Advertisement
E-Paper

বাঁধ-ভাঙা গ্রামে বাচ্চাদের পড়াশোনার চর্চা জিইয়ে রেখেছে অসীমাদের পাঠশালা

এত দিন ঘরকন্যার ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন, নিজের ছেলেমেয়েদেরই পড়াতেন কুলতলির ভুবনেশ্বরীর হালদারঘেরির অসীমা-জয়ন্তী।

সমীরণ দাস

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২০ ০৫:২১
নিয়ম-করে: পড়াশোনা করতে আসছে বাচ্চারা। ছবি: সুমন সাহা

নিয়ম-করে: পড়াশোনা করতে আসছে বাচ্চারা। ছবি: সুমন সাহা

মাটির দাওয়ার একপাশে হেঁশেল। সেখানে উনুন জ্বেলে চলছে রান্না। দাওয়ার অন্য পাশে কাঠের তক্তোপোশের উপরে বসে এক ঝাঁক খুদে। দুই মহিলা পালা করে একদিকে হেঁশেল সামলাচ্ছেন, আবার খুদে পড়ুয়াদের কাছে এসে কখনও ছড়া, কখনও নামতা শিখিয়ে যাচ্ছেন।

এত দিন ঘরকন্যার ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন, নিজের ছেলেমেয়েদেরই পড়াতেন কুলতলির ভুবনেশ্বরীর হালদারঘেরির অসীমা-জয়ন্তী। তবে আমপান আমূল বদলে দিয়েছে দুই মহিলার রুটিন। হালদারঘেরির ভান্ডারী পরিবারের মাটির দাওয়ায় এখন সকাল-বিকেল বসছে পাঠশালা। গাঁয়ের জনা বারো বাচ্চা বই-খাতা, স্লেট পেন্সিল হাতে হাজির হচ্ছে রোজ। সব কাজ সামলে দুই জা মিলে হাতে ধরে তাদের পড়া দেখাচ্ছেন।

বড় জা অসীমা পড়েছেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। ছোট জয়ন্তী অষ্টম শ্রেণি পাস। তবে নিজের ছেলেমেয়েদের পড়া দেখাতে পুঁথিগত বিদ্যা বাধা হয়নি কোনও দিন। অসীমার মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে অনেক দিন হল। ছেলে উচ্চমাধ্যমিক পেরোলো এ বার। দু’জনেরই হাতেখড়ি হয়েছিল মায়ের কাছে। পরম যত্নে ছেলেমেয়েকে বর্ণপিরচয়ের পাঠ দিয়েছিলেন অসীমা। জয়ন্তীর ছেলে-মেয়ে দু’জনেই এখন প্রাথমিকে। স্কুলের বাইরে, মা-জেঠিমার কাছেই সকাল সন্ধে পড়াশোনা চলে তাদের।

আমপানে হালদারঘেরির নদী লাগোয়া অসীমাদের বাড়িতে বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছিল। জল উঠে গিয়েছিল ঘর-বারান্দায়ও। উঠোন লাগোয়া চাষের জমিতে এখনও নোনা জল জমে রয়েছে। তবে তার জেরে বাড়ির বাচ্চাদের পড়াশোনার নিয়মে ভাটা পড়েনি। জয়ন্তীর দুই ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দু’বেলাই মা-জেঠিমার কাছে পড়তে বসেছে।

ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে দুই মায়ের লড়াই চোখ এড়ায়নি প্রতিবেশীদের। এমনিতেই লকডাউনের জেরে স্কুল বন্ধ দীর্ঘ দিন। ঝড়ের পরে বিধ্বস্ত হালদারঘেড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশীরা তাঁদের ছেলেমেয়ের অসীমার বাড়িতে পড়তে পাঠাতে শুরু করেন। নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই তাদেরও পড়ানোর দায়িত্ব নেন অসীমা-জয়ন্তী। এ ভাবে বাড়তে বাড়তে অসীমাদের মাটির দাওয়ায় এখন রোজ হাজির হচ্ছে ১২-১৩ জন খুদে। অসীমাদের কাছে ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকছেন বাবা-মায়েরাও।

শ্লেট পেন্সিলে এক খুদেকে লেখা শেখানোর ফাঁকে অসীমা বলেন, “নিজের ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছে। জায়ের ছেলেমেয়েকে পড়াই। এখন তো আরও বাচ্চারা আসছে। স্কুল নেই। ছেলে মেয়েগুলোর পড়াশোনা একেবারে বন্ধ। সকাল বিকেল তাই যতটা পারছি দেখিয়ে দিচ্ছি।” জয়ন্তীর কথায়, “রোজ সকাল-বিকেল বাচ্চারা আসছে। লেখা-পড়া করছে। আমরা সাহায্য করছি। চেষ্টা করছি পড়াশোনার চর্চাটা ধরে রাখতে। না হলে এত দিন স্কুল বন্ধে পড়াশোনার অভ্যেসটাই চলে যাবে।” অসীমা-জয়ন্তীর প্রতিবেশী গৌরী শাসমলের কথায়, “স্কুল কবে খুলবে তার তো ঠিক নেই। এঁরা পড়াচ্ছেন দেখে ছোট মেয়েটাকে রোজ পাঠিয়ে দিই। বাড়িতে পড়ানোর কেউ নেই। স্কুলেই যেটুকু যা পড়ত। এখন এখানে নিয়মিত পড়াশোনাটা করছে।”

বাঁধ ভেঙে চাষের জমি এখনও জলের তলায়। কবে আবার চাষ শুরু হবে তার ঠিক নেই। সংসারে তীব্র অভাব। তবে তারপরেও পড়ানোর জন্য কোনও পারিশ্রমিক নেন না অসীমা-জয়ন্তীরা। ঘরের কাজ সামলে এত বাচ্চার পড়াশোনার দায়িত্ব সামলাতে অসুবিধা হয় না? দুই জা এক যোগে বলেন, “কোনও অসুবিধা নেই। পড়াতে আমাদের খুব ভাল লাগে। স্কুল খুলে যাওয়ার পরেও ভাবছি এই পাঠশালাটা চালু রাখব। কিছু বাচ্চা যদি আসে, এদের চর্চাটাও থাকবে। আর আমাদের ভাললাগাটাও।”

Cyclone Amphan Kultali
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy