Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রাচীন শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হল না এখনও

রাজ্যের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন পুরসভা (১৮৭০ সালে তৈরি) গোবরডাঙা। অথচ আধুনিক শহর হিসাবে আজও গড়ে উঠল না এই এলাকা। নূন্যতম পরিষেবা হিসাবে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাই গড়ে তোলা যায়নি এখনও। যা নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ প্রচুর। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, গোবরডাঙার লোকসংখ্যা ৪৫,৩৯২ জন। পুরসভার মোট আয়তন ১৩.৫ বর্গ কিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা ১৭টি। ২০১০ সালের শেষ পুর ভোটে বামেদের হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল।

অপরিসর স্টেশন রোডে যানজট লেগেই থাকে।

অপরিসর স্টেশন রোডে যানজট লেগেই থাকে।

সীমান্ত মৈত্র
গোবরডাঙা  শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:৩৯
Share: Save:

রাজ্যের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন পুরসভা (১৮৭০ সালে তৈরি) গোবরডাঙা। অথচ আধুনিক শহর হিসাবে আজও গড়ে উঠল না এই এলাকা। নূন্যতম পরিষেবা হিসাবে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাই গড়ে তোলা যায়নি এখনও। যা নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ প্রচুর।

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, গোবরডাঙার লোকসংখ্যা ৪৫,৩৯২ জন। পুরসভার মোট আয়তন ১৩.৫ বর্গ কিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা ১৭টি। ২০১০ সালের শেষ পুর ভোটে বামেদের হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। চেয়ারম্যান হন তৃণমূলের সুভাষ দত্ত। দরজায় কড়া নাড়ছে ফের একটি পুরভোট। পুরবাসী এখন ব্যস্ত গত পাঁচ বছরে এলাকার উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের খতিয়ান মেলাতে। স্থানীয় মানুষের কথায়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিকাশি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাড়ি বাড়ি আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা থেকেই গিয়েছে।

প্রাচীন শহরের বাজার এলাকার রাস্তাগুলি খুবই অপরিসর। গোবরডাঙা বাজার ও স্টেশন রোড দিয়ে দ্রুত যাতায়াত করতে মানুষ সমস্যায় পড়েন। শহরের মধ্যে যাতায়াতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল ভ্যান রিকশা। ট্রেন বা বাস থেকে নেমে বাড়িতে যাতায়াত করার অন্যতম মাধ্যমও ভ্যান।

পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯২৬ সালে গোবরডাঙায় প্রথম রিকশা চালু হয়। চালকদের সুবিধার জন্য ওই বছর থেকেই পুরসভা থেকে লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয়েছিল। গোবরডাঙা স্টেশন-সংলগ্ন এলাকায় দাঁড়িয়ে ছিলেন বাদল চক্রবর্তী নামে এক ভ্যান চালক। তিনি বলেন, “রাস্তা চওড়া হলে ভাল হয়। বড় গাড়ি সামনে চলে এলে খুবই অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। দূর-দূরান্ত থেকে ট্রাকগুলি মালপত্র নিয়ে শহরে ঢোকে। সরু রাস্তার ফলে যানজট হয়।”

বনগাঁ-বসিরহাট সড়কে স্থানীয় কালীবাড়ি মোড়ের কাছে রাস্তার কাজ চলায় এখন বনগাঁ থেকে বসিরহাট যাওয়ার বাসগুলি স্থানীয় গৈপুর তেঁতুলতলার মোড় থেকে ঘুরপথে শহরের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করছে। ফলে সাময়িক দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। অন্য সময়ে বনগাঁ থেকে বসিরহাট যাতায়াত করা বাসগুলি শহরের পাশ দিয়ে (কালীবাড়ি মোড়) বেরিয়ে যায়। সরু রাস্তার ফলে মানুষের সমস্যার কথা জানেন পুরপ্রধানও। কিন্তু রাস্তা চওড়া করতে কিছু জটিলতা রয়েছে। সুভাষবাবু বলেন, “গোবরডাঙা বাজার এলাকায় রাস্তা সরু হলেও দু’পাশের জমি কেউ জবরদখল করে নেই। ফলে আমাদের বা সরকারি জমি না থাকায় ইচ্ছা থাকলেও রাস্তা চওড়া করা যায়নি। তবে স্টেশন রোড এলাকায় রাস্তার কিছু জমি জবরদখল আছে। সেই জট ছাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে।”

সড়ক পথে পরিবহণ সমস্যা রয়েছে। ২০১০ সালে শহরের মধ্যে তৈরি হয়েছে বাস টার্মিনাস। কিন্তু ওই টার্মিনাসে কোনও বাস দাঁড়ায় না। এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, সেখানে কিছু ম্যাটাডোর ও অটো দাঁড়িয়ে আছে। গোবরডাঙা শহর থেকে সরাসরি কোনও বাস চলাচল করে না। বাসিন্দারা জানালেন, গাইঘাটার বেড়ি গোপালপুর থেকে এমএন-৬ রুটের বাস শহরের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে বারাসত পর্যন্ত। এখান থেকে কলকাতা বা বারাসত বা অন্য কোথাও যাওয়ার বাস চলে না। ভরসা বলতে একমাত্র ট্রেন। প্রায় ১৩৫ বছর আগে গোবরডাঙায় রেল পরিষেবা শুরু হয়। শোনা যায়, মহাত্মা গাঁধী রেলপথে গোবরডাঙার উপর দিয়ে যাতায়াত করেছেন।

বনগাঁ লোকাল ও গোবরডাঙা লোকাল ট্রেন বন্‌ধ, অবরোধ বা অন্য কোনও কারণে বন্ধ হয়ে গেলে এলাকার মানুষের বিপত্তির শেষ থাকে না। শহর থেকে কিছু অটো অবশ্য চারঘাট-সহ বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করে।

পুরসভার একটি অতিথি নিবাস আছে। বাইরে থেকে লোকজন এসে এখানে কেউ থাকেন না। কিন্তু সেখানে এখন নানা সামাজিক অনুষ্ঠান হয়। এলাকায় কোনও আবাসিক হোটেল না থাকাটা একটা সমস্যা। পরিবারের সকলকে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করার মতো হোটেল-রেস্টুরেন্টও নেই। শহরের ব্যবসায়ী বিকাশ চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপের সুরে বললেন “গোবরডাঙা অভিজাত এলাকা। বহু মানুষ অর্থনৈতিক ভাবেও স্বচ্ছল। খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়, আধুনিক শহর বলতে আমরা যা বুঝি তা এখানে গড়ে ওঠেনি। যে কোনও ভাল মানের জিনিসপত্র কিনতে হলেও আমাদের হাবরায় যেতে হয়। শহরটাতে আধুনিক হিসাবে গড়ে তোলার সুযোগ ছিল। কিন্তু কবে যে তা হবে, কেউ জানে না।”

শহরবাসীর অভিযোগ, নিকাশি নালা নিয়মিত পরিস্কার করা হয় না। ফলে মশার উপদ্রব বাড়ছে। বেআইনি ভাবে পুকুর ভরাট হচ্ছে বলেও অভিযোগ। শহরের নিকাশি ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান মাধ্যম যমুনা নদী এখন মজে গিয়েছে। জল ধারণের ক্ষমতা নেই। বর্ষায় উল্টে নদীর জল লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। কয়েকবার নদী থেকে পলি তুলে সংস্কার কাজ করা হলেও নদীতে স্রোত ফেরেনি, নাব্যতাও বাড়েনি।

আজও সমস্ত বাড়িতে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের লাইন পৌঁছে দেওয়া যায়নি। নামেই একটি গ্রামীণ হাসপাতাল আছে। সেখানে কার্যত কোনও চিকিত্‌সা পরিষেবাই মেলে না। শহরটি হাবরা থানার অধীন। এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। এলাকার মানুষের দাবি, একটি পূর্ণাঙ্গ থানার। প্রবীরকুমার মজুমদার নামে গোবরডাঙা পৌর উন্নয়ন পরিষদের এক কর্তা বলেন, “থানা হচ্ছে এলাকার উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। থানা তৈরি হলে আইন শৃঙ্খলার উন্নতি হবে।”

তবে এলাকার কিছু উন্নয়ন যে হয়নি তেমনটা নয়। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দু’একটি রাস্তা বাদ দিলে পুরনো রাস্তা সংস্কার হয়েছে। নতুন পিচের রাস্তা তৈরি হয়েছে। গোবরডাঙার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে দ্রুত গতিতে চলছে পুরনো টাউন হল ভেঙে আধুনিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরির কাজ। সুভাষবাবু বলেন, “টাউন হলের মাটির নীচের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। সেটি তৈরি করতে ৫ কোটি টাকা দরকার। তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”

পুরসভা সূত্রের খবর, এলাকায় প্রায় ১৪ হাজার পরিবারের বাস। কিন্তু মাত্র ২০ শতাংশ বাড়ির প্ল্যান রয়েছে। কিন্তু পুরকর দেওয়ায় অনেকের গাফিলতি আছে।

যমুনা নদীর ধারে গোবরডাঙার কালাচাঁদ কুণ্ডু মহাশ্মশানটি কয়েক বছর আগেও ছিল বেহাল। বর্ষায় জল থই থই অবস্থা হত। পুরসভার উদ্যোগে সেটি এখন আমূল বদলে গিয়েছে। রয়েছে চারটি চুল্লি, বিশ্রামাগার, মহিলাদের আলাদা বাথরুম।

এলাকায় রয়েছে স্কুল-কলেজ, বিএড কলেজ, ব্যাঙ্ক, বাজার, বাস টার্মিনাস, দমকল, শিশুদের হাসপাতাল, নার্সিংহোম। জমির দামও ইদানীং হু হু করে বাড়ছে। ২০০০ সাল নাগাদ যে জমির কাঠা ছিল ৭০ হাজার টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭ লক্ষ টাকায়।

গোবরডাঙার আর একটি আকর্ষণ প্রাণিসম্পদের সঠিক ব্যবহার ও প্রাণিপালনের জন্য হায়দাদপুরে ৪৫ বিঘে জমির উপরে তৈরি পোল্ট্রি ফার্ম। যার পরিচিতি গোটা রাজ্যে।এখন অবশ্য জৌলুস কিছুটা কমেছে। কঙ্কণা বাওরের কাছে ৩৩ বিঘে জমির উপরে তৈরি হয়েছে কঙ্কণা বিনোদন উদ্যান। দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ এখানে পিকনিক করতে আসেন। রয়েছে বোটিংয়ের সুবিধা।

পুরসভার বিরোধী দলনেতা সিপিএমের বাপি ভট্টাচার্য বলেন, “বিরোধী কাউন্সিলরদের সম্মান দেওয়া হয় না। দুষ্কৃতীদের রাজনীতিকরণ হয়েছে। চেয়ারম্যান সাধারণ কিছু কাজ করা ছাড়া নতুন কোনও প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে পারেননি।” বাপিবাবুর দাবি, শহরের যাবতীয় উন্নয়ন, তাঁদের আমলেই হয়েছে। তৃণমূলের পুরবোর্ড নতুন করে কিছু করেনি। এমনকী, বাম আমলে শহরে ১৫০টি সৌরআলো বসেছিল। সেগুলি এখন নেই। চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, সৌরআলোর ব্যাটারি চুরি হয়ে গিয়েছিল। বেশিরভাগই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

পুরপ্রধানের দাবি, কিছু কাজ বাকি আছে ঠিকই, কিন্তু অনেক কাজ হয়েওছে। এলাকায় প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেকটাই কমানো গিয়েছে। পুকুর ভরাট বন্ধ করা হয়েছে। সুভাষবাবু বলেন, “এলাকায় একটি বৃদ্ধাশ্রম করার জন্য যমুনা নদীর পাশে জমি কেনা হয়েছে। আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের প্রায় ৫০০টি মতো কল বসানো হয়েছে।” তিনি জানান, কেন্দ্রের অসহযোগিতার পানীয় জল প্রকল্প আটকে আছে।

সমস্যা কিছু থাকলেও অনেকেই জানালেন, দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে রাতে শান্তিতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারা যায়। অতীতে দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি চলত এখানে। কিন্তু ইদানীং সেই ঝুটঝামেলার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে শহরবাসী অনেক নিশ্চিন্ত।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE