Advertisement
১৯ মে ২০২৪

লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বোট নেই, মাঝসমুদ্রে ভরসা উপরওয়ালাই

ইলিশ ধরতে গভীর সমুদ্রে যেতেই হবে মত্‌স্যজীবীদের। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেই পেশাগত ঝুঁকিরই অঙ্গ। কিন্তু সেই ঝুঁকিকে মোকাবিলার মতো উপযুক্ত পরিকাঠামো কি আছে মত্‌স্যজীবীদের? উত্তর এক কথায় ‘না’ বললে অত্যুক্তি হবে না। যে কারণে প্রতি বছরই মাঝ সমুদ্রে নৌকোডুবির মতো ঘটনায় প্রাণ খোয়াতে হয় মত্‌স্যজীবীদের। এ বারও কাকদ্বীপের বেশ কিছু ট্রলার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।

দিলীপ নস্কর
কাকদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৪ ০২:২৬
Share: Save:

ইলিশ ধরতে গভীর সমুদ্রে যেতেই হবে মত্‌স্যজীবীদের। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেই পেশাগত ঝুঁকিরই অঙ্গ। কিন্তু সেই ঝুঁকিকে মোকাবিলার মতো উপযুক্ত পরিকাঠামো কি আছে মত্‌স্যজীবীদের? উত্তর এক কথায় ‘না’ বললে অত্যুক্তি হবে না। যে কারণে প্রতি বছরই মাঝ সমুদ্রে নৌকোডুবির মতো ঘটনায় প্রাণ খোয়াতে হয় মত্‌স্যজীবীদের। এ বারও কাকদ্বীপের বেশ কিছু ট্রলার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ডুবে যায় ‘এফবি সূর্যনারায়ণ’ এবং ‘এফবি মহারুদ্র’ ট্রলার দু’টি। সূর্যনারায়ণের সাত জন নিখোঁজ ছিলেন। পরে ছ’জনের দেহ উদ্ধার হয় ডুুবে যাওয়া ট্রলারের খোলের মধ্যে থেকে। সূর্যনারায়ণের ১৪ জন মত্‌স্যজীবীর খোঁজ প্রথম দিকে পাওয়া না গেলেও পরে অবশ্য তাঁদের অক্ষত দেহেই উদ্ধার করা হয়। এ সবের জেরে প্রাণহানির ঘটনায় ছেদ পড়ে না। ২০১১ সালে ট্রলার উল্টে ৩২ জন মারা যান। ২০১২ সালে মারা গিয়েছেন ৪ জন। ২০১৩ সালে মৃত্যু হয় ১০ জন মত্‌স্যজীবীর।

কিন্তু প্রতি বছরই কোনও না কোনও ভাবে দুর্ঘটনায় পড়তে হয় কিছু ট্রলারকে। লাইফ জ্যাকেট বা লাইফ বোট বেশির ভাগ ট্রলারেই থাকে না। আবহাওয়ার পূর্বাভাসও মেলে না বলে অভিযোগ। তার উপরে ট্রলারগুলির রক্ষণাবেক্ষণের কোনও মানদণ্ড না থাকায় ঝুঁকি থেকেই যায়। মত্‌স্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “মত্‌স্যজীবীদের সমস্যার বিষয়ে সব শুনেছি। সমাধানের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কাকদ্বীপ ও ডায়মন্ড হারবার মহকুমা এলাকায় কয়েক হাজার মত্‌স্যজীবীর বসবাস। দুই মহকুমায় আছে ডায়মন্ড হারবার মত্‌স্য বন্দর, কাকদ্বীপ মত্‌স্য বন্দর, ফ্রেজারগজ্ঞ মত্‌স্য বন্দর, মায়াগোয়ালিনী মত্‌স্য বন্দর। এ ছাড়াও রায়দিঘি ঘাট, নামখানা ঘাট, সাগরের বিভিন্ন ঘাট থেকেও মত্‌স্যজীবীরা ট্রলার নিয়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যান। ফ্রেজারগজ্ঞ ও ডায়মন্ড হারবার মত্‌স্য বন্দরে চরা পড়ে গিয়ে ভাটার সময় গভীর সমুদ্র থেকে ফেরা ট্রলার ভিতরে ঢুকতে পারে না। ফলে মাছ-বোঝাই ট্রলার নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। না হলে দূরের কোনও বন্দর বা ঘাটে ট্রলার লাগাতে বাধ্য হন তাঁরা। এ ছাড়াও ওই ঘাট বা বন্দরে ট্রলার সারানোর মতো কোনও ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যায় পড়তে হয় মত্‌স্যজীবীদের। ট্রলার সমুদ্রের কত গভীরে চলে গিয়েছে, তা জানার মতো ব্যবস্থা নেই। ট্রলার চালকদের কোনও উপযুক্ত প্রশিক্ষণও থাকে না। সমুদ্রে গিয়ে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বা ট্রলার খারাপ হয়ে গেলে বন্দরে যোগাযোগের কোনও উপায় নেই। এমনকী, ট্রলারে কোনও লাইফ জ্যাকেট বা লাইফ বোট না থাকায় কোনও কারণে ট্রলার উল্টে গেলে মত্‌স্যজীবীদের কার্যত ভাগ্যের ভরসায় থাকা ছাড়া উপায় নেই। গভীর সমুদ্রে যাওয়া ট্রলারের কাছে বিপদসংকেত পাঠানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। আবহাওয়া দফতর থেকে আগাম পূবার্ভাস না জানতে পারায় গভীর সমুদ্রে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হয় তাঁদের হামেশাই।

মত্‌স্যজীবীদের অভিযোগ, সমুদ্রে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারের দায়িত্ব উপকূল রক্ষীবাহিনী বা স্থানীয় প্রশাসনের। কিন্তু বিভিন্ন সময় সমুদ্রে দুর্ঘটনায় পড়া ট্রলার উদ্ধার করে আনতে হয় বাকি মত্‌স্যজীবীদের নিজেদেরই। অথচ যে ট্রলার দিয়ে সমুদ্র থেকে দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রলার টেনে আনা হয়, সেই ট্রলার এই কাজের জন্য আলাদা ভাবে তৈরি করা হয় না। ফলে উদ্ধার করতে গিয়ে ট্রলার বিপদের হাতে পড়েছে, এমন উদাহরণও আছে। বকখালির ফ্রেজারগজ্ঞে উপকূলবর্তী পুলিশি ব্যবস্থা থাকলেও তাদের পরিকাঠামো ততটা উপযুক্ত নয়। ভাল জলযানের ব্যবস্থা নেই। নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশকর্মী।

গভীর সমুদ্রে যাওয়া মত্‌স্যজীবী কমল দাস, সনাতন দাসেরা বলেন, “আমরা ২০-২৫ বছর ধরে সমুদ্রে যাচ্ছি। আমাদের পরিবারের বংশ পরম্পরায় মাছ ধরার কাজে যুক্ত। কিন্তু মাছ ধরতে গিয়ে বহু বার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়েছি। প্রতিবারেই নিজেদের বিপদ নিজেরাই কাটিয়ে উঠেছি। আমাদের দাবি, সরকার যদি মত্‌স্যজীবীদের ট্রলারগুলিতে লাইফ জ্যাকেট দেবার ব্যবস্থা করে, তা হলে খুবই উপকার হয়।” কাকদ্বীপ মত্‌স্যজীবী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বিজন মাইতি বলেন, “কাকদ্বীপ ও ডায়মন্ড হারবার দুই মহকুমায় প্রায় আড়াই হাজার গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ট্রলার রয়েছে। আবহাওয়া দফতরের খামখেয়ালিপনায় সমুদ্রে দুর্ঘটনা ঘটছে। আবহাওয়া দফতর থেকে সঠিক সময়ে খবর পেলে মত্‌স্যজীবীদের সতর্ক করে দেওয়া যায়। তা ছাড়া সমুদ্রে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে প্রতিবারেই আমরা উদ্ধার কাজ করি। প্রশাসনের দেখাই মেলে না।” তাঁর দাবি, উদ্ধারের জন্য উন্নতমানের জলযান চাওয়া হলেও প্রশাসন দীর্ঘ দিন ধরে কোনও ভাবে উদ্যোগী হয়নি।

সহ মত্‌স্য অধিকতা (সামুদ্রিক) কিরণলাল দাস বলেন, “গভীর সমুদ্রে যাওয়া মত্‌স্যজীবীদের নজরদারির জন্য ফ্রেজারগজ্ঞ কোস্টালে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়ারলেস ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ ছাড়া, উপকূল রক্ষীবাহিনী, আবহাওয়া দফতরের কিছুটা খামখেয়ালিপনায় মত্‌স্যজীবীদের দুর্ঘটনায় পড়তে হচ্ছে। বিপর্যয় মোকাবিলা কমিটি সময় মতো পাশে না দাঁড়ানোয় সমস্যা হয়।” বিষয়গুলি জেলা প্রশাসনকে জানানো হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকেই হোক বা দীর্ঘ দিনের হতাশা, ডায়মন্ড হারবারের প্রবীন এক মত্‌স্যজীবী অবশ্য বলেই ফেললেন, “অনেক প্রতিশ্রুতি আর বড় বড় কথা শুনলাম সারা জীবন ধরে। উপরওয়ালা ছাড়া মাঝসমুদ্রে আমাদের রক্ষা করার মতো আর তো কাউকে দেখলাম না!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE