Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বাহিনীর কড়া নজরে ভোট সীমান্তের গ্রামে

ঘড়ির কাটায় তখন সকাল সাড়ে ১১টা। স্বরূপনগরের সীমান্তবর্তী তাড়ালি গ্রামে মাসুরা বিবি, সাত্তার গাজির বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল তাঁরা তখন ভাত খেতে বসেছে। সাংবাদিক দেখেই সাত্তার মুখে একগাল হাসি নিয়ে বললেন “সকালবেলায় ভোট দিয়ে এসেছি।” ভোট কেমন হল জিজ্ঞাসা করাতে দুজনেই বলে উঠলেন, “এবার শান্তিমতন নির্ভয়ে ভোট দিতে পেরেছি। এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য।” সাত্তার গাজির বাড়ির পিছনে সোনাই নদী।

সোনাই নদীতে টলছে টহল। নিজস্ব চিত্র।

সোনাই নদীতে টলছে টহল। নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
স্বরূপনগর শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৩৭
Share: Save:

ঘড়ির কাটায় তখন সকাল সাড়ে ১১টা। স্বরূপনগরের সীমান্তবর্তী তাড়ালি গ্রামে মাসুরা বিবি, সাত্তার গাজির বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল তাঁরা তখন ভাত খেতে বসেছে। সাংবাদিক দেখেই সাত্তার মুখে একগাল হাসি নিয়ে বললেন “সকালবেলায় ভোট দিয়ে এসেছি।” ভোট কেমন হল জিজ্ঞাসা করাতে দুজনেই বলে উঠলেন, “এবার শান্তিমতন নির্ভয়ে ভোট দিতে পেরেছি। এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য।” সাত্তার গাজির বাড়ির পিছনে সোনাই নদী। সেই নদীর ওপারেই বাংলাদেশ অবস্থিত। নির্বাচনের আগে দুষ্কৃতীরা ওই পথেই এলাকায় আসে। কিন্তু সাত্তারের বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা গেল সোনাই নদীতে এ দিন চলছে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাবাহিনীর স্পিড বোর্ডের টহলদারি।

এরপরই রাস্তায় বেরিয়ে দেখা গেল, এক বৃদ্ধাকে তাঁর নাতি গরুর গাড়ি করে নিয়ে আসছে ভোট দিতে। রাস্তাতেও রয়েছে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী। বিভিন্ন বুথে গিয়ে দেখা গেল মহিলারা ছোট ছোট শিশু নিয়েই ভোট দিতে এসেছেন। যদি কোনও গণ্ডগোল বাধে জিজ্ঞাসা করাতে তাঁরা বললেন , “রাস্তায় এত কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে বিপদ হবে কী করে।”

বলা যায় কেন্দ্রীয়বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় এবার শান্তির ভোট হল স্বরূপনগরের সীমান্তবর্তী এলাকায়। এই প্রথম সীমান্তবাসীরা নিজের ভোট নিজেরা দিতে পেরে খুশি। আগের মতো ভোটের দিন গুলি, বোমা এবং দুষ্কৃতীদের হুমকি একপ্রকার রুখে দিল জওয়ানরা।

স্বরূপনগরের ১০টি এবং বাদুড়িয়ার ২টি পঞ্চায়েতে শুক্রবার উপনির্বাচন ছিল। সীমান্তবর্তী তাড়ালি গ্রামে নেই অনেক কিছুই। যেমন, বিপিএল তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও এখানকার মানুষ বিদ্যুৎ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। এমনকী চালও পায়না বলে অভিযোগ। নেই আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল। এলাকার রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু তাও এখানকার মানুষ ভোট দিতে আগ্রহী।

কিন্তু একসময় এই এলাকার মানুষ দৃষ্কৃতীদের হুমকির জন্য ভোট দিতে যেতে পারেননি। সীমান্তে সন্ত্রাস নতুন কথা নয়। তার মধ্যে ভোট এলে তো আরা কোনও কথাই নেই। নির্বাচনের আগে নদী পেরিয়েও ভারতে ঢুকেছে বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা বলে অভিযোগ। এলাকার মানুষকে তাদের শাসানি সহ্য করতে হয়েছে। কত মানুষ ইচ্ছা থাকলেও ভোট দিতে যেতে পারেননি সে সময়। ভোটের প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে গরু পাচার। এমনকী এপার ওপার লোকজন যাওয়া আসাও বন্ধ।

তাঁড়ালি প্রাথমিক স্কুলের ১০৫ নম্বর বুথে ভোট দিতে এসে ওই গ্রামের আয়েশা বিবি বলেন, “সীমান্তে সন্ত্রাস আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে এখন কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাপটে দুষ্কৃতীরা আর গ্রামে ঢুকতে সাহস করছে না।”

স্থানীয় হাকিমপুর বিথারি পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধান তথা তৃণমূল নেতা আনিসুদ্দিন গাজি বলেন, “নির্বাচনের দিনও কোথায় কোনও গণ্ডগোল নেই। তবে বাম আমলে কিন্তু এমনটা ছিল না। বাম আমলে গুলি, বোমা তো আছেই। তার সঙ্গে ছিল দুষ্কৃতীদের হুমকি।” বিএসএফ আর সীমান্তরক্ষীর কড়া টহলে সব এখন বন্ধ হয়েছে বলে দাবি তাঁর। এই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে বামফ্রন্ট।

খোলসি গ্রামে কাঁটা তার থাকলেও দুষ্কৃতীরা তা কেটে ফাকা করে দিয়েছে। এখানে দুপারের মানুষের অঘাত যাওয়া আসা বলে অভিযোগ। কয়েকদিন আগে এই খোলসি গ্রামে গরু পাচারে বাধা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের দুষ্কৃতীদের হাতে মৃত্যু হয়েছিল এক বিএসএফের জওয়ান। এ প্রসঙ্গে সাকিলা খাতুন, মনোহারা বিবিরা বলেন, “আমরা বড়ই ‘শান্তিতে’ বাস করি এখানে। বাংলাদেশের দুষ্কৃতীদের প্রতিবাদ করলেই কপালে জোটে গুলি।” এপরই দেখি ছোট্ট একটি মেয়ে মায়ের আঁচল ধরে বলে “কালকেই তো ওই মুখোশ পড়া লোকগুলি বাড়িতে....” কথার মাঝেই মুখ চেপে ধরলো তার মা। হাত ধরে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সময় পিছন ফিরে বললেন, “আপনারা এসেছেন চলে যাবেন। আমরা সীমান্তের মানুষ। ভোট দিয়ে বা না দিয়ে আমাদের দুঃখের কোনও পরিবর্তন হবে না।”

কৈজুরি গ্রামেও পাচারকারীদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কয়েকমাস আগে দুই মহিলার ধর্ষণ হয়েছিল। তার মধ্যে আবার একজন মহিলা খুনও হয়েছিলেন। কিশোরীকেও তুলে নিয়ে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা।

সঞ্জয় মণ্ডল ও রত্না দাস বলেন, “এই পরিস্থিতিতে আমরা এখানে থাকি। ভোট আমাদের জন্মগত অধিকার। তাই চমকানো ধমকানো উপেক্ষা করেও ভোট আমরা দেব। কিন্তু তাতেও কী আমরা শান্তিতে থাকতে পারব?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

swarupnagar nirmal basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE