্রথম দিকে মানুষের জন্য আর্থিক সাহায্য করছিলাম। ভেবেছিলাম কয়েক মাসের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা সময় এমন এল, যে নিজেদের ভাঁড়ারেই টান পড়ল।

২৮ অগস্ট থেকে ১২ সেপ্টেম্বর। শুনতে কয়েকটা দিন। কিন্তু আমাদের জীবন অন্ধকার থেকে আলোর মধ্যে ঘুরে দাঁড়াল। ইউভান এল। ফুরিয়ে যাওয়ার মধ্যেই গড়ে তোলার ইঙ্গিত। মা-ও ওকে দেখে যেন বেঁচে থাকার মানে পেল। আমার-শুভর যা কিছু সব এখন ওকে নিয়ে। দিন গড়াল। দেখতে দেখতে ছেলের ছ’মাস বয়স হল। অন্নপ্রাশনও হয়ে গেল।

আর এখন আমি বিধানসভা নির্বাচনে ব্যারাকপুরের প্রার্থী হয়ে এখন প্রচারে। বাবা জানতেও পারল না, তার ছেলে এখন সরাসরি রাজনীতির ময়দানে লড়াইয়ে। সময় কখন কী ভাবে মানুষকে কোথায় নিয়ে ফেলবে, তার খবর আমরা কেউ জানি না। ৫ মার্চ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ব্যারাকপুরের প্রার্থী হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করলেন, তখন বার বার বাবার কথা মনে হচ্ছিল। বাবা নেই। কিন্তু মা আছে। শুভ আছে। আর ছোট্ট ইউভান আমার জীবন আলো করে আছে। এ ভাবেই মেনে নিয়েছি আমরা। গত একটা বছর আমায় আর শুভকে খুব বড় শিক্ষা দিয়ে গেল। আমাদের জীবনে আর ‘বড় ক্রাইসিস’ বলে কিছু থাকল না। সব লড়াই হয়ে গিয়েছে। নতুন করে ওই রকম খারাপ বোধহয় আর হবে না।

এখন আমরা শুধু আলোর দিকে তাকিয়ে।

Raj Chakraborty COVID-19 coronavirus One year of Corona Corona in Bengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy