প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকার পর অবশেষে ফের চালু হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রকল্পের আওতায় এই কর্মসূচি আবার শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজ্য সরকার। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, অবিলম্বে এই কর্মসূচি শুরু করতে হবে— আর সেই নির্দেশ পাওয়ার পরই তৎপরতার সঙ্গে মাঠে নেমেছে নবান্ন। রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, আদালতের নির্দেশ কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। যে কোনও দিন থেকেই আনুষ্ঠানিক ভাবে কাজ শুরু হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, জব কার্ড হোল্ডারদের তথ্য যাচাই ও ই-কেওয়াইসি আপডেটের কাজ দ্রুত শেষ করতে। কারণ, কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেই কাজ অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে সম্পন্ন করা যায়নি বলেই নবান্ন সূত্রে খবর।
রাজ্যে বর্তমানে ২ কোটি ৫৬ লক্ষের বেশি জব কার্ড হোল্ডার রয়েছেন। তাঁদের প্রায় সিংহভাগের আধার লিঙ্ক করানো থাকলেও ই-কেওয়াইসি আপলোডের সময় প্রযুক্তিগত সমস্যায় পড়ছেন অনেক আধিকারিক। বিভিন্ন জেলা থেকে খবর আসছে, সার্ভার প্রায়ই ডাউন হয়ে যাচ্ছে, ফলে কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। তবে প্রশাসনের এক আধিকারিকের আশ্বাস, ‘‘এটি সাময়িক সমস্যা। একসঙ্গে বহু কেওয়াইসি আপলোড হলে সিস্টেমের উপর চাপ পড়ে। ধীরে ধীরে সব তথ্য আপডেট হয়ে যাবে, যাতে আদালতের নির্দেশ মেনে দ্রুত প্রকল্প শুরু করা যায়।”
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গে এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে ২০২১ সাল থেকেই কেন্দ্রীয় অর্থপ্রবাহ বন্ধ ছিল। এর ফলে রাজ্যের লক্ষাধিক শ্রমিক বঞ্চিত হন কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আদালতের দ্বারস্থ হয়। গত ১৮ জুন কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেয়, “কোনও কর্মসূচি অনির্দিষ্টকাল বন্ধ রাখা যায় না।” আদালত কেন্দ্র ও রাজ্যকে নির্দেশ দেয়, শর্তসাপেক্ষে দ্রুত প্রকল্প পুনরায় চালু করতে হবে।
আরও পড়ুন:
পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। কিন্তু ২৭ অক্টোবর দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে এবং কেন্দ্রের আবেদন খারিজ করে দেয়। আদালতের মন্তব্য, “আমরা মনে করি না, যে হাইকোর্টের আদেশে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন রয়েছে।” এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজ পুনরায় চালুর পথে আর কোনও আইনি বাধা নেই। রাজ্যের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আদালতের নির্দেশ মানতে আর বিলম্ব করতে চায় না সরকার। ইতিমধ্যেই প্রতিটি জেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠানো হয়েছে এবং তদারকির জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে।
তবে এই রায়ে রাজনৈতিক অভিঘাতও প্রবল। একশো দিনের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে কয়েক হাজার তৃণমূল কর্মী-সমর্থককে নিয়ে গিরিরাজ সিংহের অফিস অভিযান করেন। সেই আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতায় আদালতের এই নির্দেশকে রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরছে শাসকদল।
তৃণমূলের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার বিরুদ্ধে রাজ্যবাসীর পাশে দাঁড়িয়ে আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের ন্যায়সংগ্রামের জয়। রাজনৈতিক মহলের মতে, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে ১০০ দিনের কাজ পুনরায় চালু হওয়া তৃণমূলের প্রচারে বড় অস্ত্র হয়ে উঠবে। একদিকে যেখানে বিজেপিশাসিত কেন্দ্রকে ‘বঞ্চনার রাজনীতি’র অভিযোগে কোণঠাসা করতে চাইছে তৃণমূল, অন্য দিকে রাজ্যের গ্রামীণ শ্রমিকদের মধ্যে সরকারপ্রীতি বাড়ানোর চেষ্টাও করছে। ফলে আদালতের নির্দেশ শুধু প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও রাজ্যে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে।
সব মিলিয়ে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ফের কর্মমুখর হতে চলেছে রাজ্যের গ্রামীণ এলাকা। নবান্নের লক্ষ্য একটাই— যত দ্রুত সম্ভব আদালতের নির্দেশ মেনে ১০০ দিনের কাজ ফের শুরু করা এবং শ্রমিকদের হাতে পৌঁছে দেওয়া তাদের বহু প্রতীক্ষিত ন্যায্য মজুরি।