প্রবণতা কমলেও সিট বুকিংয়ের এই রেওয়াজ বিরল নয় বনগাঁ লোকালে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
বনগাঁর শক্তিগড় এলাকার বাসিন্দা পেশায় স্কুল কৃষ্ণেন্দু পালিত রোজ সকালে ৮টা ৩২ মিনিটের বনগাঁ-শিয়ালদহ লোকাল ধরে কলকাতায় আসেন। নামেন দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে। দীর্ঘ দিনের এই নিত্যযাত্রীটি জানালেন, একটা সময় ছিল, যখন সকালে বনগাঁ স্টেশন থেকেও ট্রেনে উঠে বসার জায়গা পাওয়া যেত না। নিত্যযাত্রীদের অনেকে রুমাল পেতে, জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে সিগারেটের প্যাকেট, এমনকী দেশলাই কাঠি রেখেও জায়গা দখলে রাখতেন। ওই সব নিত্যযাত্রীর পছন্দের লোক ছাড়া অন্য কেউ সেখানে বসার সাহস দেখাতেন না।
তবে ইদানীং পরিস্থিতি কিছুটা হলেও বদলাচ্ছে। কৃষ্ণেন্দুবাবু জানালেন, এখন নাকি সিট বুকিংয়ের রেওয়াজ কমেছে। জিআরপি-র কড়া পদক্ষেপ সেটার যেমন কারণ, সংবাদপত্রে লেখালেখির ফলও মিলেছে।
নিত্যযাত্রীদের সকলের যে সায় ছিল এ ভাবে সিট দখলে রাখার, তা নয়। কিন্তু কিছু লোকের দাপটে মুখ খুলতে সাহস পেতেন না বেশিরভাগ মানুষ। এমনকী, বনগাঁ ছেড়ে স্টেশন বেশ কিছু দূর যাওয়া পর্যন্ত দখলে রাখা আসনে অন্য কেউ বসার সাহস দেখাতেন না। মিনমিন করে যদি বসার অনুরোধ ভেসে আসত, সঙ্গে সঙ্গে কড়া গলায় ধমক জুটত। শুনতে হতো, ‘‘আমাদের লোক আছে, এখানে বসা যাবে না।’’
কথা হচ্ছিল সকালের বনগাঁ লোকালের নিত্যযাত্রী শিয়ালদহ আদালতের কর্মচারী, বনগাঁর বাসিন্দা শান্তনু দত্তের সঙ্গে। ৮টা ০৮ মিনিটের বনগাঁ লোকালে যাতায়াত করেন তিনি। সিট দখলের প্রবণতা এখন অনেকটাই কমেছে, জানালেন।
নিত্যযাত্রী আশিস চক্রবর্তী মেনে নিলেন, এক সময়ে ওই ভাবে সহযাত্রীদের জন্য জায়গা রাখতেন তিনিও। কিন্তু একটা সময়ে তাঁর মতো আরও অনেকে ভাবতে শুরু করলেন, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। এখন সিট দখলের ওই পদ্ধতি বন্ধ করেছেন তাঁরা।
একটা সময়ে ট্রেনে জায়গা রাখতে অনেক ‘অফিস-বাবু’ মাসোহারা দিয়ে লোক রাখতেন। তারা ট্রেন স্টেশনে ঢোকার আগেই চলন্ত অবস্থায় লাফিয়ে উঠে জায়গা দখল করত। পরে বাবুরা ধীরেসুস্থে চা-সিগারেট-পান চিবোনো পর্ব সেরে এসে সেই জায়গায় বসতেন।
তবে সিট দখলের প্রবণতা কমলেও ভিড় ট্রেনে তাস পেটানো পুরোপুরি কমেনি। যাঁদের জন্য বাকি যাত্রীদের দাঁড়াতেও অসুবিধা হয়। প্রতিবাদ করলে কটূক্তি উড়ে আসে। ধাক্কাধাক্কি খেতে হয়েছে, এমন অভিজ্ঞতাও আছে অনেকের।
তাঁদেরই একজন অসীম বিশ্বাস। বনগাঁর বাসিন্দা মধ্যবয়সী মানুষটি নিয়মিত যাতায়াত করেন না ট্রেনে। বললেন, ‘‘খুব জরুরি প্রয়োজনে কয়েক মাস আগে সকালে অফিস টাইমের ট্রেনে উঠেছিলাম। দরজার কাছে গোল করে ঘিরে চারজন তাস খেলছিল। আরও কয়েকজন তাদের খেলা দেখছিল। আমি একটু সরে দাঁড়াতে বলায় কটূক্তি উড়ে এল। আমিও ছাড়ার পাত্র নই। বললাম, তাস খেলা বন্ধ করুন। এই বলতেই ওরা রে রে করে ওঠে। আমাকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় ট্ররেন থেকে।’’ অসীমবাবু জানান, বাকি কিছু সহযাত্রী তাঁর পক্ষ নিয়ে ফুঁসে ওঠায় সে দিনের মতো তাসের আসর গুটিয়েছিল দুর্বিনীতি ওই নিত্যযাত্রীর দল। হাবরার এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘একবার সকালের দিকে পরিবারের লোকজনকে নিয়ে ট্রেনে চেপে যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল, ওই সময়ে ট্রেনে উঠতেই ভয় পাই। নিত্যযাত্রীদের দাপটে মহিলাদের সম্মান নিয়ে ভিড় ট্রেনে যাতায়াত করা মুশকিল।’’
দিন কয়েক আগে বনগাঁ স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল, সকাল ৭টা ৩২ মিনিটের বনগাঁ-মাঝেরহাট লোকাল ছাড়ার আগেই সিটে পড়ে গিয়েছে রুমাল, খবরের কাজল, ব্যাগ। জানা গেল, এই ট্রেনে যাত্রীদের ব্যবহারে এখনও তেমন বদল ঘটেনি। সিট বুকিংয়ের দাপট চলছেই। একমাত্র জিআরপি যদি নিয়মিত অভিযান চালায়, তা হলেই এ সব বদমায়েশি বন্ধ হওয়া সম্ভব, বললেন, ট্রেনের এক যাত্রী।
কারণ, সংগঠিত নিত্যযাত্রীদের বিরুদ্ধে সচরাচর মুখ খোলার সাহস পান না অন্য যাত্রীরা। হাবরা থেকে ৮টা ৫২ মিনিটের লোকালেও সিট বুকিংয়ের দাপট কমেনি বলে জানালেন অনেকে।
বনগাঁ জিআরপি সূত্রে জানা গিয়েছে, সিট বুকিংয়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত ধরপাকড় চালানো হয়। যাত্রীদের ওই বিষয়ে সচেতন করতে মাইকে প্রচারও হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও নজরদারি চলবে বলে জানিয়েছে রেলপুলিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy