প্রথমে কাজের লোভ, কখনও বা প্রেমের অভিনয়। আর তারপর একদিন আচমকাই নিখোঁজ!
সাম্প্রতিক দিনে ফের একের পর এক তরুণী নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন সুন্দরবনের বাসন্তী, গোসাবা, ক্যানিংয়ের গ্রামগুলির অলি-গলির ভিতর থেকে। শেষ পর্যন্ত তাদের ঠিকানা হচ্ছে ভিন্ রাজ্যের অন্ধকার কোণ, যৌনপল্লিতে। কারও খোঁজ মিলছে, কেউ হারিয়ে যাচ্ছেন চিরতরে। অভিযোগের পাহাড় জমছে থানায়, সঙ্গে বাড়ছে আতঙ্ক।
সম্প্রতি বাসন্তীর দুই তরুণী নিখোঁজ হয়েছেন। গোসাবা থেকেও নিখোঁজ হয়েছেন তিন তরুণী। ক্যানিং থানায় গত কয়েক মাসে একাধিক এমন অভিযোগ জমা পড়েছে। সংখ্যাটা যত বাড়ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে সুন্দরবন এলাকায় নারী পাচারের বিপজ্জনক চক্র এখনও সক্রিয়। প্রশাসনের নথি বলছে, প্রতি বছরই সুন্দরবনের বাসন্তী, গোসাবা, ক্যানিং ১ ও ২ ব্লক থেকে বহু নাবালিকা, তরুণী, গৃহবধূ পাচার হয়ে যাচ্ছেন ভিন্ রাজ্যে।
সমাজকর্মী আমিনা খাতুন লস্কর জানান, এ অঞ্চলে দারিদ্র্যই পাচারকারীদের প্রধান হাতিয়ার। ‘‘কখনও মেয়েদের বা পরিবারের হাতে নগদ টাকার লোভ দেওয়া হয়, কখনও প্রেমের অভিনয় করে সহজেই বিশ্বাস জেতা হয়’’— বলছেন আমিনা। অনেক ক্ষেত্রে আবার পরিবারকে বুঝিয়ে বলা হয়, মেয়েটি শহরে গিয়ে ভাল কাজ করবে, সংসারে টাকা পাঠাবে। গ্রামের সঙ্কটগ্রস্ত পরিবারগুলি সহজেই ফাঁদে পা দেন। কিছু দিন কোনও কোনও পরিবারে টাকা আসে, এটাও ঠিক। কিন্তু যখন তাঁরা বুঝতে পারেন মেয়েকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না— তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, নিখোঁজের অভিযোগ পেলেই তারা তদন্ত শুরু করে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ তদন্তকারী দল গড়ে মেয়েদের উদ্ধারও করা হয়। তবু সব সময়ে সাফল্য আসে না। আমিনার অভিযোগ, ‘‘পুলিশ যদি অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৎপর হত, অনেক মেয়েকে ফেরানো যেত। কিন্তু কখনও কখনও থানার গাফিলতিতে সময় নষ্ট হয়, তখন মেয়েদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না।’’
উদ্ধারের পরে ফের নতুন লড়াই শুরু হয়। অবসাদ, পারিবারিক চাপ, সামাজিক লজ্জা— সবই এক সঙ্গে আঘাত হানে। কেউ আর ফিরতে চান না নিজের গ্রামে, কেউ নতুন করে দাঁড়ানোর সাহস হারান। পরিবারও অনেক ক্ষেত্রে এঁদের ফিরিয়ে নিতে চায় না।
এমন মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। উদ্ধার হওয়া মেয়েদের সেলাই, হাতের কাজ, প্রাণিপালন, ছোটোখাটো ব্যবসার কৌশল শিখিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার পথ দেখাচ্ছে তারা। কাকলি দাস নামে এক সমাজকর্মী বললেন, ‘‘মেয়েদের শুধু উদ্ধার করলেই হয় না, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে রোজগারের রাস্তা দেখাতে হয়, আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হয়।’’
পুলিশ জানিয়েছে, নিখোঁজের প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়। আবার প্রশাসনের তরফে সচেতনতা শিবিরও করা হয় গ্রামেগঞ্জে। তবু একের পর এক তরুণী হারিয়ে যাওয়া থামছে না। শুধু প্রশাসনিক তৎপরতায় নয়, দরকার আরও বেশি সচেতনতা, গ্রামস্তরেই পরিবারের মনোভাব বদলানো— না হলে এই চক্র থামানো কঠিন, জানালেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের অনেকে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)