মিনাখাঁয় আক্রান্ত এক যুবকের বাড়িতে। শুক্রবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
কলকাতা থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে মিনাখাঁর অজগ্রাম। আর সেখানেই সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে একের পর মারা যাচ্ছেন দরিদ্র মানুষ।
২০১২ সাল থেকে মিনাখাঁর গোয়ালদহ গ্রামে এখনও পর্যন্ত এই মারণ রোগে অন্তত ১৯ জন মারা গিয়েছেন। আক্রান্তের সংখ্যাটা প্রায় ১৮৯ জন। এর মধ্যে ২০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। শুক্রবার কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা ওই সব এলাকায় এসে আক্রান্ত পরিবারগুলির অবস্থা দেখেন। কিছু ওষুধপত্র দেন।
ওই দলে ছিলেন পরিবেশ কর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশে আমি আক্রান্ত মানুষের বর্তমান অবস্থা খতিয়ে দেখতে এসেছিলাম। এতজন মানুষ মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। অনেকে আক্রান্ত। অথচ সরকার এদের জন্য কিছু করছে না। আমি সব কিছু খতিয়ে দেখে সেই মতো রিপোর্ট জমা দেবো।’’ বিশ্বজিৎবাবু জানান, তাঁরা যে আসছেন, সে কথা প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন। প্রশাসনের তরফে যাতে কেউ হাজির থাকেন, সেই অনুরোধও জানানো হয়েছিল। কিন্তু কেউ আসেননি।
২০০৯ সালে আয়লার পরে উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁর গোয়ালদহ, দেবীতলা, সন্দেশখালির ১ ব্লকের রাজবাড়ি, সন্দেশখালি ২ ব্লকের ঝুপখালি, জেলিয়াখালি এলাকার কয়েকশো গরিব মানুষ কাজের তাগিদে আসানসোল, জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ, কুলটি এলাকায় পাথর খাদানের কাজে যান। ২০১২ সালে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে গ্রামে ফিরতে শুরু করেন অনেকে। তাঁদের শ্বাসকষ্ট, জ্বর, কাশি-সহ নানা উপসর্গ ছিল। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে গেলে বলা হচ্ছে, যক্ষা বা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা। সেই মতো চিকিৎসাও করা হয়। অভিযোগ, প্রথম দিকে রোগটা ঠিক মতো ধরাই যাচ্ছিল না অনেকের ক্ষেত্রে।
২০১২ সালে প্রথম মারা যান ওই গ্রামের হোসেন মোল্লা। চিকিৎসায় গাফিলতি হচ্ছে, এই সন্দেহে আবুল পাইক, স্মরজিৎ মণ্ডল, বিশ্বজিৎ মণ্ডল, মফিজুল মোল্লাকে নিয়ে ভেলোরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে ধরা পড়ে, প্রত্যেকেই সিলিকোসিসে আক্রান্ত। গ্রামে ফিরে আসার পরে ২০১৪ সালে মারা যান আবুল পাইক, ২০১৫ সালে বিশ্বজিৎ মণ্ডল, ২০১৭ সালে স্মরজিৎ মণ্ডলেরও মৃত্যু হয়। মফিজুল মোল্লা এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
আবুল পাইক মারা যাওয়ার পরে গ্রামবাসীরা মিলে গড়ে তোলেন ‘শান্তি গণতন্ত্র সংহতি মঞ্চ’ এবং ‘আবুল স্মৃতি সেবা কেন্দ্র।’ ওই মঞ্চের সদস্য সইদুল পাইক প্রথম থেকে আক্রান্তদের পাশে আছেন। তিনি বলেন, ‘‘আয়লার পরবর্তী সময়ে এলাকায় তেমন কাজ ছিল না। পেটের তাগিদে গ্রামের বেকার যুবকেরা আসানসোল-সহ বিভিন্ন জায়গায় পাথর খাদানে কাজে যান। সেখানেই এই রোগে আক্রান্ত হন।’’ কিন্তু আক্রান্ত পরিবারগুলির পাশে সরকার সে ভাবে দাঁড়ায়নি বলে তাঁর অভিযোগ। শুধু মাঝে মধ্যে গ্রামে স্বাস্থ্য শিবির করা এবং পঞ্চায়েত থেকে আক্রান্ত পরিবারগুলিকে কয়েক দফায় কয়েক কেজি করে চাল দেওয়া ছাড়া আর কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
স্থানীয় মানুষের আরও অভিযোগ, যে ১৯ জন মানুষ মারা গিয়েছেন সিলিকোসিসে, তাঁদের মধ্যে মৃত মনিরুল মোল্লার স্ত্রী মুসলিমা বিবি ছাড়া আর কেউ বিধবা ভাতাও পাচ্ছেন না। আক্রান্ত ৫টি পরিবারকে কেবলমাত্র সরকারি ভাবে ৪০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত পরিবারের কেউ প্রায় ২ টাকা কেজি দরে চাল পাচ্ছেন না। অনেকের আবার রেশন কার্ড নেই।
তাঁদের আরও দাবি, ১৯টি পরিবারকেই বিধবা ভাতা দিতে হবে। ভাতার টাকা ৭৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার করতে হবে। ক্ষতিপূরণ ৪ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৬ লক্ষ টাকা করতে হবে বলেও দাবি উঠেছে। সংকটজনক রোগীদের ২ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে বলেও দাবি। এ ছাড়া, নিয়মিত সরকারি ভাবে চাল, ডাল দিতে হবে, আক্রান্ত পরিবারগুলিকে ১০০ দিনের কাজে যুক্ত করতে হবে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে নিয়মিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে বলে দাবি জানান গ্রামের মানুষ।
সিলিকোসিসে আক্রান্ত সফির আলি পাইক, রহমান আলি মোল্লা, দেবু মণ্ডলরা বলেন, ‘‘আমাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে সব শেষ। সরকারি ভাবে কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দেওয়া চাল, ডাল ওষুধের উপরে কোনও রকমে বেঁচে আছি।’’ আক্রান্ত মানুষজন জানালেন, শ্বাসকষ্টের জন্য ওই সব সংস্থা অক্সিজেন সিলিন্ডারও দিয়েছে।
জানা গিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশ ও শ্রম দফতরের আইনে বলা আছে, যদি কোনও ব্যক্তি পেশাগত কাজে গিয়ে কোনও রোগে আক্রান্ত হন, তা হলে ওই ব্যক্তি সরকারি ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৪ লক্ষ টাকা পাবেন। এ নিয়ে ২০১৪ সালে একটি সংস্থা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ জানায়, হাইকোর্টেও মামলা করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy