E-Paper

সালিশিতে মিলায় বিবাদ, না হলে তবেই পুলিশ

রাজ্যের কার্যত সমস্ত গ্রাম, মফস্‌সলের কোণে কোণে ছোটখাট ঝুটঝামেলায় সালিশি সভা বসে। গ্রামের মাতব্বরেরা সেখানে নানা সমস্যার সমাধান করেন বলেও শোনা যায়। আবার ধর্ষণ-পণের দাবির মতো অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগও ভুরি ভুরি। যখন যে দল ক্ষমতায়, তাদের নেতানেত্রীদের নাম হামেশাই জড়ায় সালিশি সভায়। আইনের চোখে বৈধ নয় সালিশি। তবু সমাজের বুকে জাঁকিয়ে বসেছে তার প্রতিপত্তি। পরিস্থিতির খোঁজ নিল আনন্দবাজার

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫১
সালিশি সভা।

সালিশি সভা। —ফাইল চিত্র।

কয়েক বছর আগে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার একটি থানা এলাকায় প্রতিবেশী তিন বছরের শিশুকন্যার সঙ্গে ‘খারাপ’ কাজ করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে সতেরো বছরের এক নাবালকের বিরুদ্ধে। ছেলেটিকে বাড়ি থেকে তুলে এনে গাছে বেঁধে বাঁশ দিয়ে পেটানো হয়। পরে সালিশি সভায় ধরে এনেও মারধর করা হয়েছিল। সেখানে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য, তাঁর স্বামীও উপস্থিত ছিলেন বলে শোনা যায়। পর দিন সকালে ছেলেটির খণ্ড খণ্ড দেহ উদ্ধার হয়েছিল রেললাইনের কাছ থেকে। প্রশ্ন উঠেছিল, নাবালক যদি অন্যায় করেও থাকে, তা হলে কেন তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হল না। কেন সালিশি করে গ্রামের মানুষ আইন নিজেদের হাতে তুলে নিলেন।

দিন কয়েক আগে জেলাই অন্য এক এলাকায় এক নাবালিকাকে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে যাওয়ার সময়ে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফাঁকা মাঠে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত যুবককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এই ঘটনার পরে জানা যায়, ওই যুবক আগেও নাবালিকার সঙ্গে অভব্য আচরণ করেছিল। সে সময়ে এলাকার ‘বিশিষ্ট মানুষ’দের উপস্থিতিতে সালিশি সভা বসে। পরিবারের আক্ষেপ, তখনই যদি পুলিশের দ্বারস্থ হতেন, তা হলে মেয়ের উপরে এমন নির্যাতন হয় তো ঘটত না। মেয়েটি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল ধর্ষণের ঘটনার পরে। তবে আপাতত সুস্থ আছে।

সম্প্রতি বনগাঁর একটি এলাকায় দুই প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা-পুরুষকে ‘আপত্তিকর অবস্থায়’ স্থানীয় ক্লাবের সদস্য ধরে ফেলে। সেই ক্লাবের সদস্যেরা সালিশি বসিয়ে যুবকের থেকে ৩০ হাজার টাকা আদায় করে বলে অভিযোগ। সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে যুবক পুলিশের দ্বারস্থ হননি বলে জানালেন। তবে তাঁর প্রশ্ন, প্রাপ্তবয়স্ক দুই নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্কে বাইরের লোক এ ভাবে মাথা গলাবে কোন যুক্তিতে!

গ্রামে-গঞ্জে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কোনও মহিলা নির্যাতিতা হয়েছেন, এমন অভিযোগ উঠলে পরিবার সরাসরি থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতেও চান না। তাঁরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারস্থ হন। তাঁরা সম্মতি দিলে তবেই পরিবার পুলিশের কাছে যায়। কিছু জনপ্রতিনিধি চান, গ্রামে সালিশি করে আর্থিক জরিমানা ধার্য করে ‘মিটমাট’ করে দিতে। অভিযোগ, অভিযুক্তের পরিবার প্রভাবশালী হলে বা আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে সালিশির প্রবণতা বেশি থাকে। অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদেরও আর্থিক লাভ হয় বলে শোনা যায়। কিছু পরিবার লোকলজ্জার ভয়ে, সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে পুলিশে অভিযোগ করতে পিছিয়ে আসেন। আবার এমনও দেখা গিয়েছে, নির্যাতিতার পরিবার মনে করেন, পুলিশে অভিযোগ করলে মেয়ের মেডিক্যাল পরীক্ষা হবে। সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি সামনে আসবে। নির্যাতিতা নাবালিকা হলে তাকে হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এ সব সাতপাঁচ ভেবেও অনেকে থানা-পুলিশে না গিয়ে বিহিত চেয়ে গ্রাম্য সালিশির উপরেই ভরসা রাখেন। কোনও কারণে সালিশির নিদান পছন্দ না হলে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দায়ের হয়।

বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, বধূ নির্যাতন, পণের দাবিতে অশান্তির সমস্যা চেয়ে মেয়ের পরিবার গ্রামে সালিশি চেয়ে নিজেরাই তদ্বির করেন। তাতে সমস্যা অনেক ক্ষেত্রে মেটে না। উল্টে নির্যাতন বাড়ে। যার পরিণতিতে অনেক সময়ে বধূ খুন হন, আত্মহত্যা করেন— এমন হামেশাই শোনা যায়। তখন পরিবার হাত কামড়ায়, আগেই থানা-পুলিশের কাছে গেলেন না!

সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনার এক মহিলাকে ধর্ষণ, খুনের অভিযোগ উঠেছিল। ওই মহিলা কলকাতা পুলিশের এক কর্মীর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। অভিযোগ, ৫ সেপ্টেম্বর ওই পুলিশকর্মী মহিলাকে ধর্ষণ করে। ওই পুলিশ কর্মীর স্ত্রী তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য। মহিলা দাবি করেছিলেন, ধর্ষণের পরে গ্রামে সালিশি ডেকে বিষয়টি মেটানোর জন্য তাঁকে দেওয়া হয় অভিযুক্তের স্ত্রীর তরফে। মহিলা রাজি না হয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হন। পরে তাঁকে খুনের অভিযোগ ওঠে। গ্রেফতার হয় ওই পুলিশকর্মী ও তার স্ত্রী।

শুধু নারী নির্যাতন নয়, পাড়ায় মারপিট, চুরি-ছিনতাই সহ নানা বিষয়ে সালিশি ডাকা হয়। পাড়ায় কেউ জমিবাড়ি, দোকানপাট কিনলে টাকা চেয়ে হুজ্জুত এ রাজ্যে খুবই সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁডিয়েছে। টাকা-পয়সার অঙ্ক বেশি মনে হলে তখনও পাড়ার ক্লাবে সালিশি বসে।

বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতায়, বাম আমল থেকেই এই পরিস্থিতি চলছে। ইদানীং তা আরও বেড়েছে বই কমেনি! কিন্তু কেন বিচারব্যবস্থার সমান্তরাল এই প্রক্রিয়া সমাজে রমরমিয়ে বিদ্যমান? কারা মাতব্বরি করেন সালিশি সভায়? (চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Meeting

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy