এখানেই খুন হয়েছিল রাজীব, দেখালেন দিদি রিঙ্কু।—নিজস্ব চিত্র
চার বছরে অনেক বদলে গিয়েছে এলাকাটা। একটা মৃত্যুর পর অন্ধকারে আলো জ্বলেছে। বেড়েছে পুলিশের কড়াকড়ি। তার পর আরও একটি মৃত্যুর জেরে বিশাল থানা ভেঙে চার টুকরো হয়েছে। কমেছে অপরাধও।
আজ, বৃহস্পতিবার বারাসতে রাজীব দাস হত্যাকাণ্ডের রায়। আগের রাতে সেই ‘বধ্যভূমি’তে পা রাখলেন দিদি রিঙ্কু দাস।
বারাসত স্টেশন। রাত সাড়ে ১০টা। চার বছর আগে কলকাতা থেকে কাজ সেরে এই স্টেশনেই নেমেছিলেন রিঙ্কু। ২০১১-র ১৪ ফেব্রুয়ারি এই পথ দিয়েই ভাই রাজীব তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল সাইকেলে চাপিয়ে। এই সেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলা আদালতের রাস্তা। সেই জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ চত্বর। সেখানেই তিন নেশাগ্রস্ত যুবক ভাই-বোনকে ‘ভ্যালেন্টাইন’ ভেবে গায়ে ঢেলে দিয়েছিল মদ। দিদিকে বাঁচাতে গিয়ে ছুরির কোপে লুটিয়ে পড়েছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব। দিদি ছুটে গিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন এএসপি বাংলোর পুলিশকর্মীদের কাছে। কেউ এগিয়ে আসেননি। সাহায্য মেলেনি। বাঁচেনি রাজীবও।
সেই ঘটনার পরে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন রিঙ্কু। বাড়ির বাইরে তেমন একটা বের হন না বললেই চলে। চার বছরের মাথায় বুধবার রাতে আবার ট্রেন থেকে বারাসত স্টেশনে নামলেন তিনি। ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম একটু ফাঁকা হতেই রিঙ্কুর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন আশপাশের কয়েকজন। ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন চুপ করে। এখানেই ভ্যান-রিকশা স্ট্যান্ড। এখান থেকেই দিদিকে সাইকেলে চাপিয়েছিল রাজীব।
এ বার শুরু হল সেদিনের ভয়াবহ পথ ধরে বাড়ি ফেরা। স্টেশন থেকে হেঁটে রাস্তা ধরে জেলা পরিষদ থেকে এগিয়ে গেলেন আদালতের দিকে। সাত মিনিটের রাস্তা। জেলাশাসকের অফিসের সামনে তিন মাথার মোড়ে নেতাজির মূর্তি। এখানেই ভাইবোনকে আটকে ছিল মদ্যপ যুবকেরা। রিঙ্কু বলেন, “সেদিন এখানে ওরা ছাড়া কোনও লোক ছিল না। এ জায়গাটা ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখন আলো জ্বলছে।” রাজীব হত্যার পরে রাজ্য জুড়ে শোরগোল ওঠায় জেলা প্রশাসন ওই নির্জন রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে।
জেলা পরিষদ, আদালতের সামনে মোতায়েন রয়েছেন পুলিশকর্মীরা। সুনসান রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বারবারই চমকে উঠছিলেন রিঙ্কু। পাশের কাছারি ময়দানেও আলো জ্বলেছে। বসেছে সিসিটিভি। কিছুটা এগিয়ে দেখা গেল, রাস্তা দিয়ে ছুটছে মত্ত যুবকদের বেপরোয়া মোটরবাইক। রাজীব হত্যার কয়েক মাস পরে এ রকম এক মোটরবাইকে চড়েই ভ্যানরিকশা আরোহী এক মহিলার ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল দুষ্কৃতীরা। বাধা দিতে গিয়ে জখম হয়েছিলেন ওই মহিলা।
জেলা আদালতের সেরেস্তাগুলোয় এখনও নেই আলো। সামনে কিছু ঝুপড়ি দোকান। তবে বন্ধ। রাজীবের মৃত্যুর পরে ঝুপড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, ফের তৈরি হয়ে গিয়েছে। তবে আদালত চত্বর পার হয়ে এ দিন টহলদারি পুলিশ ভ্যান দেখা গিয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলোর কাছে। সেখানে এসে রিঙ্কু বলেন, “সে দিন এই বাংলোর গেট ধরে ঝাঁকাচ্ছিলাম। কেউ আসেননি।” রাস্তাটা দেখিয়ে বলেন, “এখান দিয়ে পাগলের মতো ছুটোছুটি করছিলাম।” ও পারে ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে এ দিনও মদ্যপান করতে দেখা গেল এক ব্যক্তিকে।
এর মধ্যে টহলদারি ভ্যান থেকে নেমে পড়েছেন পুলিশকর্মীরা। এগিয়ে এসে পরিচয় জানতে চাইলেন। তার পর ফের উঠে পড়লেন গাড়িতে। রিঙ্কু বলেন, “যদি সে দিন এত আলো থাকত! যদি পুলিশ ছুটে আসত!”
রায়দানের দিনটা ঘোষণা হওয়া মাত্র রিঙ্কু আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারছেন না। না ঘুমিয়ে বসে গিয়েছে চোখ। শরীরটাও ক্লান্ত। তবু জানেন, এ দিন রাতেও ঘুম হবে না।
রাজীব হত্যার পরে এলাকাবাসী ফেটে পড়েছিলেন ক্ষোভে। তার দু’বছর পরে কামদুনির ঘটনা। বারাসত থানার গুটিকয়েক পুলিশের পক্ষে এত বিশাল এলাকা দেখভাল আদৌ সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন বারবার উঠছিল। এর পরেই ২০১৩ সালের শেষ দিকে বারাসত থানাকে ভেঙে মধ্যমগ্রাম, শাসন ও দত্তপুকুরের মতো আরও তিনটি থানা করা হয়। এখন অপরাধের সংখ্যা খানিকটা কমেছে বারাসতে।
পরিসংখ্যানও বলছে সেকথা। ২০১১ সালে বারাসতে ১৪টি ধর্ষণ, ২০টি খুনের ঘটনা ঘটে। ২০১২ সালে ২৪টি ধর্ষণ ও ৩৪টি খুন। ’১৩-য় ২০টি ধর্ষণ ও ১৬টি খুন। আর থানা ভাগের পরে ২০১৪ সালে ৬টি ধর্ষণ ও ৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসপি তন্ময় রায়চোধুরী বলেন, “প্রচার, পুলিশের নজরদারি এবং মহিলা হেল্পলাইনও অপরাধ কমাতে সাহায্য করেছে।”
বদল এসেছে অনেকটা, মানছেন রিঙ্কুও। কিন্তু মন শান্ত হয়নি। “খুব রাগ হচ্ছে জানেন!” দুঃস্বপ্নের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে রিঙ্কু বলে চলেন, “এত আলো! মনটা তো সেই অন্ধকার! সেখানে আলো জ্বলল না তো!” আদালতের রায়ে অন্ধকার মুছবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy