বাঁ দিকে, খুনের অভিযোগে ধৃত বাপির বাড়ি। ডান দিকে, এই বাড়িতেই খুন হন ফুলরেণু। ছবি: নির্মল বসু।
সে দিন পুলিশের ভূমিকায় এলাকায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল তুঙ্গে। ইট-পাটকেলও খেতে হয় পুলিশকে। তখনও ঘেরাও চলছে পুলিশের গাড়ি ঘিরে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাইক হাতে হিঙ্গলগঞ্জের ওসি মনিরুল ইসলাম সরকার বলেছিলেন, “আজ যারা পুলিশকে মারছে, তাদের মধ্যেই মিশে আছে অপরাধীরা। উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়া আমরা তাদের ধরতে পারছি না। এই অবস্থায় গ্রেফতার করলে তারা দ্রুত ছাড়া পেয়ে যাবে। তাই এখন কিছু বলছি না। পুলিশের উপরে ভরসা রাখুন।”
পুলিশের উপরে ভরসাটা অবশ্য দিন দিন কমছিল সাধারণ মানুষের। ১৩ জুলাই নৃশংস ভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল হিঙ্গলগঞ্জের কণেকনগর এলাকার বাসিন্দা পেশায় শিক্ষিকা ফুলরেণু সরকারকে। পুলিশ বার বার বলেছে, দোষীরা আছে সামনেই। কিন্তু তাদের কেন ধরা হচ্ছে না, বার বার গ্রামের মানুষের মনে উঠেছে সেই প্রশ্ন। শেষমেশ ধরা পড়েছে ফুলরেণুদেবীর প্রতিবেশী বিশ্বজিত্ মণ্ডল ওরফে বাপি। খুনের ঘটনার পরে দিন ক’য়েক এলাকা ছাড়া থাকলেও পরে বহাল তবিয়তে ফিরে আসে সে। এলাকার আরও কয়েক জনকে কিছু দিনের জন্য গায়েব হতে দেখা গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু প্রত্যেকেই পরে ফিরে এসে নানা যুক্তি খাড়া করায় গ্রামের লোকের মনে সন্দেহ দানা বাঁধেনি। মঙ্গলবার বাপি গ্রেফতার হওয়ার পরে অবশ্য পুলিশের দাবিই সঠিক প্রমাণ হল বলে এ বার মনে করছেন স্থানীয় মানুষ। বুধবার ওসি বলেন, “নির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ হাতে আসার পরে আঁটঘাট বেঁধেই এগোতে হয়েছে আমাদের। সে জন্য কিছুটা সময় লেগেছে, তা ঠিক। এক জন ধরা পড়েছে। তাকে জেরা করে বাকিদেরও গ্রেফতার করা হবে।”
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, ফুলরেণুকে খুনের ঘটনায় বাপি ছাড়াও আরও চার জন জড়িত ছিল। ফুলরেণুকে খুনের পিছনে প্রত্যেকেরই নিজের নিজের উদ্দেশ্য ছিল। তবে এক জনকে টাকার বিনিময়ে আনা হয়েছিল বলে পুলিশের অনুমান। তদন্তকারী অফিসারদের দাবি, বাপি জানিয়েছে খুনের সময়ে সে ফুলরেণুর বাড়িতে হাজির থাকলেও নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নেয়নি। বাপির বক্তব্য তদন্তসাপেক্ষ বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ফুলরেণু পড়াতেন সান্ডেলেরবিল শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনের গদাধর পাঠশালায়। তাঁর স্বামী দীনবন্ধুবাবু বেলুড় বিদ্যামন্দির হস্টেলের কর্মী। কর্মসূত্রে থাকতেন সেখানেই। মাঝে মধ্যে যাতায়াত করতেন হিঙ্গলগঞ্জের বাড়িতে। একমাত্র ছেলে শঙ্করও পড়াশোনা করে কলকাতায়। সে-ও নিয়মিত থাকত না হিঙ্গলগঞ্জে। বুধবার টেলিফোনে দীনবন্ধুবাবু বলেন, “বাপি আমার স্ত্রীকে মাঝে মধ্যে উত্যক্ত করত। স্ত্রী সে কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু ও এত বড় কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে, তা আমরা আঁচ করতে পারিনি।” সব অপরাধীদের ধরে পুলিশ চরম শাস্তি দিক, সেটাই এখন চান দীনবন্ধুবাবু।
নিহত ওই শিক্ষিকা।
পুলিশেরও প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, ফুলরেণুদেবীর একলা থাকার সুবাদে তাঁর উপরে কুনজর পড়েছিল বাপির। নানা ভাবে মাঝবয়সী ওই শিক্ষিকাকে কুপ্রস্তাব দিত সে। ফুলরেণু সে সব না মানায় রাগ চড়ত বছর চল্লিশের যুবকের মাথায়। বাপিকে জেরা করে পুলিশ জানিয়েছে, ১৩ জুলাই, ঘটনার দিন রীতিমতো আঁটঘাট বেঁধে ধারাল অস্ত্র নিয়েই ফুলরেণুর বাড়িতে পৌঁছেছিল আততায়ীরা। সকলে মদে চুর ছিল। সে দিন বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলা। রাস্তাঘাটে লোকজন কম ছিল। সন্ধে ৭টা নাগাদ সকলে পৌঁছয় ফুলরেণুদেবীর বাড়িতে। পুলিশ জানায়, ওই দিনও বাপি ফুলরেণুকে কুপ্রস্তাব দেয়। যথারীতি রেগেমেগে সে সব কথা গ্রাহ্য করেননি ফুলরেণু। সম্ভবত, ঘটনাটি এ বার বাইরের লোকজনকে জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন তিনি। তাতেই আরও মাথা গরম হয় বাপির।
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, এক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্টের কাজ করতেন ফুলরেণু। সে সব টাকা-পয়সা নিয়ে দু’জনের গোলমাল থাকতে পারে। গ্রাহকদের ওই টাকা ফেরত দেওয়ার দায় থেকে মুক্ত হতে গিয়েও ফুলরেণুকে খুনের চক্রান্ত করে থাকতে পারে ওই আত্মীয়। সে ক্ষেত্রে ফুলরেণুই সব টাকা-পয়সা সরিয়ে ফেলেছে বলে চাউর করা সহজ হত তার পক্ষে।
কিন্তু যে নৃশংসতা ফুলরেণুকে খুনের ঘটনায় দেখা গিয়েছিল, তা কি শুধু এ সব কারণেই? আততায়ীরা ফুলরেণুকে একাধিক বার ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছিল। দোতলা বাড়ির নীচে ফুলরেণুদেবীর ঘরটির দরজা-জানলা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। দেওয়াল, দরজা-জানলায় রক্ত মাখা হাতের ছাপ। ঘরের জিনিসপত্র ছিল অগোছাল। এক নজরে দেখলে বোঝাই যায়, খুনিদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ওই মহিলা। দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন। কণেকনগরের মাঝেরপাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে খুনের পিছনে আরও কিছু ঘটনার ইঙ্গিত মিলেছে। বাপি সোনা বা অন্য কোনও জিনিস পাচারে যুক্ত ছিল কিনা, থাকলেও ওই অবৈধ কারবারের জন্য ফুলরেণুর উপরে রাগের কারণ থাকতে পারে কিনা, সে প্রশ্ন উঠছে। সমস্ত দিক খোলা রেখেই তদন্ত এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন বসিরহাটের এসডিপিও অভিজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়। খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রটিরও সন্ধান চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ দিন কণেকনগরের মাঝেরপাড়ায় ফুলরেণুদেবীর বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল, দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। দু’টো-একটা কুকুর ঘুরছে সামনে। জনমনিষ্যির দেখা নেই। একটু এগোলেই বাপিদের বাড়ি। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বাপির স্ত্রী ও দুই মেয়ে। এক জন পড়ে স্কুলে। অন্য জন একেবারেই ছোট। বাপির কাকার বাড়িও ওই পাড়ায়। সেখানে গিয়ে কথা হল প্রবীণ মানুষটির সঙ্গে। খুনের ঘটনায় বাপিকে ফাঁসানো হয়েছে বলেই তাঁর বিশ্বাস। তিনি বলেন, “অপরাধীরা গ্রেফতার হচ্ছে না কেন, তা নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে পুলিশের উপরে চড়াও হন গ্রামের মানুষ। তাতে সামনের সারিতে ছিল আমার ভাইপো। পুলিশ তাই ওকে ফাঁসিয়ে দিল।” হিঙ্গলগঞ্জ থানা চত্বরে দাঁড়িয়ে একই দাবি করেছেন বাপির স্ত্রী ও বাবা।
গ্রামের মানুষ অবশ্য বাপির স্বভাব-চরিত্র নিয়ে আদৌ খুশি ছিলেন না। খুনের ঘটনায় বাপির নাম উঠে আসায় বিস্মিত নন কেউ-ই। গত ১৭ অগস্ট পুলিশের উপরে হামলায় অভিযুক্তদের এক জন তো বলেই ফেললেন, “ওই ঘটনায় বাপিই তো আমাদের উসকেছিল। শেষমেশ দেখছি ওই আসল অপরাধী। কী কাণ্ড। মাঝখান থেকে মামলা-মোকদ্দমায় হাজার দ’শেক টাকা খরচ হল। আরও যে কী কী ভোগান্তি আছে কপালে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy