উপচে পড়া অটো। বনগাঁয় হামেশাই দেখা মেলে এই দৃশ্যের। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
যাবতীয় কড়া শাসন, আইনের চোখ রাঙানি, ধরপাকড়— সবটাই হাতে গোনা কয়েক দিনের জন্য। অনুষঙ্গ, কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও দুর্ঘটনা। যার স্মৃতি দুর্বল হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বেপরোয়া অটোর দাপটে ফের প্রাণ ওষ্ঠাগত যাত্রীদের। দক্ষিণের মতোই, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বিভিন্ন প্রান্তেও সাধারণ মানুষের অটো-অভিজ্ঞতা খানিকটা এমনই।
বাগদায় অটো চড়ে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন প্রণব বিশ্বাস। নিজের অভিজ্ঞতা শোনালেন তিনি। যে অটোতে চড়েছিলেন, তা দিয়ে গল গল করে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। অটোতে ওঠার আগে সেটা চোখে পড়ায় চালককে মুখ ফসকে বলে বসেছিলেন, ‘‘দাদা, গাড়িটার তো একটু যত্ন নিলে পারেন।’’ উত্তর মেলে, ‘‘যে টাকা রোজগার হয়, তা দিয়ে ও সব সম্ভব নয়।’’ কিন্তু দূষণ ছড়াচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব তো পরিবহণ দফতরের, যেন নিজেকেই নিজে কথাগুলো বললেন প্রণববাবু। উত্তরের অপেক্ষায় থেকে লাভ নেই বুঝে আর উচ্চবাচ্য করলেন না।
গোটা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা জুড়েই রমরমিয়ে চলছে বেআইনি অটোর দাপট। পাশাপাশি অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে আইনি অটোগুলিও বিপজ্জনক ভাবে যাতায়াত করছে। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। যদিও তা নিয়ে প্রশাসনের কোনও হুঁশ নেই বলে অভিযোগ। বনগাঁ, বসিরহাট ও বারাসত মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় বেআইনি অটো ও অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে অটো চললেও কেন পুলিশ-প্রশাসন পদক্ষেপ করে না, সেই প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষ।
শুধু বেআইনি অটো চলাচলই নয়, বেআইনি ভাবে অতিরিক্ত যাত্রী তোলাটা বেশির ভাগ অটো চালকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন রুটে অটো, ম্যাজিক গাড়ির সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছে যে চালকদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। বাড়তি পয়সার লোভে দ্রুত গাড়ি চালাতে গিয়ে অটো চালকেরা রেষারেষিতে জড়িয়ে পড়ছেন। ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণও হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
কিছু দিন আগে বাগদা থানার নলডুগারি বাজার এলাকায় দু’টি অটোর রেষারেষিতে প্রাণ গিয়েছে দশ বছরের কিশোরী নিরঞ্জনা বিশ্বাসের। তারপরও অতিরিক্ত যাত্রী তোলা ওই এলাকায় বন্ধ হয়নি বলে জানালেন বাসিন্দারা। বুধবার দত্তপুকুরেও অটো দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে একজনের।
বনগাঁ, বাগদা, গাইঘাটা, হাবরা, মছলন্দপুর, স্বরূপনগর, বাদুড়িয়া, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি— সর্বত্রই চোখে পড়ে, অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে অটো চলছে বিপজ্জনক ভাবে। দেখা যায়, বেআইনি ডিজেল চালিত অটোও। বাসিন্দারা জানালেন, ডিজেলচালিত অটো বেআইনি হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা যুবকেরা ওই সব অটো চালায়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কেউ পদক্ষেপ করে না।
জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ সংস্থার আধিকারিক সিদ্ধার্থ রায় জানিয়েছেন, অটোর পিছনের সিটে তিনজন ও চালকের বাঁ দিকে একজন— মোট চারজন যাত্রী নিয়ে অটো চলাচলের নিয়ম। চালকের ডান দিকে কোনও যাত্রী তোলা যাবে না।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, চালকের বাঁ দিকে দু’জন ও ডান দিকে একজন— মোট সাত-আটজন যাত্রী নিয়েই অটো চলছে। যাত্রীদের বসার জায়গা দিতে গিয়ে চালকের প্রায় সিট থেকে পিছলে পড়ার জোগাড় হয়। ওই অবস্থায় বসে কোথায় ক্লাচ, কোথায় ব্রেক, কোথায় অ্যাকসিলেটর খুঁজে পান তাঁরা, সে এক রহস্যই বটে! এক চালকের কথায়, ‘‘এ ভাবে গাড়ি চালাতে সমস্যা তো হয় বটেই। কিন্তু কিছুটা বাড়তি রোজগারের জন্যই ঝুঁকি নিয়ে চালাই।’’
এ সবের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে পরিবহণ দফতর?
সিদ্ধার্থবাবু বলেন, ‘‘অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে অটো চললে সেই সব অটো আটক করে আইনি পদক্ষেপ করা হচ্ছে। বেআইনি ডিজেল অটোর পরিবর্তে এলপিজি অটো দেওয়া হচ্ছে। ডিজেল অটো কাটাই করে নতুন অটোর অফার লেটার, পারমিট দেওয়ার কাজ দ্রুত গতিতে চলছে।’’ পাশাপাশি তাঁর দাবি, নিয়মিত ধরপাকড়ও চলছে জেলা জুড়ে। বেআইনি ভাবে বেশি যাত্রী তোলা বন্ধ করতেও পদক্ষেপ করা হয়েছে। যদিও জেলায় বৈধ অটোর তুলনায় বেআইনি অটোর সংখ্যাটা যে এখনও প্রায় দ্বিগুণ, সে কথাও মেনে নিচ্ছেন তিনি।
জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ সংস্থার সরকারি প্রতিনিধি গোপাল শেঠের দাবি, পরিবহণ দফতরের ইন্সপেক্টকররা বেআইনি অটোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছেন। পুলিশ-প্রশাসনকেও বলা হয়েছে, কড়া পদক্ষেপ করতে। ইতিমধ্যেই গাইঘাটা থানার পুলিশ বেআইনি অটো চলাচল বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছে। গোপালবাবুর দাবি, বাম আমলে বেআইনি অটোয় ছেয়ে গিয়েছিল জেলা। সেই সব অটো কাটাই করে গত এক বছরে জেলায় প্রায় তিন হাজার আইনি অটো দেওয়া হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy