Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মার্চের মধ্যেই রাজ্যের সব ঘরে আলো?

রাজ্যের চারটি জেলায় বিপিএল এবং এপিএল তালিকাভুক্ত প্রতিটি পরিবারের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নজর কেড়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। ওই জেলাগুলি হল দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, ও দুই মেদিনীপুর। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে বাকি জেলাগুলিতেও ১০০ শতাংশ গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজ শেষ করে ফেলা হবে বলে বণ্টন কর্তৃপক্ষ লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে।

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ১৫:১৭
Share: Save:

রাজ্যের চারটি জেলায় বিপিএল এবং এপিএল তালিকাভুক্ত প্রতিটি পরিবারের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নজর কেড়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। ওই জেলাগুলি হল দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, ও দুই মেদিনীপুর। চারটি জেলাতেও ১০০ শতাংশ গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজ হয়েছে বলে সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। নবান্ন সূত্রে খবর, গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজে বণ্টন সংস্থার কাজে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সন্তুষ্ট। তবে তিনি চান, এই কাজ আরও দ্রুত শেষ করে ফেলতে। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে বাকি জেলাগুলিতেও ১০০ শতাংশ গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজ শেষ করে ফেলা হবে বলে বণ্টন কর্তৃপক্ষ লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে।

বাম আমলে রাজ্যে গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজ শুরু হলেও, ওই কাজে বিশেষ অগ্রগতি হয়নি বলেই বিভিন্ন মহলে অভিযোগ ছিল। বহু গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি পোতা হলেও, বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, গ্রামের প্রতিটি মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে। ‘সবার জন্য আলো’- এই স্লোগান তুলে গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজে তিনি যেমন রাজ্যে কোষাগার থেকে অর্থের সংস্থান করে দিয়েছেন, একই ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারও গ্রামীণ বিদ্যুদয়ন প্রকল্পে ধাপে ধাপে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেছে। বণ্টন সংস্থার হয়ে বিভিন্ন জেলায় গ্রামীণ বিদ্যুদয়ন প্রকল্পের কাজ করেছে এনটিপিসি, এনএইচপিসি-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি-র পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা। বণ্টন সংস্থার দাবি, দেশের মধ্যে যে কয়েকটি রাজ্য গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজে এগিয়ে রয়েছে তাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম।

চলতি অর্থবর্ষের অগস্ট মাস পর্যন্ত বণ্টন কর্তৃপক্ষ প্রতিটি জেলা ধরে যে রিপোর্ট তৈরি করেছে, তাতে বলা হয়েছে হাওড়া জেলাতেও ৯৯ শতাংশ গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজ হয়ে গিয়েছে। এপিএল পরিবারের সবার ঘরেই আলো পৌঁছে গিয়েছে। বিপিএল তালিকাভুক্ত কিছু পরিবারে এখনও আলো দেওয়া যায়নি। দু’মাসের মধ্যে সেই কাজ শেষ করে ফেলা হবে।

হাওড়ার পরেই এগিয়ে রয়েছে জলপাইগুড়ি, হুগলি, বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া। এই জেলাগুলিতে ৯২-৯৮ শতাশ পর্যন্ত গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজ হয়ে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত সব থেকে বেশি পিছিয়ে রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা। তার পরেই রয়েছে দার্জিলিং, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম। পরিকাঠামোগত কিছু কাজের সমস্যার কারণেই দ্রুত এই কাজ করা যাচ্ছিল না। এই জেলাগুলিতেও জোর কদমে বিপিএল এবং এপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারগুলিতে বিদ্যুৎ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলে বণ্টন সংস্থার এক কর্তা জানাচ্ছেন।

কিন্তু গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজে বণ্টন সংস্থার দাবি অনেক ক্ষেত্রেই মিলছে না বলেই জানা যাচ্ছে। যে চারটি জেলায় ১০০ শতাংশ গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজ হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই জেলাগুলিতেই বহু বাড়িতে এখনও আলো জ্বলে না। অনেকে আবেদন করেও বিদ্যুৎ সংযোগ পায়নি। ক্ষোভ রয়েছে অনেক মানুষের মধ্যে।

যেমন পূর্ব মেদিনীপুর প্রশাসন সূত্রে খবর, জেলার ৩০৩৫টি মৌজার মধ্যে ২৯৬৪টি মৌজায় বসতি রয়েছে। এর মধ্যে ৩৬টি মৌজায় আগেই বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। বাকি ২৯২৮টি মৌজার প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছিল বছর তিনেক আগে। গত জুনে তা শেষ হয়েছে। তবে পটাশপুর-১ ব্লকের নৈপুর ও গোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কিছু এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ পৌছয়নি। গোপালপুরের খাড়ান মৌজার বাসিন্দা শুকদেব দোলই, লক্ষণ বেরার কথায়, ‘‘ছ’মাস ধরে বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে রয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।’’ এগরা-১ ব্লকের মহাবিশ্রা গ্রামের ঘোড়ইপাড়ার বেশ কয়েকটি পরিবার, পটাশপুর-২ ব্লকের আড়গোয়াল পঞ্চায়েতের সাতশতমালের কয়েকটি এলাকা, ভগবানপুর-১ ব্লকের গুড়গ্রাম, বুড়াবুড়ি, কাদুয়া এলাকার বেশ কিছু পরিবারও বিদ্যুৎহীন।

কিছু এলাকায় যে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি সে কথা স্বীকার করেছেন জেলা পরিষদের বিদ্যুৎ কর্মাধ্যক্ষ প্রদীপ কয়াল। তবে তাঁর দাবি, ‘‘মামলা, স্থানীয়দের বাধা-এমন নানা কারণে হয়তো কোথাও কোথাও খুঁটি পোঁতা হয়নি। আস্তে আস্তে কাজ হয়ে যাবে।’’ পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের প্রকল্প আধিকারিক কল্যাণকুমার মাইতিও মানছেন, ‘‘এগরার আলমগিরিতে কয়েকটি খুঁটি পোঁতা হয়নি বলে শুনেছি।’’ এই পরিস্থিতিতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহির কটাক্ষ, ‘‘জেলার বহু এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। তাও সরকার বলছে কাজ সম্পূর্ণ। এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে!’’

পশ্চিম মেদিনীপুরেও প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুত্‌ পৌঁছেছে এমন নয়। জেলা জুড়ে হাজার দেড়েক বাড়ি এখনও বিদ্যুত্‌হীন। যেমন, কর্ণগড় পঞ্চায়েতের কিসমত ধবাশোল, শালবনি পঞ্চায়েতের দুর্গাদাসপুর গ্রামের অনেক পরিবারেই সংযোগ পৌঁছয়নি। জেলা পরিষদের বিদ্যুত্‌ কর্মাধ্যক্ষ অমূল্য মাইতির ব্যাখ্যা, “হাজার দেড়েক বাড়িতে বিদ্যুত্‌ সংযোগ পৌঁছয়নি সেগুলি সমীক্ষার সময় ছিল না। পরে পরিবার ভেঙে অন্যত্র গিয়ে বাড়ি করায় এই বিদ্যুত্‌হীন বাড়িগুলি দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সাধারণ ভাবে আবেদন করলেই সংযোগ দিয়ে দেব।”

মালদহের চিত্রটাও খুব একটা আলাদা নয়। ওই জেলার হবিবপুর ব্লকের বাহাদুরপুর গ্রামপঞ্চায়েতের বাকইল বাহাদুরপুর, আকতৈলের নরসিং বাটি, ১২ মাইল, কানতুর্কার গোপালপুর, হবিবপুরের অলতর, তাজপুর, পাঁচ পুকুর, মঙ্গলপুরার সুন্দরবন, বেলতলি, বুলবুলচণ্ডীর খাটিয়াখানা, ফুটকামারি, আইহোর দমদমা, মানিকচকের দক্ষিন চন্ডীপুরের আলাদিটোলা, বামনগোলার খুটাদহের একাংশ, বৈষ্ণবনগরের পারদেওয়ানপুরের একাংশ এলাকা এখনও বিদ্যুৎহীন। হবিবপুরের সিপিএমের বিধায়ক খগেন মুর্মু বলেন, ‘‘অনেক গ্রামে বিদ্যুৎ পৌছয়নি। সেই সঙ্গে বহু বিপিএল পরিবার বকেয়া বিল দিতে না পারায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।’’ বৈষ্ণবনগের কংগ্রেসের বিধায়ক ইশা খান চৌধুরীরও বক্তব্য, ‘‘আমার বিধানসভা কেন্দ্রেও কিছু গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি।’’ খোদ বালুরঘাটের বিধায়ক তথা রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী বিধানসভা কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও আঁধারে। স্থানীয় নাজিরপুর অঞ্চলের খাঁপুর ও কইগ্রামের একাধিক বাড়িতে আলো জ্বলেনি। এলাকার বাসিন্দা লক্ষ্মী মাহাতো, বুধি ওঁরাওরা বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ৬ মাস আগে কোটেশন জমা দিয়েছি। কিন্তু সংযোগ মেলেনি।’’ একই অবস্থা পাশের চিঙ্গিশপুরের দুর্গাপুরে। দুর্গাপুর এলাকার শিরীশ পাহান, মিঠু পাহান, নগেন পাহানদের অভিযোগ, ‘‘পাশের পাড়ায় বিদ্যুৎ পৌঁছলেও আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। আবেদন করেও কোনও ফল হচ্ছে না।’’ তৃণমূলের বালুরঘাট ব্লক সভাপতি বিভাস চট্টোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘কোনও এলাকাতেই পুরোপুরি বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। বাসিন্দাদের একাংশ এখনও অন্ধকারে রাত কাটান।’’

বণ্টন সংস্থার এক কর্তা বলেন, ‘‘আমাদের কাছে জেলা ভিত্তিক বিপিএল এবং এপিএল পরিবারের যে তালিকা রয়েছে, তাদের প্রতিটি ঘরেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। কোনও পরিবার যদি বিদ্যুৎ না পেয়ে থাকে তার পিছনে কোনও না কোনও সমস্যা রয়েছে।’’

কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক গ্রামীণ বিদ্যুদয়ন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে রাজ্যের ৩৭ হাজার ৪৬৩টি গ্রামের মধ্যে এ বছর মার্চ মাস পর্যন্ত ২২টি গ্রাম বিদ্যুৎহীন ছিল। কিন্তু ওই গ্রামগুলির মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে ৯টি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে। রাজ্যে এখন ১৩টির মতো গ্রাম রয়েছে যেগুলিতে এখনও পর্যন্ত বিদ্যুৎ যায়নি। চলতি অর্থবর্ষের মধ্যে ওই গ্রামগুলিতেও বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে বলে বণ্টন কর্তৃপক্ষ দাবি করছে। আর ওই কাজ হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে বলে সংস্থাটির আশা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

100 wb rural electrification state
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE