স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৫ সালে একাধিক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনায়। গত বছর শুধু বনগাঁ মহকুমাতেই মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জন প্রসূতির। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শেষ মুহূর্তে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নার্সিংহোম থেকে সরকারি হাসপাতালে আনা হয়েছিল প্রসূতিদের। বাঁচানো যায়নি কাউকেই।
কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে স্বাস্থ্য দফতর। প্রথমত, জেলায় অনেক পরিবারেরই ধারণা সরকারি হাসপাতালের থেকে নার্সিংহোমে সন্তান প্রসবের জন্য বেশি নিরাপদ। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রসূতিকে নার্সিংহোম থেকে সরকারি হাসপাতালে আনা হয়েছে। তবে তখন আর বিশেষ কিছু করার থাকে না।
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “মহকুমা হাসপাতাল, স্টেট জেনারেল হাসপাতাল বা জেলা হাসপাতালের চিকিৎসা পরিকাঠামো নার্সিংহোমের তুলনায় অনেক উন্নত। বেশিরভাগ নার্সিংহোমে ২৪ ঘণ্টার ব্লাডব্যাঙ্ক, আইসিসিইউ, এইচডিইউ, এমনকী, প্রশিক্ষিত অ্যানাসথেটিস্ট পর্যন্ত নেই। প্রসবের পরে মায়ের যদি শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়, তখন জীবনরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকে না। সরকারি হাসপাতালগুলিতে এই সব পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও বহু মানুষ এখনও বেসরকারি নার্সিংহোমকে বেশি নিরাপদ বলে ধরে নিচ্ছেন।”
চিকিৎসা ছাড়াও পরিবারের অসচেতনতা, পরিবহণ সংক্রান্ত সমস্যার কারণেও প্রসূতি মৃত্যু ঘটছে। জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সমুদ্র সেনগুপ্ত বলেন, “সময়মতো হাসপাতালে না পৌঁছনো প্রসূতি মৃত্যুর বড় কারণ। বাড়ির লোকের অবহেলা, যানজট বা পরিবহণের অভাবে অনেক সময়ে দেরি হয়ে যায়।” বারাসত জেলা হাসপাতালে গত বছর দু’জন প্রসূতির মৃত্যু হয়েছিল। সুপার সুব্রত মণ্ডলের বক্তব্য, “কিছু ক্ষেত্রে একদম জরুরি ভিত্তিতে সিজ়ার করতে হয়। তখন প্রসব পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে এই সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়।”
তবে প্রসূতি মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে নাবালিকা মাতৃত্ব। বনগাঁ মহকুমার সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মৃগাঙ্ক সাহা রায়ের বক্তব্য, “নাবালিকাদের শরীর সন্তান জন্মদানে প্রস্তুত থাকে না। ফলে প্রসূতি মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। এ বছর ১৮ ও ১৯ বছরের দুই প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। নাবালিকা বিয়ে বন্ধ হলে নাবালিকা প্রসূতির মৃত্যুও বন্ধ করা যাবে।’’ এই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি এক কর্মশালায় আশাকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নাবালিকা বিয়ে রোধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রত্যেকটি প্রসূতি মৃত্যুর ক্ষেত্রে তিন স্তরের অডিট চালু করা হয়েছে— গ্রামস্তরে স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতালের সুপার এবং কিছু ক্ষেত্রে জেলাশাসকের নেতৃত্বে। অপ্রয়োজনীয় সিজ়ার বন্ধেও কড়া পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। সিজ়ার অপ্রয়োজনে হলে পরবর্তী প্রসব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এর পাশাপাশি, নার্সিংহোমগুলির গাফিলতি থাকলে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বন্ধও করে দেওয়া হতে পারে। স্বাস্থ্য দফতরের কড়া বার্তা, প্রসূতি মৃত্যু একটিও নয়— এই লক্ষ্যেই জোরদার হচ্ছে নজরদারি, পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং সচেতনতামূলক প্রচার।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)