প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মিড ডে মিলে তছরুপের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে প্রশাসনিক তদন্তে। অভিযুক্ত স্বীকার করেছেন সে কথা। তা সত্ত্বেও ব্লক প্রশাসন কোনও আইনি পদক্ষেপ না করে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে মহকুমাশাসকের কাছে অভিযোগ জানালেন তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির এক সদস্য। ঘটনাটি মথুরাপুর ২ ব্লকের বাড়িভাঙা বামাচরণ বিদ্যাপীঠের। ডায়মন্ড হারবারের মহকুমাশাসক শান্তনু বসু বলেন, “গোটা বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি।” বিডিও মোনালিসা তিরকে বলেন, ‘‘তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।’’
ব্লক প্রশাসনিক কার্যালয়ের পাশে এই স্কুলে মিড ডে মিল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ তুলছিলেন অভিভাবকেরা। ওই তৃণমূল নেতা পালান মিস্ত্রি বলেন, “আমি গোপনে স্কুল থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য ও নথি সংগ্রহ করে তা নিয়ে মে মাসে বিডিওর কাছে লিখিত অভিযোগ জানাই।” অভিযোগের ভিত্তিতে বিডিওর নির্দেশে ২৬ মে প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সরেজমিন তদন্ত করেন ব্লক প্রশাসনের চার আধিকারিক। তাঁরা রিপোর্টে গরমিল থাকার কথা তথ্য-সহ উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন। প্রশাসনিক নথি থেকেই জানা গিয়েছে, তদন্ত করা হয়েছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। সেখানে দেখা গিয়েছে, ওই মাসের ১০ তারিখ পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে হাজিরা খাতায় প্রকৃত উপস্থিতির হার যথাক্রমে ১৩৬, ১২৬, ১১৩ ও ১১৬ হিসাবে মোট ৪৯১ জন। অথচ প্রশাসনকে দেওয়া মিড ডে মিলের শংসাপত্রে সংখ্যাগুলি বাড়িয়ে করা হয়েছে যথাক্রমে ১৬০, ১৫০, ১৪০ ও ১৩৫ হিসাবে মোট ৫৮৫। অর্থাৎ, ওই দিন বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে ৯৪ জনকে। আর গোটা মাসে মোট উপস্থিতি যেখানে ৫ হাজার ৬২০ সেখানে ২ হাজার ১০৫ জনকে বাড়িয়ে মোট সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৭ হাজার ৭২৫। ওই মাসের ১২ ও ১৩ তারিখ ক্লাস না হলেও ১১৪০ জনকে মিড ডে মিল দেওয়ার হিসাব দেখানো হয়েছে।
এই রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে ৩০ জুন প্রধান শিক্ষক অসিতবরণ হালদারকে সরকারি নিয়ম ভাঙার জন্য শো-কজ করেন বিডিও।
২ জুলাই শো-কজের জবাবে প্রধান শিক্ষক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ৭০-৮০ জন দরিদ্র ছাত্রছাত্রী রয়েছে, যারা নিয়মিত মিড ডে মিল খায়। তা ছাড়া, ওই দু’দিন ক্লাস না হলেও স্কুলের বার্ষিক খেলা থাকায় প্রায় সতেরোশো পঞ্চাশ জনকে খাওয়ানো হয়েছিল। বিডিও অবশ্য বলেন, “এ ভাবে খাওয়ানো যায় না।”
স্থানীয় বাসিন্দা অভিভাবক হারানচন্দ্র হালদার, দিবাকর মণ্ডলরা বলেন, “খাওয়ার মান খুব নিম্নমানের। তাই অনেক ছাত্রছাত্রী নিয়মিত খায় না। তাই খাবার নষ্ট না করে কোনও কোনও দিন উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরাও খায়। সেই বিষয়টিকে পরিকল্পিত ভাবে অর্থ তছরুপে ব্যবহার করছেন প্রধান শিক্ষক।”
স্কুলের পরিচালন সমিতির সদ্য প্রাক্তন সহ সভাপতি স্বপন বৈদ্য বলেন, “উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশই মিড ডে মিল খায় না। একমাত্র মাছ বা ডিম হলে খায়। বছরের পর বছর ধরে চলা এই তছরুপের বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ জানিয়েও তা আটকাতে পারিনি, বিষয়টিতে সরাসরি পরিচালন সমিতির হস্তক্ষেপ করার এক্তিয়ার নেই বলেই।”
পালান মিস্ত্রির অভিযোগ, তিনি একটি মাসের তছরুপের উদাহরণ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আর্জি জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশাসনিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পরেও অন্যান্য বছর ও মাসের ক্ষেত্রে কোনও তদন্ত করা হয়নি। কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, “গোটা বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে প্রশাসনের তরফে। গত কয়েক বছরে প্রধান শিক্ষক যে লক্ষ লক্ষ টাকা তছরুপ করেছেন, তা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হলেই ধরা পড়বে। বারবার বলা সত্ত্বেও বিডিও কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাধ্য হয়ে আমি মহকুমাশাসককে বিষয়টি জানিয়েছি। আমরা চাই প্রশাসন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করুক।”
প্রধান শিক্ষককে বারবার ফোন করে ও এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। স্কুল সূত্রে বলা হয়েছে, তিনি গত দু’সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে স্কুলে আসছেন না। বিডিও বলেন, “আইনি পদক্ষেপ করার জন্য পদ্ধতিগত কাজ করা হচ্ছে। এফআইআর করার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy