শুরুতে যে ঝড়টা উঠেছিল, মনে হয়েছিল, আস্তে আস্তে তার তেজ কমে আসবে। আবার মাথা তুলে দাঁড়ানো যাবে। কিন্তু এক বছর আগের নোট-বন্দির খেলা সামলাতে না পেরে বসিরহাটের গামছা শিল্প সেই যে মুখ থুবড়ে পড়েছিল, এখনও চাঙ্গা হতে পারেনি।
এখানকার কারিগরদের তৈরি গামছার কদর ছিল দেশজোড়া। বসিরহাটের সীমান্তবর্তী পানিতর গ্রামের শিল্পীদের হাতে তৈরি ‘মুনসি’র গামছা দেশ-বিদেশেও যেত। পানিতরের পশ্চিম কারিগরপাড়ায় মূলত গামছা শিল্পীদেরই বাস। প্রায় প্রত্যেকের বারান্দায় তাঁত, চরকা বসানো। দিনভর মাকুর খুটখাট শব্দ। গামছা বেচে গাড়ি-বাড়ি না করতে পারলেও মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব ছিল না প্রায় চারশো পরিবারের।
কিন্তু গত বছর নোট বাতিলের পর থেকে ছবিটা বদলে গিয়েছে। একটা সময় আবার জিএসটি-র ধাক্কাও এল। সে সব সামলে ওঠার মতো অবস্থায় নেই গামছা শিল্পীরা।
একটি গামছা তৈরি করতে অন্তত তিনজন লাগে। চরকায় সুতো তুলে, মাড় ঘসে গামছা তৈরি করে সপ্তাহে বড় জোর মিলতে পারে সাড়ে ন’শো টাকা। নোটবন্দির পরে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মহাজনের কাছ থেকে পুরো টাকা দিয়ে গামছা কিনতে রাজি নন। কারণ, নগদ টাকার অভাব।
ফলে উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছেন শিল্পীরা। আর নগদ টাকার জোগান কমায় কাজ ছে়ড়ে যাচ্ছেন অনেকে, জানালেন শিল্পীরা। বন্ধ হচ্ছে বহু তাঁত।মঙ্গলবার, নোট-বন্দির বর্ষপূর্তিতে পানিতর গ্রামে গিয়ে জানা গেল গামছা শিল্পীদের দুর্দশার কাহিনী।
আবুল হোসেন মোল্লা, ফজলুল রহমান মোল্লারা বলেন, ‘‘মহাজনেরা গ্রাম থেকে গামছা কিনে বসিরহাটের পুরাতন বাজারে পাইকারি হাটের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। তাঁরা কলকাতার বড়বাজার, হরিশা মার্কেট-সহ রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় পাঠান এখানকার গামছা।
নোটবন্দির ফলে কলকাতা কিংবা বসিরহাটের ব্যবসায়ীরা বেশি নগদ টাকা দিতে না পারায় মহাজনের পক্ষে গ্রামের শিল্পীদের টাকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে কারিগরেরা কম গামছা বুনছেন।
রোজগার হারানোয় কাজ ছাড়ছেন শ্রমিকেরা। যে সব পরিবার গামছা বানাত, তাঁরাও লাভের মুখ না দেখতে পেয়ে কাজ ছাড়ছেন বা ছাড়ার কথা ভাবছেন।
কয়েকটি বন্ধ তাঁত দেখিয়ে আব্দুল রউফ মোল্লা বলেন, ‘‘নোটবন্দির কারণ বড় ব্যবসায়ীরা টাকা দিচ্ছে না। ফলে আমার পক্ষে গ্রামের শিল্পীদের সুতো-সহ কাঁচামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জিএসটি-র জন্য কাঁচা মালের দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে একজন সারা দিন ধরে গামছা তৈরি করে বড়জোর ১০০ টাকা, মহিলারা সুতো কেটে গোটা ২০ টাকার বেশি আয় করতে পারছেন না।’’
রউফ জানান, আগে মাথা-পিছু আয় ছিল অনেকটাই বেশি। এই পরিস্থিতিতে শিল্পীরা অনেকে ইটভাটা, ভ্যান-টোটো চালানোর কাজ খুঁজে নিয়েছেন বলে জানালেন তিনি। ওই ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘আগে দিনে তিনশো গামছা কিনতাম। নোটবন্দির পরে সংখ্যাটা একশোতে ঠেকেছে।’’
তাঁত সংগঠনের জেলা নেতা রূপেন রায় বলেন, ‘‘নোটবন্দির কারণে টাকা-পয়সা লেনদেন কঠিন হওয়ায় তাঁত শিল্প বিপর্যস্ত।’’