Advertisement
E-Paper

ভোটের দিন বাগানে আল কাটলেন প্রাক্তন বিধায়ক

ফোনে বললেন, “চলে আসুন। এমনিতে তো গৃহবন্দি হয়েই আছি।” বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে পেঁপে বাগানে আল কাটছেন। বেলা তখন প্রায় ১২টা। বাগদার প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক দুলাল বরের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। চেনাই যাচ্ছিল না মানুষটাকে। মনে পড়ছিল ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটের কথা। সে বার কাজটা সহজ ছিল না। তখনও বামেদের রাশ ততটা আলগা হয়নি রাজ্য রাজনীতিতে। কিন্তু সেই দুলালবাবুরই এ বার এই হাল! কারণটা কী?

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:২৭
বাগানে মাটি কাটতে ব্যস্ত দুলাল বর। —নিজস্ব চিত্র।

বাগানে মাটি কাটতে ব্যস্ত দুলাল বর। —নিজস্ব চিত্র।

ফোনে বললেন, “চলে আসুন। এমনিতে তো গৃহবন্দি হয়েই আছি।” বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে পেঁপে বাগানে আল কাটছেন।

বেলা তখন প্রায় ১২টা। বাগদার প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক দুলাল বরের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। চেনাই যাচ্ছিল না মানুষটাকে। মনে পড়ছিল ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটের কথা। সে বার কাজটা সহজ ছিল না। তখনও বামেদের রাশ ততটা আলগা হয়নি রাজ্য রাজনীতিতে। কিন্তু সেই দুলালবাবুরই এ বার এই হাল!

কারণটা কী?

বোঝা গেল দলেরই একাংশের উপরে বেজায় চটে আছেন এক সময়ে বাগদার রাজনীতিতে প্রভাবশালী নেতা দুলাল। কিন্তু সে দিন গিয়েছে। বাগদার বর্তমান বিধায়ক উপেন বিশ্বাসের বিরুদ্ধ গোষ্ঠী বলে পরিচিত দুলালবাবু এবং আরও কয়েক জন নেতার এ বার ভোটে একেবারে বসে-যাওয়া চেহারা। রাস্তায় দেখা হল কার্তিক বাইনের সঙ্গে। তিনি উপেনবাবুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোক। বললেন, “আমাদের তো প্রচারে ডাকা হয়নি। নামতেই দেওয়া হল না। তবে ভোটটা দিয়েছি।”

কী হবে তা হলে এ বার বাগদার ভোটে?

২০১৪ সালে বনগাঁ লোকসভার ভোটে বাগদা বিধানসভা এলাকায় তৃণমূলের লিড ছিল প্রায় ২৪ হাজার ভোটের। কার্তিকবাবুর দাবি, এ বার নাকি উপেনবাবু বলেছেন, বাগদা থেকে আরও বেশি লিড দেবেন। কিন্তু দলের একটা প্রভাবশালী অংশ যে ভাবে বসে থাকল চুপ করে, তাতে এই ফল হবে কী?

তৃণমূল শিবির অবশ্য আশাবাদী। দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আঁচ ভোটের ফলে পড়বে না বলেই মনে করছেন তাঁরা। বস্তুত, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আছে বলেই মানতে চাননি দলের জেলা নেতারা। তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “সকলকেই প্রচারে হয়ে নামানো হয়েছিল। এক সঙ্গেই তাঁরা কাজ করেছেন।” দুলালবাবুদের মতো কাউকে কাউকে হরিণঘাটা-কল্যাণীতে কাজ করতে বলা হয়েছিল বলেও জানান তিনি। সেই প্রস্তাব যে এসেছিল, তা মেনে নিলেন দুলালবাবু। কিন্তু তাঁর কথায়, “নিজের এলাকায় কাজ করতে পারলাম না। অন্য কোথাও যাইনি।”

নিজের এলাকায় কাজ যে কাকে বলে, তা বিগত ভোটগুলিতে সত্যিই প্রমাণ করেছিলেন দুলালবাবু, কার্তিকবাবু, দিলীপ ঘোষ, তরুণ ঘোষরা। ভোটের আগে থেকেই তাঁদের ব্যস্ততা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছত। ভোটারদের বুথমুখো করা, কর্মীদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করার মতো ভোট-সংক্রান্ত হাজারটা ঝক্কি সামলাতেন তাঁরা। দুলালবাবুর তো কার্যত নাওয়া-খাওয়ারও সময় থাকত না। এ ভাবেই দক্ষ সংগঠক এবং প্রভাবশালী নেতা হিসাবে মমত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠও হয়ে উঠেছিলেন দুলাল। ভোটের টিকিট পান। বিধানসভায় ভাঙচুরের ঘটনাতেও মমতার স্নেহধন্য দুলালবাবু ছিলেন সামনের সারিতে। তাতে দলনেত্রীর কাছে নম্বর বেড়েছিল বিস্তর, এমনই শোনা যায় স্থানীয় কর্মীদের মধ্যে। কিন্তু সে সবই এখন অতীত। যে কারণে ভোটের দিন দুপুরে বাড়ির গাছে আল কেটে জল দেন দুলাল। অন্যরাও নানা ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত হয়েই কাটান সময়টা। ভোট দিতে যাবেন তো? দুলালবাবুর সংক্ষিপ্ত জবাব, “ভোটটা তো দিতেই হবে।” তবে একটু দূরে বসে কাপড় কাচছিলেন স্ত্রী স্মৃতিকণা। তাঁর কাছ থেকেও ভোট দিতে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তর মিলল “দেখি।”

দলের একগুচ্ছ নেতা-কর্মীকে চটিয়ে তৃণমূল বাগদায় কত ভোট পায়, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায় দুলালবাবুরা। বাগদায় অতীতেও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দেখা গিয়েছে। তবে ভোটে এক গোষ্ঠীর এমন নিরুত্তাপ চেহারা দেখা যায়নি। বস্তুত, বাগদার শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ে ভোটের ক’দিন আগেই হয়ে যাওয়া ছাত্র সংসদের ভোটের ফলাফল প্রকাশের পরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আরও প্রকাশ্যে আসে। দলের দুই গোষ্ঠীই পৃথক প্যানেল দিয়েছিল এখানে। দু’পক্ষের কোন্দল মেটাতে না পেরে জেলা নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছিলেন, যে জিতবে, তারাই হবে দলের স্বীকৃত প্যানেল। দুলালবাবুদের গোষ্ঠী পরাজিত হয় ছাত্র সংসদের ভোটে। তারপর থেকে তাঁদের স্থানীয় রাজনীতিতে আরও কোণঠাসা করে ফেলা হয়। নিখিল ঘোষ, রবিন চক্রবর্তী, অঘোর হালদার, শম্পা অধিকারীদের মতো নেতা-নেত্রীরা চলে আসেন সামনের সারিতে। দুলালবাবুর কথায়, “উপেনবাবু আমাদের তো প্রায় দল থেকেই বের করে দিয়েছেন।” তাঁর কটাক্ষ, “উনি চুল আর চোখ দেখে কয়েক জন বাছাই করা সৎ মানুষকে নিজের সঙ্গে নিয়েছেন।” তা হলে আপনি কী সেই সৎ মানুষদের দলে পড়েন না? কী দেখেছেন উপেনবাবু আপনার চোখে? দুলালবাবুর জবাব, “আমার চোখে উনি প্রতিবাদ দেখেছেন।”

এত অভিযোগ যাঁর দিকে, কী বলছেন সেই উপেন বিশ্বাস? এ বার বনগাঁয় নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন উপেনবাবু। সারদা-কাণ্ডে জর্জরিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইদানীং প্রাক্তন এই সিবিআই কর্তার উপরে বিশেষ ভরসা রাখছেন বলে দলের অন্দরের খবর। ফলে উপেনবাবুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীকে ভোটের ময়দান থেকে ব্রাত্য রাখার ঘটনায় দলের কোনও নেতানেত্রীকে মীমাংসা সূত্র বের করতে উৎসাহিতও মনে হয়নি। উপেনবাবু বলেন, “যাঁদের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা সকলেই সমাজবিরোধী, চোরাকারবারি। ওঁদের সঙ্গে আমার স্টেটাসে মেলে না। ওঁদের থেকে কালো টাকা নিয়ে আমি ভোট করতে পারব না।”

উপেনবাবুর এই মেজাজ অবশ্য জেলা নেতাদেরও অনেকে ভাল চোখে দেখছেন না। তাঁদের মতে, বিজেপির ক্রমউত্থানের পর্বে এ ভাবে পুরনো নেতা-কর্মীদের একটা অংশকে চটানোটা হয় তো ভবিষ্যতে বুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে। ইতিমধ্যেই বাগদার পরিচচিত টিএমসিপি নেতা জয়ন্ত বিশ্বাস লোকজন নিয়ে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। ভোটের দিন নিজের জমিতে যে আল কাটছিলেন দুলালবাবু, সেখান দিয়ে কোন কুমির ঢোকে, তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।

arunakhya bhattacharya simanta maitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy