Advertisement
E-Paper

৬ মাসে বাঘের পেটে ছয় মৎস্যজীবী, বাড়তি রোজগারের আশা কাড়ছে প্রাণ?

বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা প্রচুর। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন সুন্দরবনের কাঁকড়ার চাহিদা রয়েছে, তেমনি চিন, মালয়েশিয়া, জাপান, তাইল্যান্ডের মতো দেশেও সুন্দরবনের কাঁকড়া রফতানি হয়।

প্রসেনজিৎ সাহা

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৪৮
ঝুঁকি: এ ভাবেই জঙ্গলের গভীরে গিয়ে কাঁকড়া ধরেন অনেকে। নিজস্ব চিত্র

ঝুঁকি: এ ভাবেই জঙ্গলের গভীরে গিয়ে কাঁকড়া ধরেন অনেকে। নিজস্ব চিত্র

বাড়তি রোজগারের আশায় দিনের পর দিন সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘের হামলার শিকার হচ্ছেন মৎস্যজীবীরা। বাঘের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত ছ’মাসে সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘের হামলায় অন্তত ছ’জন মৎস্যজীবীর মৃত্যু হয়েছে। বেশিরভাগ মৎস্যজীবীই সরকারি অনুমতিপত্র ছাড়া জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের হামলার মুখে পড়েছেন বলে দাবি বন দফতরের।

বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা প্রচুর। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন সুন্দরবনের কাঁকড়ার চাহিদা রয়েছে, তেমনি চিন, মালয়েশিয়া, জাপান, তাইল্যান্ডের মতো দেশেও সুন্দরবনের কাঁকড়া রফতানি হয়। স্থানীয় বাজারেও কাঁকড়া চড়া দামে বিক্রি হয়। এক কেজি স্ত্রী কাঁকড়ার পাইকারি দাম প্রায় ৮০০ টাকা। আর পুরুষ কাঁকড়ার দাম ৫০০-৬০০ টাকা। এই মোটা টাকার লোভেই মূলত কাঁকড়া ধরার নেশায় সুন্দরবনের নদী, খাঁড়িতে পাড়ি দেন মৎস্যজীবীরা। বনকর্মীদের চোখ এড়িয়ে ঢুকে পড়েন জঙ্গলের ভিতরেও। বেশিরভাগ সময়ে জঙ্গলে নেমে কাঁকড়া ধরতে গিয়েই বাঘের আক্রমণের মুখে পড়ছেন মৎস্যজীবীরা।

বনদফতর সূত্রের খবর, মূলত তিন ভাবে কাঁকড়া ধরা হয়ে থাকে। নদী বা খাঁড়িতে ডিঙি নৌকোয় বসে সুত বা দোনের মাধ্যমে কাঁকড়া ধরা হয়। ভাটার সময়ে জঙ্গলে নেমে কাঁকড়ার গর্তে লোহার শিক ঢুকিয়ে কাঁকড়া ধরা হয়। লোহার শিক দিয়ে তৈরি ফাঁদ বা আঁটল জঙ্গলের মধ্যে পেতে কাঁকড়া ধরা হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পদ্ধতি অনেক বেশি বিপজ্জনক। এই দুই ক্ষেত্রেই জঙ্গলের মধ্যে নামতে হয় মৎস্যজীবীদের। আর সে সময়েই বাঘের হামলার মুখে পড়েন অনেকে।

বিপদ সত্ত্বেও কেন যান কাঁকড়া ধরতে?

মৎস্যজীবীদের অনেকেরই দাবি, অমাবস্যা ও পূর্ণিমার কোটালে এক দল মৎস্যজীবী এক-দেড় লক্ষ টাকার কাঁকড়া ধরতে পারেন। তিন-চার জনের দল মূলত অমাবস্যা ও পূর্ণিমা শুরুর দু’দিন আগে থেকে তৃতীয়া, চতুর্থী পর্যন্ত কাঁকড়া ধরার কাজ করে। এ সময়েই সব থেকে বেশি কাঁকড়া পাওয়া যায় বলে দাবি মৎস্যজীবীদের। দু’টি কোটাল মিলিয়ে এক একজন মৎস্যজীবী মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা উপার্জন করে থাকেন বলে দাবি তাঁদের। গোসাবা ব্লকের লাহিড়িপুরের বাসিন্দা পেশায় মৎস্যজীবী সুধীর মণ্ডল, মঙ্গল সর্দাররা বলেন, ‘‘মাছের বদলে কাঁকড়া ধরতে পারলে অনেক বেশি রোজগার হয়। তাই বিপদের ঝুঁকি থাকলেও কাঁকড়া ধরতেই মূলত জঙ্গলে যাই আমরা। দু’টো টাকা বাড়তি রোজগার কে না চায় বলুন?”

গত কয়েক মাসে একের পর এক বিপদ ঘটেছে। ১০ই অক্টোবর বালি সত্য নারায়নপুরের বাসিন্দা কার্তিক মণ্ডলকে বাঘে তুলে নিয়ে যায় পীরখালি ২ নম্বর জঙ্গলে। এক সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই ১৭ অক্টোবর পঞ্চমুখানি ২ নম্বর জঙ্গলে বাঘের হামলায় মৃত্যু হয় লাহিড়িপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের দত্তপাড়ার বাসিন্দা শম্ভু মণ্ডলের। শম্ভুর সঙ্গী রাধাকান্ত আউলিয়াকে তুলে নিয়ে যায় বাঘ। ঠিক এক মাসের মাথায় গত ১৬ নভেম্বর পীরখালির জঙ্গলের কাছে পঞ্চমুখানির খালে ফের বাঘের হামলার মুখে পড়েন মৎস্যজীবীরা। যদিও এ ক্ষেত্রে সঙ্গীরা নিজেদের বুদ্ধির জোরে বাঘের চোখে-মুখে কাদা ছুড়ে উদ্ধার করেন পাখিরালয়ের বাসিন্দা যাদব মণ্ডলকে। তবে ঠিক এক সপ্তাহ বাদে, ২৩ নভেম্বর গোসাবা আমলামেথি গ্রামের বাসিন্দা অনিল মণ্ডলকে কাঁকড়া ধরার সময়ে তুলে নিয়ে যায় বাঘ। মঙ্গলবার সকালে গোসাবার কুমিরমারি পঞ্চায়েতের মৃধাঘেরি এলাকার বাসিন্দা দুর্গাপদ মণ্ডলের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বাঘের হামলায়। দুর্গাপদ ও তাঁর স্ত্রী কাঁকড়া ধরার জন্যই গিয়েছিলেন সুন্দরবনের ঝিলা ২ নম্বর জঙ্গলের চিলমারির খালে। বাঘের সাথে লড়াই করে স্বামীকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেও বাঁচাতে পারেননি সন্ধ্যা।

সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ফিল্ড ডিরেক্টর সুধীরচন্দ্র দাস বলেন, ‘‘বার বার আমরা মৎস্যজীবীদের বিভিন্ন ভাবে সতর্ক করছি। সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকলে জরিমানা করছি, নৌকো আটকে রাখছি। তবুও কিছু মানুষ প্রতিনিয়ত জঙ্গলে ঢুকে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছেন।” সুন্দরবনের জঙ্গল ও নদী খাঁড়ির ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে প্রতিনিয়ত নজরদারি চললেও বনকর্মীদের চোখকে ফাঁকি দিয়েই সংরক্ষিত এলাকায় মাছ কাঁকড়া ধরতে ঢুকে পড়ছেন মৎস্যজীবীরা। বন দফতরকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত মৎস্যজীবীদের বিভিন্ন ভাবে সচেতন করছেন, বিকল্প কর্ম সংস্থানের আশ্বাস দিচ্ছেন। ১০০ দিনের প্রকল্পে অনেককে জবকার্ড করে দেওয়া হলেও কাঁকড়া ধরার নেশা কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন কুমিরমারি পঞ্চায়েতের প্রধান দেবাশিস মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘‘আসলে কাঁকড়া ধরতে পারলেই প্রচুর রোজগার হচ্ছে। মাসের মধ্যে দু’সপ্তাহ কাজ করলেই মোটা টাকা আয় হচ্ছে। তাই বিকল্প কর্মসংস্থান, ১০০ দিনের কাজ— কিছুতেই উৎসাহ নেই এক শ্রেণির মৎস্যজীবীর।’’

বিপদের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও জীবন বাজি রেখে জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে ঢুকছেন অনেকেই।

Tiger Sundarban
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy